প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
অপরাধ হচ্ছে স্লো-মোশনে। অপরাধী হাঁটছে স্লো-মোশনে। পুলিশ দৌড়চ্ছে স্লো-মোশনে। অপরাধীকে শাস্তি দিচ্ছে স্লো মোশনে। ওপেনিং দৃশ্য থেকে নায়ক-খলনায়কের এনট্রি সিন এবং তার পরেও প্রায় আধ ডজন দৃশ্য— সবই স্লো মোশনে। সঙ্গে বেশ পা-নাচানো আবহসঙ্গীত। মানে ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’-এ ঠিক যেমন কিং খানের কোন কোন দৃশ্যে হলে হাততালি পড়তে পারে বা সিটি পড়তে পারে, সেই ভেবেই এডিট টেবিলে মুহূর্ত তৈরি করা হয়, এখানেও তাই। যাঁকে বলে প্রত্যেকটা দৃশ্যে ‘সোয়্যাগ’। তবে এ তো শুধু দক্ষিণী কায়দার নায়ক বা খলনায়কের সোয়্যাগ নয়। এ হল সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সোয়্যাগ। তাই কেতের পাশাপাশি এখানে রয়েছে বুদ্ধিও।
২০১১-এ মুক্তি পেয়েছিল ‘২২শে শ্রাবণ’। তাঁর এক বছর আগেই ‘অটোগ্রাফ’ কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিকে। আনকোরা নতুন পরিচালকের ছবি থেকে গান— সবই সুপারহিট। অনেকে অবশ্য সেটা ‘বিগিনার্স লাক’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘২২শে শ্রাবণ’ সেই সুযোগ আর দিল না। ফের ছবি থেকে গান, সবই সুপারহিট। এক ছবিতে একাধিক তারকা, টানটান থ্রিলার, জমাট প্রেম, মজাদার সংলাপ, টাটকা গান, সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্য— সৃজিত মুখোপাধ্যায় কে, এক ছবিতেই সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক। সেই ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত প্রবীর রায়চৌধুরী এতটাই বৈগ্রহিক চরিত্র হয়ে যায় যে নয় বছর পর যখন ‘২২শে শ্রাবণ’-এর সিকুয়েল ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ মুক্তি পায়, তখন প্রবীর না থেকেও নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। এ বার সেই সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির প্রিকুয়েল বানিয়েছেন পরিচালক। গল্পের প্রেক্ষাপট ‘২২শে শ্রাবণ’-এর আট-ন’বছর আগের। সঙ্গে তিনি জুড়েছেন নিজের আর এক সফল ছবি ‘ভিঞ্চি দা’কেও। দুই মিলিয়ে তৈরি করেছেন বাংলার প্রথম কপ ইউনিভার্স। সহজ ভাবে বললে যা বোঝায়, দুই ছবির দুই দুঁদে পুলিশ অফিসার এক ছবিতে এসে একসঙ্গে কেসের সমাধান করবে। যে হেতু কপ ইউনিভার্স বলতে দর্শকের ‘সিংহম’ মার্কা একগুচ্ছ বলিউড ছবির কথা মনে পড়ে, তাই পরিচালক ভালই বুঝেছিলেন, এই ছবি হিট করতে হলে সোয়্যাগ চাই। তবে, শুধু কয়েকটা ভিএফএক্স-এর অ্যাকশন দৃশ্য আর স্লো মোশন বসিয়ে তো টলিউডের ‘ফার্স্ট বয়’ সোয়্যাগ তৈরি করে না। তিনি সোয়্যাগ তৈরি করেন মারকাটারি সংলাপে, নস্ট্যালজিয়া উস্কে, ব্রোম্যান্স তৈরি করে এবং দর্শকের মগজাস্ত্রে খানিক শান দিয়ে। তাই এই ছবি দেখলে ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’ প্রেমীরা যেমন খুশি হবেন, তেমনই তুষ্ট হবেন সৃজিতভক্তেরা। কারণ, ইতিহাস, পুরাণ, কবিতা, সাহিত্য, থ্রিলারের শেষে টুইস্ট— সৃজিতের চিত্রনাট্য থেকে যা যা তাঁর দর্শক আশা করেন, সেগুলো সবই রয়েছে।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘দশম অবতার সৃজিতের ফর্মের ছবি।’’ পরিচালকের শেষ কয়েকটা ছবি যতই অন্য রকম হোক, বক্স অফিসে সে ভাবে সফল হয়নি। যদি বক্স অফিসের নিরিখেই ফর্ম মাপা হয়, তা হলে এই ছবি অবশ্যই সৃজিতের ফর্মের। কারণ, হলে দর্শক টানার জন্য যা যা উপাদান প্রয়োজন, সবই রেখেছেন পরিচালক। তবে তাঁকে ফর্মে ফিরতে সাহায্য করেছেন অবশ্যই তাঁর অভিনেতারা। প্রবীর রায়চৌধুরী আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে এখন আর আলাদা করা যায় না। ‘দশম অবতার’-এর প্রবীর কিন্তু ‘২২শে শ্রাবণ’-এর প্রবীরের চেয়ে আলাদা। ‘২২শে শ্রাবণ’-এর প্রবীর অবশ্যই ক্ষুরধার ছিল। তবে সেটা বেশির ভাগই বুদ্ধিতে। ‘দশম অবতার’-এর প্রবীর ডিপার্টমেন্টের সেরা অফিসারদের মধ্যে অন্যতম। মুখের পাশাপাশি তার হাত-পা-ও দুরন্ত। ১২ বছর আগের ছবির প্রিকুয়েল। মানে সব মিলিয়ে ২০ বছর বয়সটা কমিয়ে ফেলতে হয়েছিল প্রসেনজিৎকে। তিনি যে কতটা অনায়াসে তা করতে পেরেছেন, সেটা চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল। কাঁচা খিস্তি দিতে দিতে যিনি অবলীলায় বেদ-উপনিষদ আওড়াতে পারেন এবং দুটোই সমান সাবলীল ভাবে পর্দায় তুলে ধরতে পারেন, তিনি অবশ্যই পরিচালকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
এখানে খলনায়কের চরিত্রে রয়েছেন যিশু সেনগুপ্ত। এই থ্রিলার ‘হু ডান ইট’ নয়। তাই প্রথম থেকেই দর্শক জানেন, তিনিই সিরিয়াল কিলার। এই ফর্ম্যাটে চরিত্র উপস্থাপনা সবচেয়ে জরুরি। খলনায়ককে পর্দায় দেখলেই যাতে দর্শক শিউরে ওঠেন, সেটা নিশ্চিত করা চিত্রনাট্যের কাজ। এ ক্ষেত্রে আরও অনেকটা অবকাশ ছিল বলে মনে হয়। তবে, খলনায়কের চেহারায় যদি নৃশংসতা ফুটে না ওঠে, তা হলে সেটা অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলাই অভিনেতার মূল লক্ষ্য। এখানেই অভিনেতা হিসাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন যিশু।
ছবির অভিনেত্রী জয়া আহসান। একমাত্র নারী চরিত্র। তাঁর কাজটা বোধ হয় সবচেয়ে কঠিন ছিল। প্রবীর আর পোদ্দারের যুগলবন্দি দেখতেই ব্যস্ত দর্শক। তাদের সংলাপে একের পর এক বাউন্ডারি। তার মধ্যে পরিচালক চিত্রনাট্যে ভরে ভরে আগের ছবিগুলোর রেফারেন্স ঢুকিয়েছেন। একটা ধরতে না ধরতেই পরিচালকের অন্য বাউন্সার তৈরি। সে সব থেকে ফুরসত পেলে যিশুর কাণ্ডকারখানা ব্যস্ত রাখবে দর্শককে। এত কিছুর মাঝে জায়গা করে নিতে হয়েছে জয়াকে। এবং তিনি সেটা দিব্যি পেরেছেন। এক ইঞ্চিও নিজের জমি ছাড়েননি। দর্শক যাতে হল থেকে বেরিয়ে তাঁকে মনে রাখেন, তা নিশ্চিত করেছেন জয়া।
