অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনার বয়স কত জানতে ইচ্ছে করছে।
পরান: (হেসে) কেন বলুন তো?
প্রশ্ন: আসলে সুন্দরবন থেকে উত্তরবঙ্গ, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌড়ঝাঁপ তো চলছেই। তাই বয়সটা জানতে আগ্রহ হচ্ছে। পরান: (হেসে) খাতায়কলমে যে বয়স, সেখানে দু’বছর জল মেশানো রয়েছে। ওই ৮৪, ৮৫ বা ৮৭ হতে পারে।
প্রশ্ন: এই বয়সেও পর পর অভিনয় করে যাচ্ছেন। এত এনার্জির রহস্য কী?
পরান: মানুষের সঙ্গে কথা বলে এনার্জি পাই। আর অভিনয় হল নেশাগ্রস্ত মানুষের কাছে মদের মতো। অভিনয় না করে থাকতে পারি না।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর এখন আপনিই টানা অভিনয় করে চলেছেন। কখনও অবসর নিতে ইচ্ছে করে না?
পরান: (হেসে) ‘অবসর’ শব্দটা আমরা না বুঝে ব্যবহার করি। অবসর নেওয়া যায় শেষযাত্রায় চারপায়াতে। জীবনের এক একটা বাঁক পেরিয়ে মানুষ এগিয়ে চলে। প্রাইমারি ছেড়ে স্কুল, তার পর বিশ্ববিদ্যালয়। জীবিত মানুষের অবসর রয়েছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।
প্রশ্ন: চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আপনি যে ভাবে অভিনয়ে চলে এলেন, সেটাও তো আপনার জীবনের উল্লেখযোগ্য টার্নিং পয়েন্ট।
পরান: কর্মজীবনেই অভিনয় শুরু করেছিলাম। কিন্তু চাকরির প্রতি কোনও আন্তরিক টান ছিল না। অর্ধেক মাসের মাইনে পেতাম। কারণ বাকি দিন তো আইপিটিএ-এর জন্য নাটক করতে বাইরে বাইরে ঘুরতাম। ২০০০ সালে চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পর সম্পূর্ণ ভাবে এই নতুন জীবনে প্রবেশ করলাম।
প্রশ্ন: ‘আবার প্রলয়’ নিয়ে তো চর্চা তুঙ্গে। কিন্তু আপনি নাকি প্রথমে অভিনয় করতেই রাজি ছিলেন না?
পরান: হ্যাঁ। সুন্দরবন যেতে চাইনি। কিন্তু পরে রাজ (চক্রবর্তী) আমাকে বোঝাল যে, আমি না থাকলে সিরিজ়টাই হবে না। কন্টিনিউটির বিষয়টা বুঝে তখন রাজি হলাম। কারণ আমার জন্য কারও কাজের ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। তখন ওকে দু’দিনের সময় দিয়েছিলাম। সেই দু’দিনেই সুন্দরবনে শুটিং হয়। বাকিটা তো বানতলায় করা হয়েছিল। কিন্তু প্রোডাকশন এত ভাল ভাবে সেটা করেছে যে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে ওটা সুন্দরবন নয়।
প্রশ্ন: ‘কীর্তন’ ছবিতে যৌথ পরিবার নিয়ে দুই প্রজন্মের মতপার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। এ যুগে সেটা কতটা প্রাসঙ্গিক?
