ভরত কল। ছবি: সংগৃহীত।
দুধসাদা গায়ের রং, টিকালো নাক, মেদহীন চেহারা। তাঁকে দেখতে নায়কসুলভ হলেও ইন্ডাস্ট্রিতে নামজাদা ভিলেন নামেই তিনি পরিচিত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন অভিনয় জীবনে হাতেখড়ি নব্বই দশকের জনপ্রিয় খলনায়ক ভরত কলের। এখন অবশ্য তিনি ছোট পর্দার ‘ভাল বাবা’। আগের চেয়ে নিজের দুষ্টুমিটা কমিয়ে ফেললেন কেন ভরত? সদ্য আড্ডাটাইমসে মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত নতুন ওয়েব সিরিজ় ‘ক্ষ্যাপা ২’। টলিপাড়ায় ৩১ বছরের যাত্রায় কী পেলেন আর কী বা হারালেন? আনন্দবাজার অনলাইনের ফোন রেকর্ডারের সামনে সেই হিসাবই কষলেন ভরত।
প্রশ্ন: জন্মসূত্রে তো আপনি কাশ্মিরী, আপনার ছোটবেলাটা কেমন ছিল?
ভরত: ওইটুকুই। আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। বাড়িতে মাছের ঝোল আর ভাতই খাই। লেক গার্ডেন্সে আমার জন্ম। ওখানে বাড়ি রয়েছে। কাকিমা, বোনেরা থাকে। তবে আমি স্নাতক হয়েছি জম্মু থেকে। তার পর পালিয়ে চলে আসি কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এমবিএ’ পড়তে ভর্তি হই। কিন্তু সেটা আর শেষ হয়নি। কারণ তত দিনে সিনেমায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলাম। প্রচুর আউটডোর শুটিং করতে যেতাম। তাই ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় শেষ করতে পারিনি। না হলে আমার কাছে ‘এমবিএ’ ডিগ্রি থাকত।
প্রশ্ন: তা হলে অনিশ্চিত পেশা না বেছে বড় কোনও বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করতে পারতেন?
ভরত: হ্যাঁ, পারতাম তো। কিন্তু ইচ্ছা ছিল না। কখনও চাইনি। আমি আজীবন অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম। সেটা বাংলা না হিন্দি, সেটা ঠিক করিনি। ভাগ্যে ছিল যেটা, সেটাই হয়েছি। ১৯৯৩ সালে পিনাকী চৌধুরী পরিচালিত ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ ছবির মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু হয়। তার পর তো অনেক ছবি করেছি।
প্রশ্ন: কিন্তু কবে এই ‘ভিলেন’ তকমাটা পেলেন?
ভরত: আমি তো খলনায়ক হতেই এসেছিলাম। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা নয় যে হিরো হিসাবে সাফল্য পাইনি, তার পর ভিলেন হয়ে গিয়েছি। প্রথম দিন থেকেই অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তীদের থেকে খলনায়কের চরিত্র চাইতাম।
প্রশ্ন: এত সুন্দর দেখতে আপনাকে, কিন্তু এমন ইচ্ছা হল কেন?
ভরত: জানি না। প্রেম চোপড়া, প্রাণ— ওঁদের দেখতে ভাল লাগত। ‘প্রেম নাম হ্যায় মেরা, প্রেম কপূর’, আমার প্রিয় সংলাপ। এমন ধরনের সংলাপ লিখিয়েছিলাম একটি সিরিয়ালে।
প্রশ্ন: কোন হিরোর সঙ্গে মারপিট করতে বেশি ভাল লাগত?
ভরত: কোনও হিরোরা মার খেতে চাইত না। এরা শুধু মারত। মিঠুন চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, জিৎ সবাই কিন্তু বেশ দক্ষ। তবুও তার মধ্যেও মিঠুনদার নামই বলব। এককালে যাঁর ছবি দেখতে গিয়েছি সিনেমা হলে, তাঁরই গায়ে হাত দিচ্ছি! তাঁর বৌয়ের পেটে ছুরি মেরে দিচ্ছি! ভাবলেই বেশ ভাল লাগে।
প্রশ্ন: ৩০ বছরে আপনারও বিবর্তন হয়েছে। এখন আর আপনি শুধু ভিলেন নন। ‘ভাল বাবা’ হয়ে উঠেছেন...।
ভরত: সেটা বাংলা সিরিয়ালের অবদান। আমার জীবনে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশাল ভূমিকা। আমায় ভদ্রলোক তৈরি করার পিছনে রয়েছেন লীনাদি। টেলিভিশন খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। যা অতীতের ভাবমূর্তির কোনও ছায়া রাখে না। আর বর্তমানে মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিও তো তৈরি হচ্ছে না। তাই আমাদের প্রজন্মের পর তো তেমন ভাবে কোনও ভিলেনের দেখা মেলেনি। দক্ষিণী ছবিতে ভিলেন আছে।
প্রশ্ন: বর্তমানে কলকাতার ফাইট মাস্টারদের কাজও তো কমে গিয়েছে, খারাপ লাগে?
