Alaap Movie Review

মিলন হবে কত দিনে! জেন-জ়ি’রাও কি অমোঘ প্রশ্নের উত্তর জানে?

প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী পরিচালিত ‘আলাপ’ ছবিটি দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৭
review of Abir Chatterji-Mimi Chakravorty starrer bangla movie

‘আলাপ’ ছবির একটি দৃশ্যে আবীর এবং স্বস্তিকা। ছবি: সংগৃহীত।

সদ্য মুক্তি পেয়েছে প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী পরিচালিত প্রেমের ছবি ‘আলাপ’। এই প্রবল গরমে এ হেন প্রেমের ছবির বেশ কিছু পোস্টারে অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় ও মিমি চক্রবর্তীকে আলাপরত অবস্থায় দেখাও যাচ্ছে ইতিউতি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন প্রেম স্রেফ হরমোনের খেলা। কিন্তু সে ছিল সেকেলে প্রেম। আজকের জেন-জেড ‘প্রেম’ করে না। তারা ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘ঘোস্টিং’, ‘বেঞ্চিং’, ‘লাভ-বোম্বিং’, ‘কুকি জারিং’, ‘অরবিটিং’ ইত্যাদি নানা নাম দিয়েছে প্রেমের। এ সবের সঙ্গে পূর্বরাগ মায় চিরকুট চালাচালির মতো সেকেলে প্রেম-থিয়োরির অনেক দূরত্ব। ফেসবুক, হোয়াট্‌স্যাপে চাইলে প্রেমের অপশন অসংখ্য। ‘ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট’-এর জমানায় কি আর নীরাকে বাসস্টপে তিন মিনিট দেখার জন্য কাঙাল হবেন নাগরিক কবি? বা ২৪৪-১১৩৯ নম্বরে ফোন করে কি কেঁদে ভাসাবেন আর কোনও প্রেমিক?

Advertisement

এই সব একরাশ প্রশ্ন নিয়েই সাউথ সিটির আইনক্সে হাজির হলাম ‘আলাপ’ দেখতে। প্রবল গরমেও দেখলাম মলের বাইরের ফোয়ারার পাশে বসে আছে কলেজের ছেলেমেয়েরা। তখন বিকেল। তাঁরা কি ‘সিচুয়েশনশিপ’ করছে না ‘বেঞ্চিং’? ভাবতে ভাবতেই পর্দায় আবীর আর মিমি হাজির। তার সঙ্গে হাজির সেক্টর ফাইভ আর নিউ টাউন। শহর আধুনিক হয়েছে। আইটি সেক্টরের কলকাতার দুই চরিত্র নিয়েই এ ছবি। একটি ফ্ল্যাট ভাড়াকে কেন্দ্র করে তাদের ‘আলাপ’ ঘিরেই জমতে থাকে গল্প। নতুন কলকাতা দেখাতে গিয়ে পরিচালক ভোলেন না তাঁদের প্রতিবেশী একা বেঁচে থাকা বয়স্কা মহিলাকেও (ছবিতে ভদ্রা বসুর অভিনয়ে)। ছবির পরতে পরতে এই বয়স্কা মিশে যান আজকের প্রজন্মের সঙ্গে। চিত্রনাট্যে বড় সুন্দর করে তাঁকে রেখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। এককালে হয়তো এই বয়স্কার নিবাস ছিল ভবানীপুর বা তালতলা। নিউ টাউনের ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটে গিয়েও তাই প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের বাচ্চা হয়েছে কি না বা টিভির রিমোট বা গ্যাস বুক করার জন্য চিন্তার শেষ নেই তাঁর...

review of Abir Chatterji-Mimi Chakravorty starrer bangla movie

‘আলাপ’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

আইটি সেক্টর আমাদের জীবন শিফ্‌টে ভাগ করে দিয়েছে। কর্পোরেট সংস্কৃতি দিনে আর রাতে আমাদের প্রবল ব্যস্ত রেখেছে। এতই ব্যস্ত যে, মাঝেমাঝে বুকের বাঁ দিকে গাবগুবাগুব করছে কি না কারও জন্য, তার সঙ্গে ‘আলাপ’ হবে কি আদৌ, এ সব প্রশ্ন করার চেয়ে ‘গোল’ অর্থাৎ লক্ষ্য ‘সেট’ করা অনেক জরুরি আজকের দিনে। কিছু বছর আগে আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা যাওয়ার মাঝে’তে এই সমস্যার চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়েছিল। এ ছবি তাকেই অন্যতর হালকা চেহারায় দেখায়। কিন্তু জীবনকে এড়িয়ে দেখায় না। তাই এ ছবিতে পরিচালক ভিড় বাস দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন অটোর লম্বা লাইন শোভাবাজার মেট্রোর কাছে, দেখিয়েছেন আবীর অভিনীত চরিত্রটির মা-বাবার প্রতি চিন্তার কথা। কোনওটাই আরোপ করেননি। দু’ঘণ্টার এ ছবির গল্পে সহজ ভাবেই ধরা দিয়েছে সবটা। যেমন আমাদের জীবনেও মায়েরা ‘নাইট শিফ্‌ট’ সেরে আসা মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন রাতভোর, মুখে ভাত তোলেন না, সন্তান না খেলে। যেমন অল্প বয়সে ছেলে একাধিক শহর দেখে ফেলার পরেও, তাঁর ‘বিয়ের বয়স’-এ ছটফট করতে থাকেন বাবা-মা, তাঁদের ভয় সন্তান একা হয়ে যাবে! কে দেখবে তাকে! যেমন, আজও যৌনতার হরেক উপাদান পেয়েও আমরা সেই সেকেলে আঁতেল প্রেমিকই থেকে যাই, যে নাকি বিশ্বাস করে, ঠিক একদিন আসবে স্বপ্নের প্রেমিকা, আসবেই।

