‘দ্য স্ক্যাভেঞ্জার অফ ড্রিমস’ ছবির একটি দৃশ্যে সুদীপ্তা চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
“কালো রাত কাটে না কাটে না,
এতো ডাকি, রোদ্দুর এই পথে হাঁটে না
মাগো, এতো ডাকি খিদের দেবতাটাকে
বেশি নয় যেন দু’বেলা দু’মুঠো নুন মাখা ভাত রাখে...”
শুকনো ভাতে সামান্য লবণ, ছেঁড়া ময়লা শাড়ি ছেড়ে একটা ঝকঝকে গোলাপি সালোয়ার কামিজ, দাম্পত্যের মগ্ন নিবিড় শয্যায় ফুরিয়ে যাওয়া ডিওডোর্যান্টের কৌটো থেকে সামান্য গন্ধ মেখে নেওয়া, বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো জন্মদিনে ‘মুন্নি’ও কাটবে কেক, মুন্নি একদিন অনেক বড় হবে...উজ্জ্বল হবে ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’-এর মত, বাবুদের বাড়ির মেহগনি পালঙ্কটা যেন স্বপ্ন সাম্পান, তিরিশ টাকার লটারি টিকিট কেটে এক কোটির মালিক হওয়ার অদম্য আশা— এমন অজস্র স্বপ্নকে ‘বিনি সুতোর মালা’য় গাঁথলেন পরিচালক সুমন ঘোষ তাঁর সাম্প্রতিক হিন্দি ছবি, ‘দ্য স্ক্যাভেঞ্জার অফ ড্রিমস’ ছবিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাদের জীবনকাব্য— “আজ জুটেছে কাল কী হবে, কালের ঘরে শনি”তে এসে ঠেকে, খিদের দেবতা যাদের ঘরে সামান্য উচ্ছিষ্টও ফেলে রাখতে চান না, তাদের জীবনের পুঞ্জীভূত স্বপ্ন জমা হয় বিশ্বায়নের নগর থেকে নগর কলকাতার ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ডে’। আমাদের চেনা শহরেই এদের বাস, এদের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিন দেখা হয়। কিন্তু কেমন ভাবে এদের দিন গুজরান হয়, তা নিয়ে ভাববার সময় আমাদের নেটাগরিকদের হয়নি কখনও। পরিচালক সুমন ঘোষকে কুর্নিশ আর আন্তরিক সাধুবাদ, আমজনতার কাছে এই ব্রাত্য জীবনের দলিলটুকু তুলে ধরার জন্য। ছবিটি দেখতে দেখতে একদিকে যেমন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কালো বস্তির পাঁচালী’ মনে পড়ছিল, অন্য দিকে তেমনই গল্পহীন এই ছবির মূল চরিত্র বিরজুর চোখের ভাষায় উঠে আসছিল জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতার সামাজিকভাবে প্রান্তিক মানুষের ইতিবৃত্ত। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে ঋত্বিক ঘটক কিংবা মৃণাল সেনের কথা, যাঁরা শিল্পিত তুলির বেরঙা আঁচড়ে এঁকেছেন এই শ্রেণির মানবিক জীবন। তাঁদের উত্তরসূরী হয়ে পরিচালক সুমন ঘোষ ছকভাঙা পথে হাঁটলেন। বলাবাহুল্য, সফলও হলেন।