ভরত: ‘চ্যালেঞ্জ ২’ অবধি যদি সেই মশালা ছবির কথা বলি, তখনই আমাদের পশ্চিমবাংলার ফাইটমাস্টারদের কাজ কমে গিয়েছিল। মুম্বই কিংবা দক্ষিণের ফাইটমাস্টারেরা এখানে কাজ করতেন। খারাপ লাগে। আসলে আমরাও তেমন পরিবেশ তৈরি করলাম না যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মে যারা ফাইটার হতে চায়, তারা বিষয়টা শিখতে পারে। আমাদের এখানে সেই পরিবেশটাই তৈরি হয়নি।
প্রশ্ন: এই কাজের ফাঁকেই তো আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
ভরত: কাজের ফাঁকে নিজের অসুখ নিয়ে তেমন ভাবে ভাবিইনি। কাজের মধ্যে থাকলে এত কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না।
প্রশ্ন: ব্লাড ক্যানসারের মতো কঠিন অসুখ জানতে পারার পর নিজেকে কী ভাবে সামলেছিলেন?
ভরত: এই সব পরিস্থিতিতে পরিবারের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমার দাদা, দিদিরা আমায় আগলে রেখেছে। সে সময় নিসপাল সিংহ রানেও আমায় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছিল। এখন আমরা পরিবারের মতোই। তাই বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ, তা বলে কি রাতে একা কাঁদিনি! মনে হয়েছিল, ‘ভগবান, আমাকেই কেন বাছতে হল’? আসলে আমি একটা জিনিসে বিশ্বাস করি, মানুষের মৃত্যুদিন লেখা আছে। মৃত্যুদিনের আগে যে মরে যায়, সে মানুষ আমি নই। প্রতি দিন মরব না। যখন সেই দিনটা আসবে, দেখা যাবে। নিজেকে সামলাতে কখনও তাই কোনও মনোবিদের কাছে যেতে হয়নি।
প্রশ্ন: লীনা গঙ্গোপাধ্যায়-রানের মতো প্রভাবশালীরা আপনার কাছের। এই ঘনিষ্ঠতা ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার জন্য কতটা প্রয়োজন?
ভরত: শুধু লীনাদি, রানে নয়। শ্রীকান্ত (মোহতা, এসভিএফের অন্যতম কর্ণধার), শৈবালদাও (বন্দ্যোপাধ্যায়) আমার পরিবার। এই টলিপাড়ার গোষ্ঠী, বিভাজন এই বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁরাই কথা বলেন, যাঁরা সফল নন। শ্রীকান্ত তো আমার বন্ধু। কিন্তু আমি ‘হইচই’-এর কোনও সিরিজ়ে অভিনয় করিনি। ‘বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আমায় এগোতে দেননি’, ‘দেব নিজের লোকদের সুযোগ দিচ্ছে’— এমন কথা তাঁরাই বলেন যাঁদের নিজেদের দক্ষতা নেই। কে যিশু, শাশ্বতদের আটকাতে পেরেছে? দেবের সংগ্রাম আমি দেখেছি। আমি তো কোনও এমন গোষ্ঠী দেখতে পাচ্ছি না। এই যেমন রানের একটি সিরিজ় ‘ক্ষ্যাপা ২’-তে কাজ করলাম। আমার তো কোনও সমস্যা হয় না।
প্রশ্ন: তার মানে টলিউডে ‘লবি’ নেই?
ভরত: আমি জানি না। আমি তো দেখতে পাই না এই সব ‘লবি’! যে যার সঙ্গে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ, সেই অভিনেতাকে তো পরিচালক চাইবেই!
প্রশ্ন: জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেম কী ভাবে হল?
ভরত: সিরিয়ালে অভিনয় সূত্রেই আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সিরিয়ালের নাম ছিল ‘রাজযোটক’। আমাদের বয়সের পার্থক্য ১৮ বছর। ওকে দেখে মনে হয়েছিল একসঙ্গে জীবন কাটানো যায়। তার পর আমাদের মেয়ে আরিয়ার জন্ম হয়।
প্রশ্ন: আপনাকে তো রাজনীতির মঞ্চেও দেখা যায়...।
ভরত: আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মানে দিদিকে ভালবেসেই আমি মিছিলে হাঁটি। সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে আসার কখনও ইচ্ছা নেই। আমি ঠিক রাজনীতির মানুষ নই। আমার বাবা কংগ্রেস মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
প্রশ্ন: এমন কোনও স্বপ্ন আছে যা এখন পূরণ হওয়া বাকি?
ভরত: আমি এখন একটাই স্বপ্ন দেখি। আমার মেয়ে আরিয়া যেন ভাল মানুষ তৈরি হতে পারে। ব্যস, এটুকুই চাই।