পরান: আগে একান্নবর্তী পরিবারে সকলে একে অপরের বিপদে পাশে থাকতেন। আদিম মানুষও একসঙ্গে থাকত। আজ পরিবার ভেঙে গিয়েছে, হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। অর্থনীতি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করেছে। কিন্তু মানুষের একসঙ্গে থাকার ইচ্ছেটা রয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন উৎসব দেখলে সেটা টের পাওয়া যায়। কালের নিয়মে পরিবর্তনই সমাজ তৈরি করে। কিন্তু সংস্কৃতি এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ঠিক থাকলে, কোনও কিছুই মানুষকে আলাদা করতে পারে না।
প্রশ্ন: ট্রেলার দেখে মনে হচ্ছে আপনার চরিত্রটা একটু খিটখিটে।
পরান: (হেসে) সাড়ে তিন জনের পরিবার। বৌমা এবং শ্বশুরমশাই ‘কীর্তন’ প্রিয়। স্বরচিত কীর্তনে নিজেরা সুরারোপ করে। এই চিত্র তো বাঙালি পরিবারে নতুন নয়। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই সুন্দর কিছু বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই কীর্তন যাঁরা শুনবেন, তাঁরা বুঝবেন শ্বশুর-বৌমার কীর্তনের কী দরদ! (হাসি)
প্রশ্ন: আপনার তো গানের গলা...
পরান: (থামিয়ে দিয়ে) ভেবেছিলাম। সঙ্গীত ভাল লাগে। কিন্তু শেষে দেখলাম, অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারব না। আসলে জীবনে যে কোনও একটা কাজের প্রতিই মনোনিবেশ করা উচিত। দু’নৌকায় পা দিয়ে চললে হবে না। আমার বাবা ভাল গান গাইতেন। এখনও আমার লোভ হয়। তাই নাটক বা ছবির মধ্যে সুযোগ হলে দু’কলি গেয়ে নিই।
প্রশ্ন: এখন তো ইন্ডাস্ট্রিতে তরুণ প্রজন্মের ভিড়। তাঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কী রকম?
পরান: আমি এ সব দেখিই না। ভাল-মন্দ নিয়েই জীবন। অনেকেই বলেন ‘ওল্ড ইজ় গোল্ড’। আমি বিশ্বাস করি না। অতীতেও জল মেশানো ছিল। বর্তমানেও রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে! তবে অস্বীকার করব না, সময়ের দাবিতে একটা স্রোত আসে। এক সময় বাংলা সঙ্গীত, সাহিত্য এবং সিনেমার জগতেও সেটা এসেছিল।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক বাংলা ছবির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই থাকে...।
পরান: ভাল বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে তো। আমি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে পছন্দ করি না। বাংলা সাহিত্য থেকে বিদেশিরা পর্যন্ত ধার করেন। কিন্তু আমরা নিজেরাই সে দিকে হয়তো ঠিক করে তাকাই না। বাংলা সাহিত্য নির্ভর ছবি আরও বেশি হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: এখন নাকি ইন্ডাস্ট্রি অনেক বদলে যাচ্ছে...।
পরান: আগেকার দিনে এক জন পরিচালক শুধু ভাবতেন, কী ভাবে দর্শককে একটা ভাল ছবি উপহার দেওয়া সম্ভব। সেখানে ফ্লোরে একটা আন্তরিকতার পরিবেশ ছিল। আমি নিজে দেখেছি প্রযোজক ফ্লোরে লাঞ্চ টাইমে এমন ভাবে ইউনিটকে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াচ্ছেন, যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা! এখন তো ছবির সঙ্গে অনেক কিছু জুড়ে থাকে। ব্যবসা ভাল, সেটা না থাকলে সব কিছু চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু শুধুই ব্যবসা করতে গিয়ে সব কিছু বিসর্জন দিতে হলে মুশকিল। তা হলে তো শিল্প না করে কাঠ, বাঁশ বা লোহালক্কড়ের ব্যবসা করা যায়! সংস্কৃতির ব্যবসা করতে হলে চাই মূল্যবোধ।
প্রশ্ন: ‘প্রধান’-এর শুটিংয়ের জন্য তো উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন।
পরান: হ্যাঁ। ভাল চিত্রনাট্য। এত জন শিল্পী। ওরাও জোর করতে রাজি হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: ‘টনিক’ এর পর ‘প্রধান’। দেবকে নিয়ে নানা জনের নানা মত। কিন্তু আপনার ওঁকে কেমন লাগে?