সব শেষে আসা যাক পোদ্দারের কথায়। ‘ভিঞ্চি দা’-এ পোদ্দারকে দেখে যাঁদের মন ভরেনি, তাঁরা এখানে মন ভরিয়ে নিতে পারেন। গোটা ছবি জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। রাগ-দুঃখ-অভিমান, সব দৃশ্যেই তিনি এতটা সাবলীল যে, দর্শক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকবেন, কখন আবার পর্দায় পোদ্দার আসবে। প্রসেনজিতের সঙ্গে তাঁর প্রথম দৃশ্য, মত্ত অবস্থায় জয়ার সঙ্গে একটি দৃশ্য এবং ক্লাইম্যাক্স দেখলেই বোঝা যাবে, কেন এই মুহূর্তে তিনি টলিউডের সবচেয়ে ব্যস্ত অভিনেতা।
চিত্রনাট্য জুড়ে সৃজিত নিজের সিগনেচার ফেলে গিয়েছেন। ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর খোকা এবং ‘ভিঞ্চি দা’র পোদ্দার দু’জনেই কী করে একই অভিনেতা হতে পারেন বলে যাঁরা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, পরিচালক তাঁদেরকেও জবাব দিয়েছেন। কারণ, কোনও রকম কাঁচা কাজ তিনি করেন না। তবে, থ্রিলার হিসাবে ‘২২শে শ্রাবণ’ অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। এখানে যে হেতু প্রথম থেকেই খলনায়ককে জানা, তাই চিত্রনাট্য জুড়ে চমক কম। প্রথমার্ধে সোয়্যাগ হয়েছে। কিন্তু, ‘কী হবে-কী হবে’ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়নি। যে হেতু সে ভাবে রহস্য নেই এই ফর্ম্যাটে, তাই সাসপেন্স কম। এ ক্ষেত্রে চোর-পুলিশের টান টান খেলাটা ঠিক জমেনি। দ্বিতীয়ার্ধ সেটা অনেকটা ফিরে আসে। তবে সৃজিতের চেনা দর্শক, তাঁর চালগুলো অনেকটা আন্দাজ করতে পারেন এত দিনে। মন দিয়ে দেখলে শেষের টুইস্ট অনেক আগে থেকেই ধরে ফেলা যাবে। ‘২২শে শ্রাবণে’ সেই সুযোগ একটু কম ছিল।
আরও একটা জায়গায় ‘২২শে শ্রাবণ’ এগিয়ে থাকবে। থ্রিলারের পাশাপাশি সেখানে একটা মিষ্টি প্রেমের গল্পও ছিল। অনির্বাণ-জয়াকে জুটি হিসাবে দেখতে যতই সুন্দর লাগুক, ছবিতে তাঁদের প্রেমটা বড্ড হুট করে হয়ে গেল যেন। আগের ছবিতে প্রেমের গল্পটাও জমিয়ে বলেছিলেন পরিচালক। তাই এই ছবি দেখতে দেখতে পরমব্রত (চট্টোপাধ্যায়)-রাইমাকে দর্শক মিস্ করতে বাধ্য। বিশেষ করে ধূমপান নিয়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ যখন ছবির শুরুতে আর বিরতির পর পরমব্রতেরই কণ্ঠে শোনা যায়।
ছবির গান ভাল। বিশেষ করে অনুপম রায়ের ‘আমি সেই মানুষটা আর নেই’-এর সুর উস্কে দেবে পুরনো স্মৃতি। তবে ‘২২শে শ্রাবণ’-এর গানগুলোর মতো ১২ বছর পরও মনে রাখার মতো কি? সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। নিজের সৃষ্ট একাধিক ছবি মিলিয়ে ইউনিভার্স তৈরি করা আরও কঠিন। ধরে নেওয়া যাক সেই ইউনিভার্সের এটা প্রথম ছবি। ছবির শেষই জানান দেবে, আরও গল্প আসছে। তাই এ ছবিকে গ্রাউন্ডওয়ার্ক হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। তাই আশা করাই যায়, এর পরের ছবিগুলো থেকে থ্রিলারপ্রেমীদেরও তুষ্ট করতে পারবেন পরিচালক।