ছবির শুরুতেই চুক্তিভিত্তিক পুর সাফাইকর্মী বিরজু ও তার স্ত্রী সোনার ছেঁড়া ফাটা ঝুলকালি মাখা পূতি-গন্ধময় বস্তিতে নাগরিক বর্জ্যপদার্থে সাজানো সংসারের ছবি ফুটে উঠেছে। এর সঙ্গে পরিচালক বিরজুর মনস্তত্ত্বের আরও এক গভীর কথন বপন করলেন ছবিতে। বিশ্বায়নের দাবিতে বর্জ্য ফেলার হাতগাড়ি বদলে যায়, ব্যাটারিচালিত গাড়িতে। কিন্তু বিরজু সেই গাড়ি চালাতে সক্ষম নয়। এ চিন্তা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। কোভিড পরবর্তী জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে কর্মহীন হয়েছেন বহু মানুষ। বিরজুর মনেও সেই ভয় গ্রথিত হয়ে যায়। হতদরিদ্র, ভাগ্যহত, নিম্নবিত্তের আত্মকথনকে অভূতপূর্ব ভাবে ‘কাটশট’ এর মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন পরিচালক। এক দিকে সোনা কিংবা আশার সাংসারিক টানাপোড়েন-বাঁচার লড়াই, স্বামীর অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে আশার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মেয়েকে ‘মানুষ’ করে তোলার অঙ্গীকার এবং সাংসারিক যাতনায় পিষ্ট হতে হতে বুক ঠেলে উঠে আসা কান্না। অন্য দিকে বিরজু ও তার সহকর্মীদের শরীর নিংড়ানো পরিশ্রম, মেশিনের মত বোতাম টিপলে চালু হওয়া পেশীযন্ত্রের রেহাই একমাত্র ‘ছোটা বাংলা’র সুখে। ছেঁড়া ছেঁড়া, টুকরো টুকরো ব্যথার অনুভূতি-যন্ত্রণায় নারী আর পুরুষ এই ছবিতে এক পংক্তিতে এসে দাঁড়ায়।
আবার এই দৃশ্যপটের মাঝেই অশীতিপর এক বৃদ্ধের ছবি ফুটে ওঠে। সে যেন হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা— জীর্ণ, হতশ্রী সমাজের জঞ্জাল থেকে কুড়োনো অব্যবহার্য দ্রব্যের মাঝে বৃদ্ধ হেঁটে যায় হাতে একটি ঘণ্টা নিয়ে। ভাঙাচোরা সাইকেল, প্যাটন ট্যাঙ্কের ভাঙা ঢাকনা, পরিত্যক্ত কমোড, ফেলে দেওয়া মাইক্রোঅভেন— এমন টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে পরিচালক গড়ে তোলেন গরিবি স্বপ্নের অধরা আকাশকে! তার মাঝে দড়ির দোলনায় দুলতে থাকে মুন্নি। জীবনের যাবতীয় সঙ্কটে দোদুল্যমান বিরজুও যেন ব্যাটম্যানের মতো এগিয়ে চলে পরিবারের কথা ভেবে। তাকে যোগ্য সঙ্গত করে তার ঘরনি। সতীর্থের পায়ে চোট লাগলে,তীব্র প্রতিবাদ করে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কাজ খোয়ায় শেষ পর্যন্ত। ‘ঝোপরপট্টি’র মানুষের জীবন এতটাই সস্তা যে মেজাজ হারানো তাদের সাজে না। অথচ গোটা সমাজের দুঃসহ খারাপ মেজাজের ভার পুঞ্জীভূত হতে হতে প্রতিদিন এই ‘ঝোপরপট্টিতে’ই অজস্র স্বপ্নের মৃত্যু হয়।
ঠিক এই ব্যাপারটিই সুমন তাঁর ‘দ্য স্ক্যাভেঞ্জার অফ ড্রিমস’-এ ধরেছেন। ছবিটির মজা হল, কেবল কলকাতার মতো একটি মহানগরের সাফাইকর্মীদের জীবনই নয়, এক ভাবে, ছবিটি এই শহরের আম-বাসিন্দাদের জীবনের একটি ‘ট্র্যাজেডি’ বা সত্যের কথাও বলে, সারা ছবিতে বিস্তৃত একটি ন্যূনোক্তির মতো। কোভিড-উত্তর সময়ে কর্পোরেট সভ্যতায় যে ঘটনাটি ব্যাপক ভাবে এই সময়ে উঠে এসেছে, তা হল সর্বব্যাপী এক