In Search of New Female Faces

একই মুখ দেখে বিরক্ত দর্শক! তাই কি ছোট পর্দায় নায়িকার সন্ধানে টলিপাড়া?

টলিপাড়ায় এখন সিনেমায় জায়গা করে নিচ্ছেন সিরিয়াল অভিনেত্রীরা। বক্স অফিসে তথা দর্শকের কাছে প্রথম সারির অভিনেত্রীদের গুরুত্ব কমছে বলেই কি বিকল্প পথের সন্ধান? খোঁজে আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:৫১
Decoding the reason behind Tollywood producers selecting serial actresses as lead heroine in films

(বাঁ দিকে থেকে) সৌমিতৃষা কুণ্ডু, শ্বেতা ভট্টাচার্য, দিতিপ্রিয়া রায়, দেবচন্দ্রিমা সিংহ রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনকে মেনে নিতেই হয়। টলিপাড়াও তার ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সঙ্গে পুরনোদের পাশাপাশিই নতুনরা জায়গা করে নেয়। বাংলায় মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি দীর্ঘ দিনই কোণঠাসা। বিগত দশ বছরে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে মূল ধারার ছবিতে সেই অর্থে নতুন নায়ক-নায়িকা উঠে আসেনি। অবশ্য, ইদানীং ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির নায়কদের বিপরীতে নতুন নায়িকা খোঁজার প্রচেষ্টা চলছে। কেউ সরাসরি ছবিতে সুযোগ পাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় পা রাখছেন।

তথাকথিত প্রথম সারির নায়িকাদের বক্স অফিসে গুরুত্ব কমছে বলেই কি নতুন মুখের সন্ধান বেড়েছে? আবার এ রকমও বলা হচ্ছে, ছোট পর্দার অভিনেত্রীদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতেই নাকি এই নতুন কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রযোজকদের একাংশ। ছোট পর্দা থেকে উঠে এসে ওটিটি-র পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করে ফেলেছেন দিতিপ্রিয়া রায়। গত বছর ছোট পর্দা থেকে ‘বাবা বেবি ও’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় পা রেখেছিলেন শোলাঙ্কি রায়। জিতের প্রযোজনা সংস্থার অধীনে শৌভিক কুণ্ডু পরিচালিত ‘বুমেরাং’ ছবিতে অভিনয় করছেন দেবচন্দ্রিমা সিংহ রায়। গত বছর ছোট পর্দার জনপ্রিয় মুখ শ্বেতা ভট্টাচার্যকে ‘প্রজাপতি’ ছবিতে সুযোগ দিয়েছিলেন প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী। আবার ‘প্রধান’ ছবিতেও তিনি ছোট পর্দা থেকেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী সৌমিতৃষা কুণ্ডুকে দেবের বিপরীতে নির্বাচন করেছেন। এই কাস্টিংয়ের পিছনে কারণ কী? অতনু বললেন, ‘‘খুব কঠিন নয়। ছোট পর্দায় এঁরা ভাল কাজ করছেন বলেই কিন্তু প্রযোজকেরা তাঁদের বড় পর্দায় ভাবছেন।’’ ছবির ক্ষেত্রে সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টাকে অবশ্য মানতে নারাজ অতনু। তাঁর সহজ উত্তর, ‘‘জনপ্রিয়তা দিয়ে ছবি হয়, কিন্তু সেই ছবি হিট হয় না। টিভির একাধিক জনপ্রিয় অভিনেতাদের নিয়ে অনেক ছবিই হয়েছে। সব ছবি কিন্তু সুপারহিট হয়নি।’’ দর্শক নতুন নায়িকার সন্ধানে থাকেন এবং দীর্ঘ দিন বাংলা ছবিতে কোনও নতুন মুখ উঠে আসেনি, এই বক্তব্য স্বীকার করেই অতনু জানালেন, বিষয়বস্তুই ঠিক করে দেয় সেই ছবিতে কারা থাকবেন।