review of Abir Chatterji-Mimi Chakravorty starrer bangla movie

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

হয়তো এই সব বোকা-বোকা। তবু এ সব বাদ দিয়ে কিন্তু জেন-জ়ি নয়। তাই এই সবই মিলে গিয়েছে এ ছবিতে। তার সঙ্গে মিলে গিয়েছে তাদের প্রেমও। যেখানে আজও অপেক্ষা নামের শব্দটা টুং হোয়াট্‌সঅ্যাপ কেড়ে নিতে পারেনি। তাই ছবি জুড়ে এই অপেক্ষা দেখতে দেখতে আমাদেরও আশা জাগে। বারে বারে মনে হয়, এ বারে আবীর আর মিমির দেখা হোক। বন্ধু যখন বলে, ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে নায়ক-নায়িকার আলাপের বিষয়টা, তখন মনে পড়ে, আজকের প্রজন্মও তো কত ভাবে ভাগ্যের ওপরেই নির্ভরশীল প্রেমের বিষয়ে। আমরা আজ বলি, ‘কসমিক কানেক্ট’। বলি, কর্মফল। আমাদের সেক্টর ফাইভ বা আইটি সেক্টর তো এ সব কেড়ে নিতে পারেনি। বরং যত আপাত চকচকে জীবন বাড়ছে ও ধাক্কা খাচ্ছি আমরা, তত ভাগ্য-নির্ভরতাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের।

ছবিটা দেখতে ভাল লাগে কারণ, এই সব কিছুকেই ভাল-খারাপের পাল্লায় না চড়িয়ে, পরপর সাজিয়েছে এ ছবি। সাজিয়েছে ইতিবাচক ভাবে। নিউ টাউন চত্বরে ফ্ল্যাটের দালাল যেখানে দু’চার পয়সার জন্য যাকে-তাকে ফ্ল্যাট যে কোনও শর্তে গছিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। ছেলেদের ফ্ল্যাটে একটি মেয়ে ঢুকে পড়লেও, সে ‘ম্যানেজ’ করে দিতে পারে লহমায় সব। কিন্তু জীবন ম্যানেজ করা সহজ না, তাই আবীরের সঙ্গে কিছুতেই দেখা হয়ে ওঠে না মিমির। বন্ধু বলে, ভাগ্য নাকি ইশারা পাঠায়। কী সেই ইশারা? রাস্তায় ধাক্কা না কি অফিসের পার্টিতে মুখোমুখি হওয়া? কে জানে! আমাদের মতো আবীরও তাই ‘ধুর’ বলে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বই বা ওয়েব সিরিজ়েই ঢুকে যায় প্রেমটেমের ঝামেলা এড়িয়ে...

কিন্তু গন্ধ! এ এক আজব ইন্দ্রিয়! স্মৃতির মতো নাছোড়। তাই আমরা যখন ধরেই নিলাম আবীর হয়তো বাবা-মায়ের দেখে দেওয়া মেয়েকেই বিয়ে করবে, তখনই খেলা ঘুরে যায়। আবার নায়ক-নায়িকার নিশ্চিত আলাপের গল্পও হয় না এ ছবি। কিন্তু কী সে টুইস্ট, তা এ লেখায় বলা হবে না। তার জন্য ছবিটি দেখতে হবে। তবে, পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার চাইলেই সেটা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা নিটোল প্রেমের গল্প বলতে চাননি। চেয়েছেন আজকের অনিশ্চয়তাকেও ধরতে। কারণ কয়েক সেকেন্ডে আজ আমরা চাইলেই দিল্লি-বেঙ্গালুরুতে চাকরি নিয়ে চলে যেতে পারি। চাইলেই পারি ভাগ্যকেও নিজের হাতের তালুতে নাচাতে...

এ ছবি আসলে বলে এক সহজ প্রেমের গল্প, যা একদা বাংলা ছবির সম্পদ ছিল। এবং সমাজকে এড়িয়েও তা বলে না। যে সমাজে বহু মানুষ একা, সমস্যায় জড়িয়ে, সেখানে নিটোল প্রেম এক বিরল প্রজাতির পাখি। সে সমস্যাকে যেমন এড়ায় না এ ছবি, তেমনি তা বলে আবার ভারাক্রান্তও করে না। এখানেই এ ছবির জোর। ছবিতে আবীর চট্টোপাধ্যায়, মিমি চক্রবর্তী ছাড়াও ভাল লাগে বয়স্কা প্রতিবেশী ভদ্রা বসুর অভিনয়। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়র আবহ আর অনুপম রায়ের গানগুলিও বেশ ভাল। শুধু একটা লাইন কেমন কানে লাগল— ‘আমি যুক্তরাষ্ট্র হলে, তুমি রাশিয়া কিংবা চিন/ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকুক চিরদিন।’ রাশিয়া বা চিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা ইতিহাসে খুব প্রেমময় নয়। বরং হিংস্রতার। তাই ওই একটি লাইন যেন মেনে নেওয়া গেল না ছবিটির সুরের সঙ্গে। বাকি ‘আলাপ’ ঝক্কাস!

আরও পড়ুন
Advertisement