মৌমিতা চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
এক সময় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নায়িকা হিসাবে বড় পর্দায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। তার পর দীর্ঘ সময় রুপোলি পর্দায় দেখা যায়নি তাঁকে। বর্তমানে ছোট পর্দায় নায়িকাদের মা, পিসিমার চরিত্রে আবার দেখা যাচ্ছে অভিনেত্রী মৌমিতা চক্রবর্তীকে। মাঝের আট থেকে ন’বছর কেন দেখা যায়নি তাঁকে? নায়িকা থেকে সোজা মা, পিসিমার চরিত্রে অভিনয় করতে আদৌ কি ভাল লাগছে তাঁর? আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব অভিনেত্রীর।
প্রশ্ন: এই পেশায় কত বছর হল?
মৌমিতা: ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু। এই তো ২৮ বছরে পা দিলাম।
প্রশ্ন: ২৮ বছর আগে কী ভাবে প্রথম সুযোগ এসেছিল?
মৌমিতা: আমি যোগমায়া দেবী কলেজের ছাত্রী ছিলাম। কলেজের শেষ দিনে বন্ধুরা মিলে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। সেই ছবি তুলতে গিয়েই বিভিন্ন শাড়ির বিজ্ঞাপনের সুযোগ আসে। বেশ কিছু দিন মডেলিং করেছিলাম। তখন সেই কাজ করতে করতেই বিভিন্ন স্টুডিয়োয় ঘুরতাম। সেই ভাবেই প্রথম ‘জননী’ সিরিয়ালে অভিনয়ের সুযোগ আসে। বলা যেতে পারে নিজের চেষ্টায় সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। সেই শুরু অভিনয় যাত্রার।
প্রশ্ন: আপনাকে প্রচুর সিনেমায়ও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে।
মৌমিতা: হ্যাঁ, ‘জননী’র পর হয়তো আর দুটো সিরিয়াল করেছিলাম। তার পর থেকেই আমি পুরোপুরি সিনেমায় অভিনয় শুরু করি। টানা ১০-১২ বছর বড় পর্দায় অভিনয় করেছি। আমার লক্ষ্যই ছিল বড় পর্দা।
প্রশ্ন: আপনি কারও থেকে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন?
মৌমিতা: না। কারও থেকে তথাকথিত প্রশিক্ষণ নিইনি। আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি তাঁরা তখন সকলে তারকা। ভুল করেছি। বকুনি, মার খেয়েছি। কেউ আবার রাগ করে সেট থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে।
প্রশ্ন: অভিনয় করতে এসে মার খেয়েছেন!
মৌমিতা: বিশ্বাস করতে অবাক লাগছে তো! এখন তো স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রদের শাসন করতে পারেন না। আমাদের সময় ও সব বাধা ছিল না। তখনকার পরিচালকরা কড়া মাস্টারমশাই ছিলেন। শিখিয়ে নিতেন সব কিছু। স্যরের মতো ছিলেন তাঁরা। খুব অপমানিতও হয়েছি। ‘হার জিৎ’ ছবিটার শুটিং করছিলাম। সবাই একসঙ্গে সেটে গল্প করছিলাম। খুব অপমান করেছিলেন পরিচালক। সেই ঘটনা থেকে আমি শিক্ষাও নিয়েছিলাম। তার পর আর এই ভুল করিনি। সেই মুহূর্তে অবশ্য খুবই লজ্জা লেগেছিল।
প্রশ্ন: সে সময় তো অনেক পরিবার এই পেশাকে ভাল চোখে দেখতেন না। আপনার পরিবারে পূর্ণ সমর্থন ছিল?