Advertisement

বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে এক সময় একের পর ব্লকবাস্টার ছবি উপহার দিয়েছেন টলিপাড়ার বর্ষীয়ান পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘নতুন প্রজন্ম যে জায়গা করে নেবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসও ঘাঁটলেও তার অজস্র প্রমাণ মিলবে।’’ তবে এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক দিক থেকেই দেখতে চাইছেন ‘সাথী’ ছবির পরিচালক। কথা প্রসঙ্গেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উত্থাপন করলেন হরনাথ। তাঁর মতে, ছবির পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির নায়িকাদের ইদানীং একাধিক ব্যস্ততা রয়েছে। হরনাথ বললেন, ‘‘এমনিতেই ছবির সংখ্যা কমেছে। পাশাপাশি অনেকেই এখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা এখন অনেকটাই সহজলভ্য। সেই জন্যও তাঁরা বড় সংখ্যায় দর্শক হারাচ্ছেন।’’

বাংলা ছোট পর্দার প্রথম সারির প্রযোজক-চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে একাধিক তারকা উঠে এসেছেন। তিনি কিন্তু এই ধারার মধ্যে কোনও ‘ভুল’ দেখছেন না। কারণ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতি দিন নিজেকে নতুন ভাবে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করাতে হয়। তাই এই মাধ্যমে যিনি ভাল অভিনয় করবেন, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাছে বড় পর্দার দরজা খুলে যাবে।’’ ব্যক্তিগত পরিসরে লীনা বড় পর্দা বা ছোট পর্দার বিভাজনে বিশ্বাসী নন। তাঁর মতে, বিষয়বস্তু ভাল হলে যে কোনও ভাল অভিনেতা সেখানে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। তবে এই প্রসঙ্গেই ছবির বাজেটের বিষয়টাও তিনি উল্লেখ করতে চাইলেন। বললেন, ‘‘টিভি থেকে যাঁকে নেওয়া হচ্ছে তিনি বড় পর্দার অভিনেত্রীদের তুলনায় কম ব্যয়বহুল, অথচ ভাল পারফর্ম করবেন, সেটা কিন্তু অনেকেই জানেন।’’

‘মিঠাই’ সিরিয়ালের দৌলতে সৌমিতৃষা কুণ্ডু এখন দর্শকের চর্চায় রয়েছেন। সিরিয়াল শেষ হতেই সুযোগ পেয়েছেন বড় পর্দায়। সৌমিতৃষা কিন্তু ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় অভিনেত্রীদের যাত্রাকে কোনও আকস্মিক ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘অতীতেও অনেক উদাহরণ রয়েছে। আসলে ছোট পর্দার মতো ওটিটি বা বড় পর্দাতেও সমান পরিশ্রম করতে হয়। ভিন্ন মাধ্যমে কাজ করলে ভবিষ্যতে শিল্পী হিসেবেও ফিরে দেখলে কাজের পরিসরকে বুঝতে পারব।’’ বড় পর্দার জন্য নিজেকে কী ভাবে প্রস্তুত করছেন তিনি? বললেন, ‘‘ছোট পর্দায় আমার যে অনুরাগীরা রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যাশা যাতে পূরণ করতে পারি আপাতত সেটাই প্রাথমিক ভাবনা।’’

‘জড়োয়ার ঝুমকো’ বা সাম্প্রতিক ‘যমুনা ঢাকি’র মতো সিরিয়ালের মাধ্যমে ছোট পর্দার দর্শকদের মন জয় করেছেন শ্বেতা। ছোট পর্দায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বড় পর্দায় কাজ করতে সাহায্য করেন বলেই মনে করেন তিনি। শ্বেতার কথায়, ‘‘বড় শিল্পীদের সঙ্গে অভিনয় করতে গেলে একটা ভয় কাজ করে। খুব বেশি শট দিলে ওঁরা বিরক্ত হবেন না তো? ওঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার শট ওঁদের পছন্দ হবে তো? এই প্রশ্নগুলোই মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়।’’ কিন্তু বাজেটের কথা মাথায় রেখে যে প্রযোজকরা এই ধরনের কাস্টিং করছেন, সে কথাও মানতে নারাজ শ্বেতা। অভিনেত্রীর পাল্টা যুক্তি, ‘‘কম পারিশ্রমিকের জন্য জোর করে কাউকে নিয়ে ছবি ফ্লপ করলে তো প্রযোজকের লোকসান আরও বেশি।’’