পরান: মাটিতে পা রেখে চলে। অনেকে কিন্তু নিজের খুঁত জেনেও অস্বীকার করে। দেব সেটা করে না। ওর উচ্চারণগত সমস্যার কথা ও জানে এবং ক্রমাগত নিজেকে ঘষামাজায় বিশ্বাসী। ওর থেকে আমিও শিখেছি। এক বার ‘মীরাক্কেল’-এ শুটিংয়ের ফাঁকে আমাকে বলেছিল যে, ও নাকি অভিনেতা হতে চায়নি। কিন্তু কোনও ভাবে হয়ে গিয়েছে। এই সততা সকলের মধ্যে নেই। তখনই আমাকে ও বলেছিল, ‘‘আমি বাবাকে একটা বাড়ি তৈরি করে দিতে চাই।’’ ওর এই উপলব্ধিটা এসেছিল অন্তর থেকে। আমি সেটা ভুলিনি। পরে ‘টনিক’-এ আবেগপ্রবণ দৃশ্যে ওকে জড়িয়ে ধরার পর আমার চোখে জলের পেছনে ছিল দেবের ওই পুরনো কথাটা।
প্রশ্ন: সাধারণত নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে চর্চা বা গুজব ছড়ায়। কিন্তু মাঝে আপনার শরীরস্বাস্থ্য নিয়েও গুজব ছড়াল। কী মনে হচ্ছিল তখন?
পরান: (হেসে) শুধু আমার অন্তিমযাত্রাটুকু কেউ বলেনি! আর কিছুই বাকি ছিল না। খুব মজা পেয়েছিলাম। আসলে রাহুলের (মুখোপাধ্যায়) ওয়েব সিরিজ়টা করব না বলেছিলাম। কারণ (নিজের গলার দিকে ইঙ্গিত করে) সাউন্ড বক্সটা বিগড়ে গিয়েছিল। তা নিয়ে তো শুটিং সম্ভব নয়। আর গুজব ছড়াল আমি নাকি ভাল নেই! আমি কিন্তু ওর সিরিজ়টা করছি। উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে এসে শুটিং শুরু হবে।
প্রশ্ন: শুটিং না থাকলে বাড়িতে সময় কাটে কী ভাবে?
পরান: তখন নিজের সঙ্গে অভিনয় করি। কল্পনার সাহায্যে ছোট ছোট চরিত্রদের সামনে দাঁড় করিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি।
প্রশ্ন: জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। পরান
বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করাতে বাড়ি ছুটে আসেন নির্মাতারা। আপনার ডেট পেতে কাজ পিছোতে রাজি সবাই। এই জনপ্রিয়তা কতটা উপভোগ করেন?
পরান: দেখুন, ‘উপভোগ’ করার ওই তন্ত্রীটাই আমার নেই। কোনও কালেই ছিল না। কোনও জমায়েতে অগণিত মানুষের ভালবাসায় আপ্লুত হই ঠিকই। অল্প বয়সে নাটকের শো-এর পর মানুষের ভালবাসা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হত। কিন্তু পরে তাঁদের যখন চিনতে পারলাম, তখন আমার অনুভূতিও আমি নিয়ন্ত্রণ করলাম। তাঁরা তো আমার জীবনে শিক্ষক দেবতা। আসলে প্রশংসার মধ্যে একটা অনুচ্চারিত শর্ত রয়েছে। বুঝতে পারলাম আজকে হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন মানে আমাকে আগামী দিনে আরও ভাল করতে হবে। ভাল হয়েছে বলে যাঁরা আজকে হাততালি দিচ্ছেন, খারাপ করলে তাঁরাই কিন্তু ওই হাত তুলে অভিশাপও দিতে পারেন।
প্রশ্ন: সামনে আর কী কী কাজ?
পরান: এই বছর হয়তো আর ছবি করব না। দীর্ঘ দিন পরিবারের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাইনি। দেখা যাক এ বার সময় বার করতে পারি কি না। নাটকের দলটাকে (শ্রুতিরঙ্গম) নিয়েও বসতে হবে। একটা নতুন মজার নাটক করার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক।