Nayan Rahashya Movie Review

ছোটবেলার গল্পের পুরো আমেজ পাওয়া গেল না, তবু রায়বাড়ির ঐতিহ্য অবিকৃতই রইল

সন্দীপ রায় পরিচালিত ফেলুদা-কাহিনি, ‘নয়ন রহস্য’ দেখল আনন্দবাজার অনলাইন

Advertisement
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৪ ১৯:৪৮
Review of Bengali film Nayan Rahashya directed by Sandip

‘নয়ন রহস্য’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, আয়ুষ দাস এবং অভিজিৎ গুহ। ছবি: সংগৃহীত।

আবার একটা ফেলুদার ছবি শুনলেই আজকাল ভয় করে। সিনেমা, ওটিটি মিলে যে হারে ফেলুদা বানাতে লেগে পড়েছেন সবাই, সমাজমাধ্যমের সেই ‘মিম’টাই মনে পড়ে বার বার, যেখানে সত্যজিৎকে ভেজা কাপড়ের মতো দলাই-মলাই করছে বাঙালি, আর কাতর সত্যজিৎ আর্তনাদ করছেন, ‘আমাকে আর চিপিস না রে....’। হয়তো এটা লঘু মজা৷ তবু…। আদতে বাঙালি আজ ‘সত্যজিৎ’ বলতে কিছু বুঝুক না বুঝুক, বোঝে ফেলুদা আর গুপি গাইন। তাই ভয় হয়, যখন শুনি আবার একটা ফেলুদা বানাচ্ছেন কেউ, মনে হয়, আবার এক বার ছোটবেলাটা মার খাবে। ফেলুদার পাঞ্চ! আর কী আশ্চর্য, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সেই ‘পাঞ্চ’-এর পাঁচটি গল্পের একটি ছিল ‘নয়ন রহস্য’!

Advertisement

‘নয়ন রহস্য’-এর সঙ্গে ‘সোনার কেল্লা’র একটা হালকা মিল আছে। কারণ, দুটোতেই একটি শিশুকে ঘিরে গল্প এগোয়। এবং দুটো গল্পেই শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা গুরুত্ব পেয়েছে। সত্যজিতের বিশেষ আগ্রহ ছিল জাতিস্মর প্রভৃতি ধারণায়। ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে নয়নের মতো শিশুর এই অলৌকিক সংখ্যা স্মরণের ঘটনা ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বাঙালির হয়তো মানতে অসুবিধ হবে। যেমন অসুবিধে হচ্ছিল মেনে নিতে ফেলুদার বেশে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে। ‘হত্যাপুরী’ থেকেই এ অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বার বার, এ যেন এনআরআই ফেলুদা। তাঁর জিভে সত্যজিৎ-সুলভ সরস্বতীর বদলে যেন প্রবাস লেগে রয়েছে! যে সন্দীপ রায় ‘নিশিযাপন’-এর মতো ছবি বানান, বানান ছোটবেলায় দেখা টিভিতে অনবদ্য সব সত্যজিতের গল্পের চিত্রায়ণ, তিনি কী ভাবে মেনে নিলেন এটা!

Review of Bengali film Nayan Rahashya directed by Sandip Roy

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

তবু, এ সবের পরেও ‘নয়ন রহস্য’ দেখতে ভাল লাগে। আগের ফেলুদাগুলির তুলনায় অনেক টানটান। ম্যাজিক শো যদি তার মধ্যে যদি একটা জোরের জায়গা হয়, অন্যতর জোরের জায়গা এ গল্পের ‘প্যান-ইন্ডিয়ান লুক’। সংখ্যা স্মরণ করতে পারা শিশুটিকে ঘিরে একের পর এক ‘দুষ্টু লোক’ও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। কেউ চায় রেসের মাঠের জেতার নম্বর, কেউ চায় উগান্ডার পালোয়ান দিয়ে শিশুটির অপহরণ, তো কেউ বিদেশে পাচারকারীর দালাল লেলিয়ে শিশুটিকে দেখাতে থাকে টাকার লোভ। আর এ সবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ফেলুদার তিন মূর্তি। জাদুকর তরফদারের তত্ত্বাবধানে থাকা শিশুটি চেন্নাইতে শো করতে গেলে, একে-একে ধাওয়া করে সকলেই। তার পর বেজে ওঠে ফেলুদার চেনা ‘থিম সং’!

সন্দীপ রায় জানেন, ফেলুদার গল্প বাঙালি দেখতে চায়, তার একটা বড় কারণ, ‘নস্ট্যালজিয়া’। আসলে নিজেদের ছেলেবেলার ‘নস্ট্যালজিয়া’কেই দেখেন তাঁরা। তাই হোয়াটস্অ্যাপ ব্যবহার করায় বেমানান লাগলে তেড়ে গালাগালিও দিতে থাকেন তাঁরা ফেসবুকে। সন্দীপ রায় নিজেও একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, সত্যজিৎ যে ভাবে গল্পের পাতা থেকে তুলে এনেছিলেন তাঁর দু’টি ফেলুদা ছবি, সেই ‘নুয়ান্সেস’ ধরা সম্ভব না। কারণ, নানা ‘লিমিটেশন’ আছে সব দিকে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা, সময়টা বদলে গিয়েছে। এখন বাঙালি সন্তানেরা ইংরেজিতে ফেলুদা পড়ে। সত্যজিৎ যখন ফেলুদার সংলাপে লিখতেন, ‘আজ্ঞে’, সে লব্জে বহু দিনই বাঙালি কথা বলে না। তা ছাড়া, বিশ্বায়ন পরবর্তী বাঙালির কাছে এ ধরনের গল্পের রাজনীতিও অচল। সত্যজিৎ আমাদের মনকে শেখাতেন ঐতিহ্যের গুরুত্ব, শেখাতেন কৈলাসের দেশীয় মূর্তি যারা পাচার করে বিদেশে ব্যবসা করে, বা যারা জাতিস্মরের খোঁজ পেয়ে শিশুদের নিয়েও খেলতে দ্বিধা করে না, তারা ‘দুষ্টু’ লোক।

Review of Bengali film Nayan Rahashya directed by Sandip Roy

‘নয়ন রহস্য’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

এ সব সত্যজিৎ বলতেন না। কিন্তু আমরা বুঝে যেতাম অজান্তে। তাই আজ যখন গোটা দুনিয়াটাকেই সস্তা দরে কিছু ‘দুষ্টু’ লোক বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন আমাদের এই শহরের বিকেলগুলোয় কেমন উত্তর-ঔপনিবেশিক ‘কসমোপলিটন’ হাওয়া দেয় ধর্মতলায়। এখনও… আমাদের টাকার বদলে রুচি, বোকামোর বদলে সিধে হওয়াগুলো ফেলুদার মতোই নিউ মার্কেট ভেঙে ফেলার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে চায়, আমাদের অজান্তেই… প্রতিবাদ জানাতে চায়, জটায়ুকে সবার সামনে নাগাড়ে করে যাওয়া ফেলুদার অপমানের... প্রতিবাদ জানাতে চায়, স্রেফ ব্যবসার কারণে ফেলুদার গল্পগুলোকে নিয়ে অসংখ্য ওটিটির টাকার খেলার...

কিন্তু রায়বাড়ির ফেলুদায় আজও দেখি যত্নের ছাপ। সেখানে টাকার থেকে আজও যেন শিল্প বড়। তাই আগের ছবিতে নয়নের ভূমিকায় শ্রীমান অভিনবের খোঁজ পেয়েই সন্দীপ ‘নয়ন রহস্য’ বানাতে চান। সেখানে পয়সার চেয়েও জরুরি শিশুটি। বা ম্যাজিশিয়ানের ভূমিকায় দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করার জন্য নিজেই ম্যাজিক শিখে নেন পুরোপুরি। কিংবা মহাবলীপুরমের স্থাপত্যের শটগুলি এত যত্নে নেন সন্দীপ, সত্যজিতের ভারতীয় স্থাপত্যপ্রীতিই যেন সেখানে ধরা পড়ে আবার। এ সবই তো রায়বাড়ির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা...!

জটায়ু-তোপসেকে দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যাবে আরও কয়েকটি গল্প। কিন্তু উগান্ডার দানবীয় লোকটি যাকে চেন্নাইতে প্লেনে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, ট্রেনে নিতে হচ্ছে… এতই বড় তার শরীর, তাকে দেখে হালকা হাসি পায়। আর একটু যত্ন করে বানানো যেত এই খলনায়ক। আজকের শিশুরা তো মার্ভেল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দেখে ফেলেছে। তাদের সত্যজিতের এই লোকটির অলঙ্করণে যতটা ভয় ধরবে, পর্দায় কি সে ভয় ধরা এত সোজা? একই কথা মনে হয়, পাগল সংগ্রাহক চরিত্রটিকে দেখে। মেকআপটা বড্ড খেলো লাগে। এই ছোট ছোট ছোঁয়াগুলো সত্যজিতের গল্পের হাত ধরে এমন ভাবে মনে গেঁথে গিয়েছে, এ সবে আর একটু কি গুরুত্ব দেওয়া যায় না? মোহন আগাসেকে অনেক দিন পর পর্দায় দেখা গেল বাংলা ছবিতে। ভাল লেগেছে তাঁর চরিত্রটি।

বিরতির পর ফেলুদার গল্পের ক্লাইম্যাক্সই আসল। কিন্তু ছবিটিতে মনে হল, বড় দ্রুত ক্লাইম্যাক্স ঘটে গেল। আর একটু রসিয়ে কি সেটা করা যেত না? চেন্নাইয়ের বিলাসবহুল হোটেলে ইন্দ্রনীলের ভাঙা বাংলায় অপরাধী শনাক্ত করার থেকে যে বহু দূরে চলে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলার জলছাপে আঁকা সত্যজিতের ফেলুদার অলঙ্করণগুলো!

আরও পড়ুন
Advertisement