বাংলা ধারাবাহিকে রানি রাসমণির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনুরাধা রায় ও দিতিপ্রিয়া রায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
কালীপুজো আসন্ন। দেবীর প্রসঙ্গে বাঙালি জনমানসে চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছেন সাধক রামপ্রসাদ বা শ্রীরামকৃষ্ণের বা বামাখ্যাপার মতো বিশিষ্টেরা। এই প্রসঙ্গেই আসে উনবিংশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের কালের উজ্জ্বল নারী রানি রাসমণির নাম। বাংলা ছোট পর্দায় এই ঐতিহাসিক চরিত্রকে বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা গিয়েছে। তবে দর্শক মনে স্থায়ী হয়ে রয়েছে দুই চরিত্রাভিনয়। ‘রাজেশ্বরী’ এবং ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ ধারাবাহিকে রাসমণির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যাথাক্রমে অনুরাধা রায় এবং দিতিপ্রিয়া রায়। আনন্দবাজার অনলাইনের অনুরোধে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন তাঁরা।
বাংলায় ভক্তিমূলক ধারাবাহিকের সূচনালগ্নে দর্শকমহলে শোরগোল ফেলে দেয় দেবাংশু সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘রাজেশ্বরী’। সোম থেকে শুক্র সকাল সাড়ে দশটায় বাঙালি অন্দরমহল থেকে ভেসে আসত ধারাবাহিকের জনপ্রিয় শীর্ষসঙ্গীত। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছেন অনুরাধা রায়। তাঁর মনের অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু, ‘রাজেশ্বরী’র প্রসঙ্গ উঠতেই অভিনেত্রীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল। অনুরাধা জানালেন, শুরু থেকেই ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি তাঁর আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। তাই রাসমণি চরিত্রের প্রস্তাব আসায় লুফে নেন। এই ধারাবাহিকের প্রস্তাব কী ভাবে আসে? অনুরাধা বললেন, ‘‘কুশলের (অভিনেতা কুশল চক্রবর্তী) মাধ্যমে আমার কাছে প্রস্তাবটা আসে। প্রথমে তিন জন মহিলা চরিত্রকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিকের গল্পকে ভাবা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে রাসমণি চরিত্রটা দর্শকেরা এতটাই ভালবেসে ফেলেন যে, আমাকে কেন্দ্র করেই ধারাবাহিকের গল্প শেষ হয়।’’
১৯৯৭ সালে দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয় ধারাবাহিকটি। প্রায় ৩২০টি পর্ব, যা সেই সময়ের ধারাবাহিক মহলে নজিরই বটে। শুটিং হত টালিগঞ্জের এনটিওয়ান স্টুডিয়োয়। চরিত্রের জন্য নিজেকে আলাদা ভাবে প্রস্তুত করেছিলেন অনুরাধা। চিত্রনাট্যের পাশাপাশি শুরু করেন নিজের মতো করে রাসমণিকে নিয়ে পড়াশোনা। কেমন ছিল শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা? অনুরাধা বললেন, ‘‘ধারাবাহিকে পরিচিত এবং নতুন মুখ মিলিয়ে প্রচুর অভিনেতা ছিলেন। সারা দিন সকলে মিলে শুটিং করতাম। চলত প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত। সেই সব দিনগুলোকে খুব মিস্ করি।’’
ধারাবাহিকে রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করতেন মৃণাল মুখোপাধ্যায়। অন্য দিকে মথুরের চরিত্রে ছিলেন গৌতম দে। এ ছাড়াও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাও ছিলেন এই ধারাবাহিকে। সময়ের সঙ্গে গল্প যত এগোতে থাকে, অনুরাধার উপরেও অগাধ বিশ্বাস জন্ম নেয় দেবাংশুর। অনুরাধা স্মরণ করলেন, ‘‘দেবাংশু শিক্ষিত। অসাধারণ চিত্রনাট্য লিখত। একই সঙ্গে শুটিংয়ের বিভিন্ন বিভাগের কাজও জানত। পরের দিকে কোনও দৃশ্যে পর্ব পরিচালক তপন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোনও মতবিরোধ হলে, দেবাংশু বলত, ‘দিদি যেমন বলছেন, সেই ভাবেই করুন'।’’