মৌমিতা: আমার পরিবারের খুবই সেকেলে ভাবনাচিন্তা ছিল। বাড়ির মানসিকতা ছিল এই ‘লাইনে’ কাজ করছি, তা হলে আর বিয়ে হবে না। তখন অবশ্য আমার বিয়ে নিয়ে কোনও ভাবনা ছিল না। ভাবতাম দুটো-একটা প্রেম করব। ভাল ছেলে দেখলে কথা বলতাম। তখন লক্ষ্য ছিল অভিনেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। সেই জায়গায় হয়তো পৌঁছতে পারিনি। তবে যা পেয়েছি তা যথেষ্ট।
প্রশ্ন: লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি বলে খারাপ লাগে?
মৌমিতা: কিছুটা খারাপ তো লাগে। তবে আমি এক দিকে না পেলেও বাকি জীবনে যা কিছু পেয়েছি, তাতে সেই না পাওয়াগুলো খুব বেশি মনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদি সেই লক্ষ্য পূরণ হত, তা হলে এখন যা কিছু পেয়েছি তা জীবনে পেতাম না। আমার ভীষণ ভাল একটা সংসার আছে। ফাটিয়ে বর পেয়েছি। এত বছর টিকে আছি এখানে সেটাই অনেক। কলকাতার সব নায়কের সঙ্গে অভিনয় করেছি আর কী চাই আমার। এই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকতে গেলে অনেক কঠিন রাস্তা পার করতে হয়। তেমনও অনেক রাস্তা পেরিয়েছি। পুরনো কথা ভেবে লাভ নেই।
প্রশ্ন: প্রযোজক, পরিচালকদের থেকে কোনও নেতিবাচক প্রস্তাব এসেছে?
মৌমিতা: হ্যাঁ করেছে। করুক না। বাইরের কেউ বাজে প্রস্তাব দেয় না নাকি? আমায় তো বাইরের অনেকেও নেতিবাচক প্রস্তাব দিয়েছে। কী হয়েছে? স্বাধীন যুগ। আমি যদি রাজি থাকি তা হলে স্বাগত, না হলে টাটা। আমার বর ছাড়া কি পৃথিবীর আর কেউ ছোঁয়নি আমায়? এই কথা নিশ্চিত ভাবে কি আমি বলতে পারি? বা কোনও মেয়ে বলতে পারে? আমার ইচ্ছা থাকলে আমি উপভোগ করব। আর ইচ্ছা না হলে ১০টা ছবির প্রস্তাব দিলেও আমি যাব না।
প্রশ্ন: আপনার থেকে সিনিয়র অভিনেত্রীরাও এখনও বড় পর্দায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন। আপনি ইচ্ছে করে না, সিরিয়ালে পিসিমা, মায়ের চরিত্রের বাইরে কিছু করতে?
মৌমিতা: দেখুন, ৪০ বছর বয়সের পর যদি মনে করি, নায়িকার চরিত্র পাব সেটা ভুল। যাত্রার মঞ্চে আমি এখনও নায়িকা। তবে সিনেমায় যে বছরের পর বছর নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে যাব, তা তো হয় না।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনার কি মনে হয় না যে, এখনও আপনি বড় পর্দাতেই কাজ করতে পারতেন?
মৌমিতা: হ্যাঁ, সেটা মনে হয়। আমারও কিছু ভুল হয়েছে চলার পথে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিটা মুহূর্তে হিসাব করে চলতে হয়। সেই হিসাবে নিজের কিছু তো ভুল ছিল। ২০০৩ থেকে দু’বছর আমি খুব খারাপ সময় কাটিয়েছি। সেটাই আমার কেরিয়ারে প্রভাব ফেলেছে। কাজ থেকে সরে গিয়েছিলাম। সে সময় একটা সম্পর্কে ছিলাম, যার খুব প্রভাব প়ড়েছিল। এখন মনে হয়, নিজের স্বর্ণ মুহূর্তগুলোকে নষ্ট করেছি আমি।
প্রশ্ন: আক্ষেপ হয় তা নিয়ে?
মৌমিতা: না। সুন্দর সংসার আছে। দুই ছেলেমেয়ে আছে, আর কী! দিনের শেষে শান্তিতে ঘুমোতে পারি। আমি সমৃদ্ধ।