বামফ্রন্ট জামানায় ভেড়ি এলাকার রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য কায়েম করেছিলেন মজিদ মাস্টার।
আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিপিএম এখন আর বামপন্থী নেই। এমনটাই মনে করেন একদা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের অন্যতম নেতা মজিদ মাস্টার। আসল নাম মজিদ আলি। কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে তাঁর পরিচিতি মজিদ মাস্টার হিসেবেই। যিনি কিনা, বামফ্রন্ট জামানায় ভেড়ি এলাকার রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য কায়েম করেছিলেন। সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্কের প্রতীক। কিন্তু, সেই তিনিই কাঁধ থেকে লাল ঝান্ডা নামিয়েছেন ২০১৫ সালের জুন মাসে। সিপিএমের সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। দলের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছেড়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনীতির খবর রাখেন পুরোনো অভ্যাস মতোই। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করেছিল, সেই সময় তাঁর ধারণা হয়েছিল দলের আদর্শচ্যূতি ঘটেছে। আর আব্বাসের দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে সিপিএম ভোটে আসন সমঝোতার বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না বামপন্থায় বিশ্বাসী মজিদ।
তাঁর কথায়, “সিপিএম যখন আইএসএফের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে পারে, তখন তো বিজেপির সঙ্গেও জোট করতে পারে। কারণ, দু’টি দলের চরিত্র এক। আমি এই দু’টি দলের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখি না। তাই আমার মনে হয় আইএসএফের সঙ্গে হাত মেলানোয় সিপিএম আর বামপন্থী নেই।” আইএসএফ তো বটেই, কেন কংগ্রেসের সঙ্গেও সিপিএমের জোট সম্ভব নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে মজিদের যুক্তি, “আমি ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনীতি করেছি। যাঁরা সেই সময় আমাদের রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁরাই কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন। আমরাও সেই পার্থক্য বুঝে সিপিএমের আদর্শে দীক্ষিত হয়েই রাজনীতি করেছিলাম। যাঁরা আমাদের আদর্শের পাঠ দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ আর নেই। কিন্তু তাঁদের সেই শিক্ষা ভুল নয়। সিপিএম সেই সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে এখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছে। তাই আমি বলছি, সিপিএম আর বামপন্থী নেই।”
দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শাসনে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন মজিদ। বাম জমানার সেই দাপট আর নেই। নেই মজিদের হাতে ভেড়ি রাজনীতির চাবিকাঠিও। কার্যত অবসর জীবন কাটাচ্ছেন এই প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। পড়াশোনা ও কৃষিকাজ এখন তাঁর জীবনের সঙ্গী। তবে রাজনীতি সচেতন মজিদ এখনও খবর রাখেন রাজ্য রাজনীতির। গত এক বছরের বেশি সময় শাসনে নিজের বাড়িতে রয়েছেন তিনি। কোনও রাজনৈতিক হামলা হয়নি তাঁর ওপরে, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। অথচ, ২০১০ সালে মজিদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। বামফ্রন্ট জমানার শেষ দিকে এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাঁর হাত থেকে। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা বদল হলে শাসন ছাড়তে হয় মজিদকে। পরে খুনের মামলায় জেলও হয় তাঁর। জামিনে মুক্তি পেলেও, শাসনে ফেরা হয়নি। সেই সময় কখনও বারাসতে সিপিএমের জেলা পার্টি কার্যালয়ে, কখনও গোপন ডেরায়, কখনও আবার ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন মজিদ। বছর পাঁচেক আগে এক বার শাসনে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় তাঁর বাড়ি-গাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় জনতা। ইটের ঘায়ে মাথা ফাটে মজিদের। বাধ্য হন ফিরে যেতে। কিন্তু, ২০১৯ সালে পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে মজিদকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়ার আবেদন করেন। ৭৭ বছর বয়সি প্রাক্তন এই সিপিএম নেতাকে বাড়ি ফিরতে বলেন বিধায়ক। মূলত তাঁর হস্তক্ষেপেই নিরুপদ্রবে বাড়ি ফেরেন মজিদ। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে একদা শাসনের ত্রাস মজিদ মাস্টার ফেরেন নিজভূমে। তত দিনে ক্ষমতার সঙ্গে চলে গিয়েছে তাঁর সিপিএম পার্টি করার নেশাও। কিন্তু, সেই দলের আদর্শচ্যূত হওয়ার ঘটনা যে এখনও তাঁকে নাড়া দেয় সে কথা আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলতে ভোলেননি মজিদ মাস্টার।