অনুরাধা জানালেন, রাসমণি চরিত্রে অভিনয় করতে করতে একটা সময়ে তিনি এতটাই আত্মস্থ হয়ে পড়েন যে, চাইলেও চরিত্র থেকে বেরোতে পারছিলেন না। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘ধারাবাহিক শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন চরিত্রে অভিনয়ের আগে বিরতি নিয়েছিলাম।’’
অভিনয় শুরু করেছিলেন আগেই। কিন্তু ‘রাজেশ্বরী’ যে তাঁর কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সে কথা জোর গলায় স্বীকার করে নিলেন অনুরাধা। মানুষের যে ভালবাসা তিনি পেয়েছেন, তা আজও থামেনি। এখনও তাঁকে শুনতে হয়, ‘‘আপনার রাসমণিকে এখনও আমরা ভুলতে পারিনি।’’ কথাপ্রসঙ্গেই একটি ঘটনা শোনালেন অনুরাধা। অভিনেত্রীর বাড়িতে সকাল সকাল সত্তরোর্ধ্ব এক আগন্তুকের আগমন। অনুরাধার কথায়, ‘‘তাঁর দাবি, তিনি রাসমণিকে দেখতে এসেছেন। আমাকে প্রণাম করতে এগিয়ে এলেন! তিনি আমাকে একটি প্রশংসাপত্র এবং কিছু উপহার দিয়ে যান। এই অভিজ্ঞতা চিরকাল মনে থাকবে।’’
পরবর্তী সময়ে রাসমণি চরিত্রে দিতিপ্রিয়ার অভিনয় অনুরাধা দেখেছেন। তাঁর কেমন লেগেছে? অভিনেত্রী বললেন, ‘‘রাসমণির বয়স অনুযায়ী দিতিপ্রিয়াকে মানায়নি। কিন্তু অল্প বয়সে এতটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দিতিপ্রিয়া যে ভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।’’ তবে, এই ধারাবাহিক নিয়ে দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে কখনও তাঁর কথা হয়নি বলেই জানালেন অনুরাধা। বললেন, ‘‘পরবর্তী সময়ে একটা ধারাবাহিকে দিতিপ্রিয়া আমার নাতনির চরিত্রে অভিনয় করেছিল।’’
২০১৬ থেকে একটানা পাঁচ বছর সম্প্রচারিত হয় জি বাংলার ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ ধারাবাহিকটি। প্রায় দেড় হাজার পর্ব। রাসমণি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অল্প বয়সেই বাঙালির অন্দরমহলে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন দিতিপ্রিয়া। অল্প বয়সে এ রকম একটি চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন তিনি? অভিনেত্রীর স্বীকারোক্তি, ‘‘আসলে প্রথমে জানতাম, তাঁর ছোটবেলার চরিত্রে আমি অভিনয় করব। কিন্তু পরের দিকে ধারাবাহিক এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, নির্মাতারা আমাকে কেন্দ্রে রেখেই গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।’’
এখন ফিরে দেখলে বিষয়টিকে নির্মাতাদের তরফে ‘ঝুঁকি’ হিসেবেই মনে করছেন দিতিপ্রিয়া। কিন্তু, সেই সঙ্গে দর্শককেও তিনি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছেন। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘তাঁরা আমাকে গ্রহণ না করলে তো কিছুই হত না।’’ মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাসমণি চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন দিতিপ্রিয়া। প্রস্তাব গ্রহণ করার পরের দিনই ধারাবাহিকের প্রোমোর শুটিং হয়। সেই সময়ে তাঁকে আলাদা ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়নি। কিন্তু জানালেন, রাসমণির পরবর্তী জীবনের সময়কালে অভিনয় করার সময়ে তিনি রাসমণি সম্পর্কে পড়াশোনা করতে শুরু করেন। দিতিপ্রিয়া বললেন, ‘‘সাড়ে চার বছর শুটিং করেছিলাম। বলা যায়, আমার বড় হয়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোতে রাসমণিই আমার জীবন জুড়ে ছিলেন।’’
রাসমণি চরিত্রে অভিনয় তাঁর কাছে চ্যালঞ্জিং ছিল বলেই জানালেন দিতিপ্রিয়া। কিন্তু নিজেকে চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ইউনিটের প্রত্যেকের সাহায্যকেও স্বীকার করে নিলেন অভিনেত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘পর্দায় সকলের থেকে বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করছি আমি। আর বাস্তবে বাকিদের থেকে আমি সবচেয়ে ছোট। এই বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হত।’’
সেই সময় রাসমণি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অল্পবিস্তর সমালোচিত হয়ে হয় দিতিপ্রিয়াকে। তাঁর চরিত্রায়ণ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বললেন, ‘‘আমি পিছনে তাকাতে চাই না। কী হয়েছে, সেটা নিয়ে এখন ভেবে লাভ নেই। তখন সমাজমাধ্যম আজকের মতো সক্রিয় ছিল না। হয়তো এখন হলে বিষয়টা আরও কঠিন হতে পারত।’’
তবে নিজের প্রস্তুতির জন্য দিতিপ্রিয়া কখনও অনুরাধার সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেননি বলেই জানালেন। দিতিপ্রিয়া বললেন, ‘‘আমি জানতাম, বড় বয়সের চরিত্রে অন্য কেউ আসবেন। তিনি অনুরাধা কাকিমার থেকে পরামর্শ নিয়েই চরিত্রটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিন মাসের অভিনয়ের পরবর্তে আমি যে পাঁচ বছর রাসমণি চরিত্রে অভিনয় করব, সেটা ছিল কল্পনাতীত।’’
সেই সময় প্রকাশ্যে দিতিপ্রিয়াকে দেখলে অনেকেই নাকি প্রণাম করতে আসতেন। দিতিপ্রিয়া বললেন, ‘‘তখন আমার চুল ছোট করে কাটা। মেকআপ ছাড়া আমাকে দেখে প্রথমে মানুষ বিশ্বাস করতেন না যে আমিই রাসমণি চরিত্রে অভিনয় করছি। তাঁদের চোখে ওই বিস্ময়টা উপভোগ করতাম।’’ একাধিক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে। দেখা হলে কখনও অনুরাগীর চোখে জলও দেখেছেন দিতিপ্রিয়া। বললেন, ‘‘শুটিং সেটে অনেকে চলে আসতেন। এক বার তো বর্ধমান থেকে এক জন রাসমণি-ভক্ত আমার বাড়িতে দেখা করতে উপস্থিত। এখনও পাড়ার পুজোয় অনেকে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেন।’’
এই ধারাবাহিক নিয়ে এখনও দর্শকের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পান দিতিপ্রিয়া। জানালেন, এখনও দর্শকের একাংশ ধারাবাহিকের পুনঃসম্প্রচার দেখেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজেই বিষয়টা নিয়ে অবাক। আমার ব্যক্তিগত মেকআপ শিল্পীও এখনও অনলাইনে ধারাবাহিকের এপিসোড দেখেন।’’
ভবিষ্যতে বয়স বাড়লে কখনও রাসমণি চরিত্রের অভিনয়ের প্রস্তাব এলে তিনি কি রাজি হবেন? দিতিপ্রিয়া হেসে বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে ভবিষ্যতের কথা বলা কঠিন। তবে রাসমণি তো আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। না চাইতেই আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাই নিশ্চয়ই রাজি হব।’’ একই সঙ্গে অভিনেত্রী জানালেন, তাঁর অপূর্ণ সাধও সেই প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে মিটিয়ে নেবেন। দিতিপ্রিয়ার যুক্তি, ‘‘অল্প বয়সে অভিনয় করেছিলাম বলে তখন তো অনেক কিছুই অভিনয়ের মধ্যে রাখতে পারিনি। তাই বেশি বয়সে আবার এই চরিত্রে অভিনয় করলে সেই জায়গাগুলো রাখার চেষ্টা করব। হয়তো দর্শকেরও তখন আর কোনও অভিযোগ থাকবে না।’’