প্রযুক্তির আস্ফালন। সেই আস্ফালনের হাত ধরে উঠে এসেছে ‘রিমোট ওয়ার্কিং’-এর মতো নানা রকমের বিষয়, যাতে হয়তো সব কর্মী সমান দক্ষ নন। ঠিক যেমন ছবির বিরজু, গিয়ার দেওয়া বর্জ্যের গাড়ি চালাতে পারদর্শী নয়, হাতে টানা গাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্য, তেমনই। একই ভাবে আধুনিক সময়ে কর্পোরেট সভ্যতায় দ্রুত কমে আসছে কাজের জগতে মানবিকতার ছোঁয়া। যখন কাজের জন্যই তার সহকর্মী আহত হয়, তখন বিরজু ঠিকাদারের মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, বলতে গেলে ঝগড়া করে—যার ফল হিসাবে শেষে তার চাকরি যায়। তাই ছবিটি দেখতে বসে মনে হয়, এ যেন আমাদের মধ্যে অনেকেরই জীবনচিত্র। আসলে আমরা সবাই হয়তো বিরজুর মতোই ঠিকাকর্মী। আর এখানেই ছবিটির উত্তরণ ঘটে, একজন সাফাইকর্মীর জীবন থেকে আম-শহরবাসীর জীবনের গল্পে।
বাবার কাজ হারানোয়, মৃত্যু হয় মুন্নির কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইলের অনলাইন ক্লাসের, মৃত্যু হয় সোনার গোলাপি সালোয়ার পরে বড়বাড়ির বিবিদের মতো নিজেকে সাজানোর স্বপ্নের, মৃত্যু হয় বিরজুর ‘টিন ভাঙ্গা লোহা ভাঙ্গা’য় গড়া এক চিলতে সংসারের! শহর কলকাতার নাগরিক বর্জ্য স্তূপে বিরজু-সোনা-মুন্নি খুঁজতে থাকে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলিকে। ড্রোন ক্যামেরায় বিলাসবহুল ব্যস্ত শহরে চুঁইয়ে পড়ে সোনালী রোদ। মনে পড়ে ‘কালো বস্তির পাঁচালী’র
সেই পংক্তিগুলো— “আয় রোদ্দুর আয়...দারুন শীতে খুকু মোদের ঠান্ডা হয়ে যায়! আয় লক্ষ্মী, আয়রে সোনা—এইটুকুতেই জাত যাবে না”। কিন্তু সে স্বপ্ন যে মিথ্যা, সে স্বপ্ন চাপা পড়ে থাকে ধাপার মাঠের জঞ্জালস্তূপের তলানিতে!
এ বার আসা যাক ছবির কলাকুশলীদের কথায়। অন্ধ ভূমিগর্ভে যে চরিত্রদের জন্ম, তাদের আলোর সত্যে টেনে আনার কাজ মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু এই ছবির অভিনেতারা বড় অনায়াসে সে কাজ সেরেছেন। দর্শকের হাত শক্ত করে ধরে তারা পৌঁছে দিয়েছেন বড় রাস্তার পাশের কানা গলিতে। সুদীপ্তা চক্রবর্তী, শার্দুল ভরদ্বাজ, বৃদ্ধের চরিত্রে নিমাই ঘোষ কিংবা দেবরঞ্জন নাগ— এঁরা কেউই এই ছবিতে এক মুহূর্তের জন্য উপস্থিত ছিলেন হয়তো! ‘টাইটেল ট্র্যাকে’ তাঁদের নাম ছিল বটে, কিন্তু সত্যের অজানিত পথে দর্শকদের সামনে এক-একজন এসে দাঁড়িয়েছেন বিবেক হয়ে। ‘বাড়িওয়ালি’র সেই কাজের মেয়েটি এখন অনেক পথ পেরিয়েছে— সে যেমন নিজেও এগিয়েছে, আমাদেরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে মৃত জঞ্জালের স্তূপে নির্বিকার অভিযোগহীন জীবনযাপনে। বিহারী দেহাতি ভাষা উচ্চারণে আর সিঁথিতে লেপটানো মেটে