Rituparno Ghosh

‘একবিংশ শতাব্দীতে ঋতুপর্ণ দুই ভ্রুর মাঝখানে টিপ পরলেন মুম্বইমোহিনী রেখার অনুসরণে!’

৩০ মে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণ দিবস। স্মৃতিচারণায় আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায় লিখলেন অধ্যাপক মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement
মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়
মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৪ ১৪:১২
Image Of Rituparno Ghosh

ঋতুপর্ণকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যায় মানবী। নিজস্ব চিত্র।

‘ঋতুপর্ণ’ নিজের পছন্দ করা নাম! ইন্দ্রনীল এর দাদার নাম পারিবারিক ভাবে রাখা হয়েছিল নভোনীল! ইন্দ্রনীল নামটি শব্দে যথেষ্ট ‘কমন’, নভোনীল সে তুলনায় ‘আনকমন’। এই হাতে হাত মুক্তি পেলে জেগে ওঠে ব্যক্তিগত! শুধু নাম পরিবর্তনে নয়, ঋতুপর্ণের নিজস্ব জীবন থেকে সৃষ্ট কর্ম— সবেতেই সেই ব্যক্তিগতের কড়া এবং নজরকাড়া ঘোষণা। বড় বালাই ব্যক্তিগতকে মেরে ফেলে সামাজিক হয়ে ওঠা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে!

Advertisement

ঋতুর জীবন এবং শিল্প আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের নাকের ডগায় এক ‘খুড়োর কল’-এর দর্পণ!

অতি সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি নিজের জন্য ছবি করি!’’...

কবি নিজের জন্যই কবিতা লেখেন। পাঠক ভালবেসে পড়ে নেন সে ব্যক্তিগত অনুভূতির উদ্ভাস। শ্রোতা অনুভব করেন, ‘শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন’! শিল্প তখনই সার্থক যখন সহৃদয় হৃদয় সংবাদী!

এত ক্ষণ যা বলা হল, সবটুকু তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনচরিত!

ঋতুপর্ণ বদলে গেলেন। ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। রবি ঠাকুর তাঁর অন্তঃপুরচারিণী নারীকে সমর্পণ করলেন পুরুষ জীবনদেবতার পায়ে! পরমহংস দেহ ছাড়লে মা সারদা ককিয়ে উঠলেন, ‘‘আমার মা কালী আমাকে ছেড়ে চলে গেল!’’

দর্শন, আধ্যাত্মিকতা টপকে একবিংশ শতাব্দীতে ঋতুপর্ণ দুই ভ্রুর মাঝখানে টিপ পরলেন মুম্বইমোহিনী অভিনেত্রী রেখার অনুসরণে! সকল দর্শন, মনন, আধ্যাত্মিকতা আত্মসমর্পণ করল দেহবাদের কাছে!

ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র চিত্রনাট্য ব্যবহার করলেন একবিংশের বৃহন্নলা তত্ত্বে! চিত্রাঙ্গদার পৌরুষ মহাকাব্যের মহিমা বহন করে উত্তর আধুনিকে নারীর স্বশক্তিকরণ থেকে ক্ষমতায়নের জয়গান করল। কিন্তু পুরুষের বেণীসংহার করার জন্য উথলে উঠল এই সমাজ! বৃহন্নলা সেই মহাকাব্য থেকে এই একবিংশের মাঝামাঝি অজ্ঞাতবাস এবং মাঝামাঝিতেই বদ্ধ থাকল! ‘বিচওয়ালে’!

ঋতুপর্ণর চোখের কাজল হয়ে উঠল বুক ফোলানো পুরুষের খোরাক! অথচ কে না জানে, ওই ফোলানো বুক একটি সামান্য সেফটিফিনের কাছে কত অসহায়!

ঋতু এই সমাজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ় করতে চেয়েছিলেন অনেকটা! ‘আর একটি প্রেমের গল্প’-এ চপলের নারীজীবন সাধে জল ঢেলে অভিরূপ সেন (ঋতুপর্ণ) দেখাতে চেয়েছিলেন উপস্থ সমৃদ্ধ নারী বীর্যধারী পুরুষ-নারীর কমনীয়তা নিয়েও অন্য পুরুষ! ‘চিত্রাঙ্গদা’য় ‘রুদ্র চ্যাটার্জি’ (ঋতুপর্ণ) শরীর পরিবর্তন করতে গিয়েও সরে এল ‘সিনথেটিক নারী’ হয়ে ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে! মানুষ ‘মূর্খ বড়! সামাজিক নয়’, সামাজিক হওয়ার জন্য কী হুড়োহুড়ি!

ঋতুপর্ণ সামাজিক হতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছবি কেউ দেখবে না, যদি ধরা পড়ে যায়, আসলে ঋতুপর্ণ সমকামী নন, ট্রান্সজেন্ডার! সমকামী লিঙ্গে পুরুষ বা নারীই থাকেন! ট্রান্সজেন্ডার খোদ লিঙ্গটাই বদলে ফেলেন! কেমন হবে, যেখানে যেখানে শিবমন্দিরে লিঙ্গ উঁচিয়ে, মানুষ জল ঢালছেন, পুজো করছেন, সেই লিঙ্গ সরিয়ে যদি মন্দিরে মন্দিরে যোনি প্রতিষ্ঠিত হয়? মানুষের অভ্যস্ততায় দারুণ এক আঘাত আসবে। ‘ভিশন’-এ এক ভীষণ শূন্যতা! উত্তিষ্ঠিত লিঙ্গের দর্শনে যে বরাভয় যোনির আত্মনিমগ্নতা তা ধরে দিতে পারবে না!

জীবনের শেষ ছবিগুলোতে ঋতুপর্ণ প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, তার নারীত্বের অপেক্ষাও পুরুষ শরীরটি অত্যাবশ্যক সমাজের চাপে সমাজের খাপে!

‘চিত্রাঙ্গদা’য় ডিনার টেবিলে রুদ্রের বাবা (দীপঙ্কর দে) রুদ্রকে (ঋতুপর্ণকে) পরামর্শ দিয়েছেন, ‘‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কী দরকার, ছিল ঘুঙুর পরে যদি নাচবেই!’’ রুদ্র জানিয়েছিল, সে ডিগ্রি শুধু বাবা-মা, পরিবার-সমাজকে তুষ্ট করতেই! রুদ্রের অন্তরাত্মা ‘ঘুঙুর’-এর শব্দেই আয়ু পায়! এটা যে রুদ্রের কথা নয়, ‘ব্যক্তি’ ঋতুপর্ণের কথা, সেটা জোর দিয়ে ঋতু বলতে পারলেন না! সমাজকে তুচ্ছ করে, অবাঞ্ছিত মাংসল লিঙ্গকে বাড়তি মাংস মনে করে ছেঁটে ফেলে, শিফন শাড়ি পরে অন্তরাত্মাকে উপহার দিতে পারলেন না তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত সততা! সেটা করলে ঋতুকে নির্বাসন নিতে হত সামাজিক জীবন থেকে! সুচিত্রা সেন তো শিখিয়েছিলেন, একজন নারীশিল্পী, নায়িকা আজীবন বেঁচে থাকবে নৃশংস দর্শকের মনে শুধু তার যৌবনের ইমেজ নিয়ে! ঋতুপর্ণ সুচিত্রা সেন মহাশয়ার থেকে শিখতে পারলেন না! পারলেন না, কারণ, মুনমুন-রাইমার মতো তাঁর পারিবারিক পরম্পরা নেই! এইখানেই ‘রুদ্র চ্যাটার্জি’রা বড় অসহায়!

ঋতু হয়তো বলতেন, রুদ্র একটা চরিত্র, রুদ্র আমি নই! ঋতুর এ সব কথাও নিজেকে সমাজের কাছে নির্দোষ রাখা! ঋতুপর্ণ যদি সুচিত্রা সেন কিংবা রামকিঙ্কর বেজকে অনুসরণ করে তাঁর জীবনের সকল ব্যক্তিগত সত্য নিয়ে সমাজকে ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি করতেন, তা হলে এই ‘সাতরঙা রামধনু’ যে আসলে মানুষের জীবনের একটিমাত্র রঙেরই সমষ্টিগত উচ্ছ্বাস, সেটা প্রমাণ করতে পারতেন!

আরও পড়ুন
Advertisement