প্রায় এক বছর বড় পর্দা থেকে দূরে মিমি চক্রবর্তী। গত বছর তাঁর অভিনীত ছবির মধ্যে ছিল ‘মিনি’ এবং ‘খেলা যখন’। গত বছর পুজোয় ‘স্বত্বিক সঙ্কেত’ ছবিতে দর্শক নুসরত জাহানকে বড় পর্দায় দেখেছেন। গত এক বছরে প্রিয়াঙ্কা সরকার অভিনীত ছবিগুলোও সেই অর্থে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় ইদানীং অন্য ধারার ছবিতে মন দিয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির অভিনেত্রীদের পর্দায় উপস্থিতি কমার ফলে নতুন মুখের চাহিদা বেড়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টলিপাড়ার এক পরিচালক বললেন, ‘‘বাণিজ্যিক ছবির সংখ্যা কমেছে বলেই অন্য ধারার গুরুগম্ভীর ছবিতে অনেকেই চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাধারণ দর্শক কিন্তু এই অভিনেত্রীদের আগের অবতারেই দেখতে চান। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দর্শক মুখ ফেরাচ্ছেন।’’

সিরিয়াল থেকে বড় পর্দায় অভিনেত্রীরা সুযোগ পাচ্ছেন বলে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন ‘চ্যালেঞ্জ ২’ বা ‘বচ্চন’-এর মতো এক সময়ের বাণিজ্য সফল ছবির পরিচালক রাজা চন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলায় একই মুখ নিয়ে দীর্ঘ দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার পর নতুন মুখের সন্ধান শুরু হয়। অস্বীকার কবর না যে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এখন নতুন নায়িকার প্রযোজন। সুযোগ পেলে আমি নিজেও নতুনদের সুযোগ দিতে চাই।’’ বিগত কয়েক বছরে বড় পর্দায় নতুন নায়িকার অভাব কেন? রাজার স্পষ্ট উত্তর, ‘‘সব প্রযোজক নতুনদের নিয়ে কাজ করার ঝঁকি নিচ্ছেন না বলেই অভাব তৈরি হয়েছে।’’ এক সময় ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির অভিনেত্রীরা বছরে চার থেকে পাঁচটি ছবি করতেন। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ছবির সংখ্যা কমছে বলেও নতুন নায়িকাদের চাহিদা বাড়ছে বলে জানালেন রাজা। তাঁর কথায়, ‘‘সিরিয়াল মানে সেই অভিনেত্রীকে আমি রঞ্জি ম্যাচে দেখতে পাচ্ছি। সেখানে ভাল রান করলে তার পর আইপিএলে ডেকে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রতি বার তিনি সফল হবেন।’’

এক সময় ছোট পর্দার সঙ্গে বিভাজনটা টলিউডে স্পষ্ট বোঝা যেত। বুঝতে না পারলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করা হত। কিন্তু ওটিটি আসার পর ধীরে ধীরে যে চিত্রটা বদলাচ্ছে, অভিনেত্রীদের কাস্টিংই তা প্রমাণ করছে। একই সঙ্গে ভারী হচ্ছে প্রতিযোগিতার পাল্লাও। সফল না হলে কারও পরিবর্তে নতুন কাউকে খুঁজে নেওয়া এখন কঠিন নয়। আগামী দিনে ‘নায়িকা বিভ্রাট’ কী ভাবে সামালায় ইন্ডাস্ট্রি, সে দিকে নজর থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement