কেমন হল ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’? ছবি: সংগৃহীত।
ওটিটির বাড়বাড়ন্তের এই যুগে সব প্ল্যাটফর্মেই রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ়ের জোয়ার আজকাল। তো এমনতর অবস্থায় এই বঙ্গের ‘হইচই’-ই বা বাদ যাবে কোন দুখে? সুতরাং সেই প্ল্যাটফর্মে এপ্রিলের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া সাত পর্বের সিরিজ় ‘অ্যাডিভি অচিন্ত্য আইচ’ বা সোজা বাংলায় ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ সিরিজ়টিও ঠিক সেই মোড়কেই তৈরি। দর্শক যখন এটিই খাচ্ছে তখন তাকে এমনই খাবার আরও বেশি করে, নানা মোড়কে জুগিয়ে যাও। বিক্রি আর জনপ্রিয়তা দুই-ই সহজে আসবে, এই গ্যারান্টি এই মুহূর্তে একেবারে যাকে বলে বাজারের সারসত্য। লাভজনক ব্যবসা করার লক্ষ্যে কেউ কখনও ঝুঁকি নেওয়ার বোকামো করে, শুনেছেন কখনও!
সুতরাং সম্পর্কের নাটক, মানবতার নাটক চুলোয় যাক, চালাও পানসি রহস্য -রোমাঞ্চ। তার মধ্যে যদি
প্রয়োজন হয়, তবেই আসতে পারে মানবিক মুহূর্ত, বা নাটকীয় ছোঁয়া। আর এই রকম সৃজন চাইলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সহজলভ্য টালিগঞ্জ পরিচালক হলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। আজ পর্যন্ত তাঁর এমন কোনও কাজ এই প্রতিবেদকের চোখে পড়েনি, যা উত্তেজনা বর্জিত। সেই ২০২২ সাল থেকে তিনি একের পর এক দু’টি একেনবাবু ছবি নামিয়েছেন। এবং সেগুলি বেশ জমাটিই ছিল। ২০২৪ -এ তাঁর ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ সিরিজটিও সেই গোত্রের।
বহু শতাব্দী আগে মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “আসলে এই দুনিয়ায় কোনও মৌলিক চিন্তা সম্ভবই নয়। যা কিছু আমরা সৃষ্টি করি, তা আসলে অনেক আগেই সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।” ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’-এর গল্পেও আসলে কোনও মৌলিক কাহিনি নেই। সেই রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের জয়, বা ডেভিড-গোলিয়াথের গল্পে অসীম শক্তিশালী গোলিয়াথের, ডেভিডের হাতে মৃত্যুর গল্পই এখানেও আছে। কেবল এখানে গোলিয়াথের নাম পাল্টে হয়ে গিয়েছে সীতারাম গঙ্গোপাধ্যায় বা গাঙ্গুলি (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) আর ডেভিডের নাম হয়েছে অচিন্ত্য আইচ (ঋত্বিক চক্রবর্তী)। দু’জনেই সিরিজ়ে আদতে আইন ব্যবসায়ী। মানে উকিল। সীতারাম সফল, বিখ্যাত এবং প্রবল প্রতাপশালী। অচিন্ত্য ব্যর্থ, ভিতু এবং নির্জীব– ছোটবেলা থেকেই আত্মসম্মানবোধহীন। সেই ব্যর্থ অচিন্ত্যই যখন শেষে আদালতে সীতারামকে ধুলোয় মিশিয়ে মামলা জিতে বেরিয়ে আসে, তখন আসলে যেটা হয়, তা হল দর্শকের আনন্দ, তার জীবনের সব ব্যর্থতার অবসানবোধ এবং সে-ও যে একদিন জীবনে জিততে পারবে, সেই আশার উদ্রেক। এটা দর্শক মনোবাঞ্ছা পূরণের জমাটি ‘ফর্মুলা’। সফল হবেই। এবং প্রথম দর্শনে এই প্রতিবেদকেরও ভাল লেগেছে। আরে মশাই , যুগ যুগ ধরে যে গল্পের কাঠামো লাখ-লাখ শ্রোতা-দর্শকের মন জুগিয়ে এসেছে, সেই ফর্মুলা এই সামান্য প্রতিবেদকের মন জয় করবে না, তা কি হয়? সে কারণেই হলফ করে বলে দেওয়া যায় ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ও সফল হবে এই বাজারে। চারিদিকে বড় ব্যর্থতা, বড় কষ্ট। সামান্য ইচ্ছেপূরণ হোক না। এও তো এক ভাবে মানবতার উত্সব!
জয়দীপবাবুর একটা গুণ লক্ষ করা গেল– বাজারচলতি তারকা না নিয়ে একটি বাংলা সিরিজে ভাল অভিনেতা নেওয়ার প্রচেষ্টা। শাশ্বত, ঋত্বিক, দুলাল, সুরঙ্গনাকে একত্র করা। এঁদের মুখোমুখি দৃশ্যগুলি বেশ লাগে। ঋত্বিক, শাশ্বতের অভিনয় নিয়ে নতুন করে সুখ্যাতির কোনও প্রয়োজন নেই। ওঁরা পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত ভাল অভিনেতা। ভাল লাগে গীতা রূপে খেয়া চট্টোপাধ্যায়ের বা লক্ষ্মণ ভীম সর্দার চরিত্রে দেবরাজ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। আর একটা কথা না বললেই নয়। সেই ২০১৫-য় ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবিতে একটি মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনয়। তখন বড় ক্ষীণদেহী ছিলেন তিনি। ২০২৪-এ এসে তিনি যেন লক্ষ্মীপ্রতিমা। ভারী ঢলঢলে রূপের অধিকারিণী হয়েছেন তিনি এখন। তাই সিরিজ়ে খুনের নির্দোষ অভিযুক্ত হিসেবে সুরঙ্গনা ওই রূপের জোরেই দর্শকের সহানুভূতি টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন প্রথম থেকেই। আর অভিনয়টা তিনি বরাবরই দুরন্ত করেন। তার উপর চিত্রনাট্যে তাঁর মুখে সংলাপ অল্প। কেবল পটলচেরা চোখ দুটো দিয়েই সিংহভাগ অভিনয় করে গিয়েছেন তিনি। হয়তো ঋত্বিক-শাশ্বতকেও কিছু কিছু জায়গায় ছাপিয়ে গিয়েছেন।
সিরিজটি রহস্যের। তাই গল্পের একবর্ণও বলার প্রয়োজন মনে করি না। সেটা না হয় কষ্ট করে দেখেই নেবেন দর্শক। সিরিজ দেখতে তো আর তোড়জোড় করে হলে পৌঁছতে হবে না।
শেষে একটি কথা সংলাপলেখকের জন্য। ঘটি বাংলায় ‘ওনাকে’ বলে কোনও শব্দ নেই। যদিও এটা অনস্বীকার্য, আজকাল এই শহরে প্রায় সবাই ‘ওনাকে’ শব্দটি ব্যবহার করেন, স্বকর্ণে শোনা। কিন্তু ভুলটা ভুলই। ‘ওনাকে’ ও পার বাংলায় বহু ব্যবহৃত বাচনভঙ্গি। এই বিষয়টি মাথায় রাখলে দর্শক-কর্ণের আরাম হবে ভবিষ্যতে, আশা করা যায়।