কেমন হল ইমতিয়াজ় আলির নতুন ছবি ‘অমর সিংহ চমকিলা’? ছবি: সংগৃহীত।
ইমতিয়াজ় আলির নতুন ছবি ‘অমর সিংহ চমকিলা’ কিছু দিন আগেই একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে। তার পর থেকে সেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ‘ট্রেন্ডিং’য়ে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে ছবিটি। এ ছবিটি মূলত ‘পঞ্জাবের এলভিস প্রিসলি’ অভিধায় অভিষিক্ত গায়ক অমর সিংহ চমকিলার ‘বায়োপিক’। পঞ্জাবের অনামা গ্রামের অতিসাধারণ এক গায়ক অমর সিংহের প্রবাদ হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন ইমতিয়াজ়। এবং তার পর দেখিয়েছেন দুষ্কৃতীদের হাতে তাঁর ও তাঁর স্ত্রী অমরজ্যোতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। ছবিটি দেখতে দেখতে মনে পড়ল, অতি সম্প্রতি খ্যাতনামা লেখক সলমন রুশদির চোখে ছুরি চালানোর ঘটনা। তাঁরও এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। সদ্য প্রকাশিত ‘নাইফ’ বইতে রুশদি স্মরণ করেছেন সে ঘটনা। অর্থাৎ আটের দশকের অমর সিংহ চমকিলা থেকে আজকের সলমন রুশদি— শিল্পীদের আক্রান্ত হওয়ার ধারা অব্যাহত। অভিনয় চলাকালীন নাট্যকার ও পরিচালক সফদর হাশমির মৃত্যুও এ প্রসঙ্গে মাথায় আসে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, তাতে কি আটকানো যায় শিল্প? কন্ঠরোধ করা যায় শিল্পীর?
যুগে যুগে সঙ্গীত তৈরি করে সমাজের কোপে পড়েছেন শিল্পীরা। কখনও গিটার বাজিয়ে বা কখনও র্যাপ গান তৈরি করে শাসকের চোখে চোখ রেখেছেন তাঁরা। মনে পড়ছে, চিলির সঙ্গীতকার ভিক্তর হারার কথা। নির্মম ভাবে তাঁকে খুন করে ফ্যাসিস্ট শাসক। কিছু দিন আগে ‘গলি বয়’ ছবিতে দেখেছি, সমাজের নিচুতলার ভাষা ভদ্রতার সীমা ভেঙে কী ভাবে গানের বাণী হয়ে উঠছে। অমর সিংহ চমকিলার গল্প দেখতে দেখতে এই সমস্ত কথাই মনে পড়ছিল। প্রতিবাদের গান থেকে হালফিলের র্যাপ গান, যাবতীয় গানকেই যেন ‘ট্রিবিউট’ জানায় ইমতিয়াজ়ের এই ছবি।
পরিচালক এই ছবি প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, এক জন শিল্পীর গানের ভাষা কী হবে, তা কে ঠিক করবে? সমাজ, না শিল্পী? এই প্রশ্নটাই ঘুরেফিরে আসে অমর সিংহ নামের এই অতি সাধারণ মোজার কারখানায় (বাস্তব মানুষটি ইলেকট্র্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন) কাজ করা মানুষটির ক্ষেত্রে। তাঁকে ‘চমকিলা’ নামে এক কিংবদন্তি বানানো হয়। আর পাঁচজনের থেকে একজন শিল্পীর ফারাক তো এখানেই যে, তিনি সমাজের নিয়ম মেনে নেন না। নিজে নিয়ম তৈরি করেন। চমকিলাও মেনে নেননি সমাজের রক্ষণশীলদের অনুশাসন। তাঁর গান ধীরে ধীরে যত জনপ্রিয় হয়েছে, তিনি অগ্রাহ্য করেছেন সমাজ সংঠকদের প্রতাপ। গ্রামের মোড়লদের অনুশাসন ভেঙে তিনি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছেন এবং বার বার পঞ্জাবের নানা শ্রেণির ক্ষমতাবানদের পাত্তা না দিয়ে, তাঁর গান গাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, গানই তাঁকে তিলে তিলে পঞ্জাবের অতিসাধারণ জনপদ থেকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গিয়েছে। মানুষের মুখের ভাষাকে সংশোধন না করে লিখে গিয়েছেন তিনি। তাতে ভরে দিয়েছেন পথচলতি মানুষের সুর। সেখানেই তাঁর গান হয়ে গিয়েছে মানুষের গান। কী অদ্ভুত সমাপতন, তাঁর শৈশবের ‘আইডল’ অমিতাভ বচ্চনের থেকে ‘পঞ্জাবের এলভিস’ অমর সিংহ জীবিতাবস্থাতেই হয়ে উঠেছেন বেশি বিখ্যাত। এ কথা ছবিতে স্বীকারও করেছেন প্রবাসী এক সংগঠক। ফলে, তাঁকে তো দাম দিতেই হবে! তাই ভয় রিপুটাকেই উপড়ে ফেলেছেন তিনি ছবির শেষে। তাই, গোঁড়া রক্ষণশীল চরমপন্থী পঞ্জাবি সমাজ বাধ্য হয়েছে তাঁকে আটকাতে। কিন্তু তাঁর চোখে ছিল জেদ প্রথম দিন থেকেই। তবে, তাঁর গানগুলোকে কি খুন করা গেল তার পরও?
ছবির সময়কালের দিকে তাকালে অনুমান করা যায়, কাছাকাছি সময়ে পঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেঁধেছে খলিস্তানি আন্দোলনের নামে। অনুমান, খলিস্তানি জঙ্গিদের হাতেই গুলিবিদ্ধ হন অমর সিংহ ও তাঁর স্ত্রী। যদিও এই মৃত্যুরহস্যের কিনারা আজ অবধি হয়নি। ইমতিয়াজ় গতানুগতিক বায়োপিকের বদলে এ ছবিতে অ্যানিমেশন ও স্থিরচিত্র ব্যবহার করে ছবির চলন আগে-পরে করেছেন। তাই ছবিটির প্রত্যেকটি ফ্রেম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অমর সিংহ চমকিলার গান এতটাই জনপ্রিয় ছিল পঞ্জাবের প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায়, যে তা শুনতে পুরনো বাড়ির ছাদে উঠে পড়তেন মহিলারাও। সে ভাবেই একদিন ভেঙে পড়ে একটি বাড়ির ছাদ। বেশ কয়েক জন আহত হন। ছোট ছোট এই সব তথ্য এত যত্নের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন পরিচালক যে, তা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে ছবিটিকে। রক্ষণশীলদের কোপে পড়ে অমর সিংহকে ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধক গান গাইতে বাধ্য হতে হয় একদিন, কিন্তু তা মানুষকে স্পর্শ করে না। তারা বার বার শুনতে চায় চটুল সেই পুরনো জনপ্রিয় গানগুলিই, তা সে পাড়ার জমায়েত হোক বা বিয়ের আসর। প্রবল ভিড়ের মধ্যে শ্রোতাদের সামনে কিন্তু সে গান যাবতীয় সাহস সঞ্চয় করে গেয়ে ওঠেন অমর আবারও।
অমর সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন গায়ক-অভিনেতা দিলজিৎ দোসাঞ্জ, এবং তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর ভূমিকায় পরিণীতি চোপড়া। দিলজিৎ এ প্রজন্মের একজন নিয়মিত গায়ক হওয়ায় এ চরিত্রটিতে তাঁকে অত্যন্ত স্বাভাবিক লাগে। বাবাকে এসে যখন তিনি জানান, গানকেই পেশা করবেন এবং দামি মদের জোগান তাতে থামবে না বা নিজের গুরুস্থানীয় শিল্পীর থেকে যখন ধীরে ধীরে তাঁর কদর বাড়তে থাকে, তখনও চোখে নিজের স্বাভাবিক অতীত জীবনকে না ভোলার ছাপ তাঁর চেহারায় বার বার ধরা পড়ে। তাই তুলনায় বেশি খ্যাত অভিনেত্রী হলেও, পরিণীতির সঙ্গে তাঁর যৌথ গান উপস্থাপনা বা তাঁকে ঘিরে প্রেম একটুও অস্বাভাবিক লাগে না। ইমতিয়াজ়ের ছবির সবচেয়ে বড় গুণ, গল্পকে বৌদ্ধিক করার বদলে তিনি আন্তরিক করায় বিশ্বাসী। এ ছবিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অমর সিংহ চমকিলার অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য গান এ ছবিতে আবার বেজে উঠল বহু দিন পর। ইতিহাসে ধরা থাকল গানগুলি । আজকের সিনেমায় বা সিরিজ়ে গ্রাম তো প্রায় মুছেই গিয়েছে, এ ছবিতে যে ভাবে পঞ্জাবের বিশদ গ্রামীণ জীবন দেখানো হয়েছে, তা বড় ভাল লাগে। তাই অজ পাড়াগাঁয়ের এক ‘কমনম্যান’-এর গল্পের মধ্যে দিয়ে আর এক বার মানুষের হারানো সহজ বিশ্বাসকেই ফিরিয়ে এনেছেন পরিচালক। কারণ, সত্তর-আশির দশকের চরমপন্থা আজ আরও প্রবল চেহারা নিয়েছে সারা দেশেই। আর, আজকের অমর সিংহদের উপর নিষেধাজ্ঞাও বাড়তে-বাড়তে আকছার খুন করে দেওয়া তো জলভাত, রাষ্ট্রীয় কোপ এমনই! এ ছবি তাই চুপিচুপি বলে গেল একটা সাহসের কথা, যা থাকলে রাষ্ট্র বা মিডিয়া কেউই শিল্পীকে চেপে রাখতে পারে না। বারুদের মতো দুম করে ফেটে তা চমকিলা হয়ে চমকে দেবেই যুগ যুগ ধরে। বলবে, একটা বিরাট বড় ‘না’। অর্থাৎ, ‘মেনে নিলাম না’।