রোহিত শেট্টি তাঁর ‘পুলিশ ব্রহ্মাণ্ডে’র তাবড় আধিকারিককে একত্র করে এক মহাকাব্যিক আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। ছবি: সংগৃহীত।
গরিব বাড়ির ছেলেই হবে ছবির নায়ক, তাঁর নায়িকা হবে বড়লোকের আদুরে মেয়ে— এই ফর্মুলায় দীর্ঘ দিন ছবি বানিয়েছে বলিউড। নব্বই দশকের শেষ থেকে একটা বদল আসতে শুরু করে। প্রেমের ছবিতে নায়িকার বাবা-দাদার সঙ্গে প্রেমিকের সংঘর্ষের সমীকরণ বাদ পড়ে যায়। অ্যাকশন ছবিতে আসতে শুরু করে মাফিয়া, জঙ্গি প্রসঙ্গ। দেশপ্রেমের এক নতুন ধারায় বইতে শুরু করে। বলিউডের ফর্মুলায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন মহাকাব্য। মহাভারতের স্বাদে ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’ সদ্য চেখে দেখেছেন দর্শক। এ বার রামায়ণের পালা। রোহিত শেট্টি তাই বানিয়ে ফেললেন ‘সিংহম আগেন’। তাঁর ‘পুলিশ ব্রহ্মাণ্ডে’র তাবড় আধিকারিককে একত্র করে এক মহাকাব্যিক আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে রেখেছিলেন চমক, লেডি সিংহম দীপিকা পাড়ুকোন। কিন্তু মনোরঞ্জনের বদলে পর্দায় জ্বলে উঠল আগুন। অ্যাকশনের তাপে কি সিঁটিয়ে গেলেন দর্শক!
অজয় দেবগন বা অক্ষয় কুমারদের মতো পরিণত নায়কদের ক্ষেত্রে মহাকাব্যিক ফর্মুলায় রাম অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হয়ে উঠছেন। তারই সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে চিরায়ত কাশ্মীর বিতর্ক, খানিকটা ধর্মপ্রাণতা। পরীক্ষামূলক ভাবে রোহিত বেছে নিয়েছেন এই ফর্মুলাই। যেখানে খুব চওড়া দাগে বোঝানো হয়েছে ছবির নায়ক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ আধিকারিক বাজিরাও সিংহম (অজয় দেবগন) আসলে স্বয়ং ভগবান রাম। তাঁর স্ত্রী অবনী বাজিরাও (করিনা কপূর) সীতাদেবী। দাপুটে পুলিশ আধিকারিক সিম্বা (রণবীর সিংহ) আসলে হনুমান, দক্ষ পুলিশ আধিকারিক দয়া (দয়া শেট্টি) জটায়ু। আগের ছবিগুলি থেকে জনপ্রিয় পুলিশ আধিকারিকদের চরিত্রকে তুলে এনে রামায়ণের রেখাচিত্র এঁকে ফেলেছেন পরিচালক।
ছবির শুরু হয়েছে কাশ্মীরের অপূর্ব নিসর্গের প্রেক্ষাপটে। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে দর্শক যখন তাঁর আসনে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ঠিক তখনই শুরু হয় ‘চেজ়িং অ্যান্ড ফাইটিং’। মানুষ মানুষকে ধাওয়া করছে, গাড়ি গাড়িকে। বিভিন্ন কায়দায় প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার দৃশ্যগুলি দর্শককে আসনের সঙ্গে একেবারে আটকে দিতে থাকে। মনে হতে পারে, ‘সিংহম আগেন’-এর মূল ভাবনাই হল যেনতেনপ্রকারেণ ধাওয়া করো এবং মারো। পাথরের মতো স্থির হয়ে দর্শক যখন ধাওয়া করা এবং মারার বিভিন্ন জমাটি কসরত দেখছেন, তখনই একরাশ বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে পর্দায় হাজির হন এই ছবির আসল নায়ক রামায়ণের রাম।
ছবির প্রথম ঝলক মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে মহাকাব্যিক এই সংযোজনে। মহাকাব্যিক বলা হলেও আসলে অভিযোগ উঠেছে এই সংযোজনে এক বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির দিকে নজর রাখা হয়েছে। যাই হোক, পর্দায় রামকে দেখে আম ভারতীয় দর্শক তাঁর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই নড়েচড়ে বসেন। উঠে আসে বহু দিনের জনপ্রিয় বিতর্ক, রামায়ণ কি কল্পনা, না ইতিহাস?