সিঁদুরে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছে অস্পৃশ্য-অশুচির প্রতিভূদের। না, সুদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনয় করেননি, বরং কড়া নেড়েছেন আমাদের বিবেকের দরজায়, প্রতিদিন আমাদের ভালো থাকার অভিনয়ের চেষ্টায়। থিয়েটারের বাইরে স্টিলেটো আর সাদা সুতির জামদানির পোশাক পরিহিতা সুদীপ্তা চক্রবর্তীকে দেখে মনে মনে ভেবেছি— জীবন আর সমাজকে ঠিক কোন কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে অনায়াসে নিজেকে এত বার ভাঙা যায় কিংবা সোনার মতো রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ওঠা যায়! বিস্মিত হয়েছি বারবার! তেমনই বিস্ময় জাগিয়েছেন অভিনেতা শার্দুল ভরদ্বাজ। চরিত্রের বাস্তব রূপায়ণে মনে হয়েছে আচ্ছা, এই-ই তো আমার বাড়ি থেকে ময়লা তুলতে আসা তারক! কাল সকালে উঠেই তারককে জিজ্ঞেস করব ‘কেমন আছো? কেমন চলছে ঘর সংসার?’ জানি না, এ সব প্রশ্নের উত্তর ওঁর কাছেও আছে কিনা!
কলকাতার উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের আবর্জনা সংগ্রহকারীদের নিয়ে ছবি বানাতে গিয়ে সুমন লোকেশন হিসাবে বেছে নিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতা, সল্টলেকের অলিগলি থেকে ধাপার মাঠ। ছবি দেখতে দেখতে মাথায় আসছিল, গত তিন বছর আগে কুঁদঘাটে নর্দমা পরিষ্কার করতে আসা চার সাফাই কর্মীর কথা। জাহাঙ্গির, আলমগির, সাবির আর লিয়াকত আর ফিরবে না কোনও দিন! ওদের কোনও নিরাপত্তা নেই, নেই জীবনের স্থিরতা, নেই হাসপাতালের বেড, নেই প্রাথমিক চিকিৎসা-রোগের ওষুধ-বেঁচে থাকার অধিকার! শুধু আছে একপেটখিদে! একপিট খিদে নিয়ে মরে ওরা, আবার জন্মায় এক পেট খিদে নিয়ে! ওদের কথা কালোরাত্রির খামেই চাপা পড়ে থাকে। শ্যাওলার পুরু আস্তরণ ভেদ করে বিরজুর লিখে রাখা মুন্নির নাম যেমন থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, তেমনি এতগুলো ভুখা মানুষের জীবনের কাহিনী নিয়ে কোন গল্প তৈরি হয় না কোনও দিন।“ভুখ সে মারা হ্যায় গরিব তবভি কহানি না বনি”— সুমন, আপনাকে পুনরায় কুর্নিশ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবিতে এমন একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়কে গ্রহণ করবার জন্য। অনুরোধ একটাই, এই ছবির পাশে কাউকে দাঁড়াতে অনুরোধ করবেন না (প্রথমত ‘পাশে দাঁড়ানোর’ প্রশ্নটি উঠেছে আধুনিক বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে, এবং ছবিটি হিন্দি ভাষায়। দ্বিতীয়ত ছবিটি মোটেই সিঙ্গল স্ক্রিনে মুক্তির জন্যও নয়, একেবারেই ‘মাল্টিপ্লেক্স মুভি’)। তা ছাড়াও, এই ছবির পাশে না দাঁড়ানোটাই অন্যায়! মনুষ্যত্বের প্রতি অন্যায়! মানবতার প্রতি অন্যায়!