একে একে রামায়ণের চরিত্রদের সঙ্গে মিলে যেতে শুরু করলেন ছবির তারকারা। এসিপি সত্য (টাইগার শ্রফ), ডিসিপি শক্তি শেট্টি (দীপিকা পাড়ুকোন) অবশ্য নিজেদের মতো করে লড়াই চালিয়ে গেলেন। এই ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ প্রক্রিয়ায় দলবল নিয়ে বাজিরাও সিংহম উপস্থিত হলেন শ্রীলঙ্কায়। সেখানে অবস্থান করছেন রাবণরূপী ভয়ঙ্কর ডন ডেঞ্জার লঙ্কা (অর্জুন কপূর)। তিনি তার দাদু, ওমর হাফিজকে (জ্যাকি শ্রফ) উদ্ধার করার জন্য সীতারূপী করিনা কপূরকে অপহরণ করেছেন।
এখান থেকেই ছবিটি যেন একটি নিটোল ‘চিত্র-গীতি আলেখ্য’ হয়ে ওঠে। এক দিকে রামায়ণের রাম-রাবণের গল্প আর অন্য দিকে আজকের বাজিরাও সিংহমের এগিয়ে চলা। পর্দায় প্রবল যুদ্ধ শুরু হয়। মারদাঙ্গার আধুনিক মারপ্যাঁচে দর্শক আবার তার আসনের সঙ্গে সেঁটে যান। এই মারাত্মক ‘অ্যাকশন’ ও আগুনের ফুলকির মধ্যেই হেলিকপ্টারে চড়ে অস্ত্র হাতে আবির্ভূত হন বীর সূর্যবংশী (অক্ষয়কুমার)। উন্মাদনার পারদ আরও এক ধাপ বাড়ে।
মারামারি, গোলাগুলি, গাড়ি-হেলিকপ্টারের উড়ে যাওয়া এবং আগুনের জ্বলন্ত শিখার মধ্যে ডুবে যান দর্শক। পর্দায় সত্যিই যেন আগুন জ্বলতে থাকে। ‘অ্যাকশন’-এর এই প্রবল উত্তাপে দর্শক যখন দিশাহারা, ঠিক তখনই এই ছবি আর ছবি হয়ে আটকে থাকে না। যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে তা যেন একটা জমাটি ‘ভিডিয়ো গেম’ হয়ে যায়।
কারণ, স্বীকার করতে হয়, অসাধারণ চিত্রগ্রহণ, গ্রাফিকের কাজ। ছবিতে ‘অ্যাকশন’ দৃশ্যেও বেশ নতুনত্ব রয়েছে, তবে যুক্তিবোধ নেই। জঙ্গি ওমর হাফিজের (জ্যাকি শ্রফ) ধরা পড়া, মীনাক্ষী মন্দিরে ডিসিপি শক্তি শেট্টির ‘অ্যাকশন’, রাবণরূপী ডেঞ্জার লঙ্কার আবির্ভাব এবং থানা জ্বালিয়ে তার শাগরেদদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া, হনুমানের মতো এসিপি সিম্বার (রণবীর সিংহ) ডেঞ্জার লঙ্কার ডেরায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দৃশ্য মনে না রেখে উপায় নেই।
ইদানীং হনুমানকে যে ভাবে রাগত রূপে দেখা যায়, বাঙালির কাছে তিনি তা ছিলেন না। বরং কৃত্তিবাসের কল্যাণে হনুমান ছিলেন হাস্যরস উদ্রেককারী। রোহিত কিন্তু সে পথেই হেঁটেছেন। গোটা ছবির উন্মত্ত হিংসার মাঝে ‘কমিক রিলিফ’ রণবীর সিংহ। এবং তিনিই চূড়ান্ত সফল। দর্শক মনোরঞ্জনের সেরা চালটি এখানেই চেলেছেন রোহিত।
অর্জুন কপূরের ডেঞ্জার লঙ্কা চরিত্রটি ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র। কিন্তু একটি ভয়ঙ্কর হাসি ও নির্দিষ্ট কয়েকটি অভিব্যক্তি ছাড়া, তাঁর আর কোনও ভাবই স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি তাঁর অভিনয়ে। বাকিদের কাছে নাটকীয় অভিনয়ের চাহিদা ছিল না বলেই হয়তো তাঁদের যথাযথ বলে ধরে নেওয়া যায়।
প্রচুর মশলা একসঙ্গে মিশিয়েও ‘সিংহম আগেন’-এ রান্নাটি ভাল করে উঠতে পারেননি রোহিত। কারণ গোড়ায় গলদ। সেই অর্থে কোনও গল্পই নেই। রামায়ণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দৃশ্য তৈরি করতে গিয়ে ছবিটি বেশ কিছু ঘটনার সঙ্কলন হয়ে উঠেছে মাত্র। চমকদার দৃশ্যের বাড়বাড়ন্ত এবং উপর্যুপরি মারামারির মধ্যে নাট্যমুহূর্ত খোয়া গিয়েছে। অসংলগ্ন চিত্রনাট্য শেষের দিকে ছবিটিকে আরও লঘু করে দিয়েছে।
চলচ্চিত্র নির্মাণ এক উৎকৃষ্ট মানের শিল্প। সেখানে জনপ্রিয় অভিনেতা, বিতর্কিত বিষয়, মহাকাব্যের মহতি চরিত্র এবং রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা থাকতেই পারে। কিন্তু ছবিটি তৈরি করতে গেলে শক্তসমর্থ কাহিনি, যুক্তিযুক্ত চিত্রনাট্য এবং নিটোল নাটকীয়তা রাখাও প্রয়োজন। রোহিত শেট্টির ‘পুলিশ ব্রহ্মাণ্ড’-এর মহাকাব্যিক ছবি ‘সিংহম আগেন’-এ সেই নাটকীয় সংঘাত আদৌ পাওয়া গেল কি না তা অবশ্য বলতে পারবেন দর্শক।