Lok Sabha Election 2024

দলবদলে নজির গড়া অর্জুন ভোটের অঙ্কে চাপে? পার্থ কি প্রলয় আনতে পারবেন? ভরসা সর্বহারার দেবদূতে

২০১৯ সাল শুরুর মুখে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান অর্জুন সিংহ। সাংসদ হওয়ার বছর তিনেক পরে ফিরে যান তৃণমূলে। কিন্তু সেখানে টিকিট না পেয়ে ভোটের মুখে অর্জুন আবার বিজেপিতে এবং ব্যারাকপুরের প্রার্থী।

Advertisement
পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৪ ২০:০০
What is the political situation of Barrackpore constituency before Lok Sabha Election 2024

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনেক দলবদল দেখেছে বাংলা। তার মধ্যে ব্যারাকপুর অনন্য। গত লোকসভা নির্বাচনে আগে আগে দল বদল করে বিজেপিতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের অর্জুন সিংহ। তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে বিজেপির সাংসদ হন। ঘটনাচক্রে, দীনেশ তার পরে যান বিজেপিতে। অর্জুন খাতায়কলমে বিজেপি সাংসদ থেকেও বছর তিনেক পদ্মে কাটিয়ে তৃণমূলে ফিরে যান। আবার তৃণমূলবাসের দু’বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিজেপিতে ‘প্রত্যাবর্তন’। এবং ব্যারাকপুরেই পদ্মের প্রার্থী।

Advertisement

পাঁচ বছর আগে-পরে ঘটনাচক্র যেন কোথাও এক। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন অর্জুন। তার ২৯ দিনের মধ্যে নির্বাচনে জিতেওছিলেন তিনি। তার পরে ২০২২-এর মে মাসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতরে গিয়ে তৃণমূলে ফিরেছিলেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এই নেতা। আবার টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে ফিরেছেন চলতি বছরের মার্চে।

ব্যারাকপুর মানে শিল্পাঞ্চল। সেখানে শিল্পের সংখ্যা হাতেগোনা। কিন্তু নামে ওই এলাকা এখনও ‘শিল্পাঞ্চল’। তবে রাজনীতির ময়দানে এই লোকসভা অনেক শিল্প দেখিয়েছে। একটা সময়ে বামেদের ‘ঘাঁটি’ হিসাবেই পরিচিত ছিল ব্যারাকপুর। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের আভাস ২০০৯ সালেই রাজ্যবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল এই লোকসভা কেন্দ্র। কাস্তে-হাতুড়ি-তারা উপড়ে ফেলে বামেদের উর্বর জমিতেই ফোটে ঘাসফুল। তার পরে সেই ঘাসফুলের জায়গা দখল করে ফুটে ওঠে পদ্ম। এখন শিল্পাঞ্চলের রুক্ষ মাটিতে ফুল বনাম ফুলেরই লড়াই। গঙ্গার পূর্ব পারে অস্ত গিয়েছে লাল সূর্য।

What is the political situation of Barrackpore constituency before Lok Sabha Election 2024

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এই আসনের ইতিহাসে অনেক খ্যাতনামীর ভিড়। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের টিকিটে এখান থেকে জিতেছিলেন অধুনা দমদমের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ তথা প্রার্থী সৌগত রায়। মন্ত্রীও হয়েছিলেন চৌধুরি চরণ সিংহ মন্ত্রিসভায়। আবার ১৯৮৪ সালে ব্যারাকপুর থেকেই জিতেছিলেন সেই সময়ের খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা দেবী ঘোষাল। কিন্তু ১৯৮৯ সালের লাল রঙের বিদ্যুৎ খেলে যায় এই কেন্দ্রে। সাংসদ হন সিপিএমের তড়িৎবরণ তোপদার। টানা ছ’বার জেতার পরে সপ্তম দফায় হোঁচট খান তিনি। সে বারেও অবশ্য জিতছেন ধরে নিয়ে ফল ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই বিজয়মিছিলের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। সে বারে চমক দেখিয়েছিল তৃণমূল। ৫৬ হাজার ভোটে জয়ী হন দীনেশ। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলে কয়েক মাসের জন্য রেলমন্ত্রীও হয়েছিলেন ব্যারাকপুরে সাংসদ দীনেশ। যদিও সেই চেয়ার স্থায়ী হয়নি। রেল বাজেট পছন্দ না হওয়ায় মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল দলনেত্রীর নির্দেশে। ২০১৪ সালে সিপিএম ওই কেন্দ্রে নিয়ে আসে সর্বভারতীয় নেত্রী সুভাষিনী আলিকে। বাধ্য ছেলের মতো সুভাষিনীর বিরুদ্ধে ফের টিকিট পান দীনেশ। এ বার তাঁর ব্যবধান বেড়ে দু’লাখের বেশি হয়ে যায়।

সে বারই বিজেপির উত্থান দেখা যায় ব্যারাকপুরে। ২০০৯ সালের মতোই তৃতীয় স্থানেই ছিল পদ্মশিবির। কিন্তু ভোটপ্রাপ্তি ৩.৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়ে যায় প্রায় ২২ শতাংশ। প্রাক্তন পুলিশকর্তা আর কে হান্ডাকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছিল বিজেপি। ২০১৪ সালে স্বয়ং অর্জুনের বিধানসভা কেন্দ্র ভাটপাড়া থেকেও এগিয়ে ছিলেন তিনি। পাশাপাশিই বিজেপি বুঝেছিল, ভোট বাড়তে পারে। কিন্তু জিতে আসার মতো ‘মুখ’ নেই ব্যারাকপুরে। বিজেপির তরফে ভোটের মুখে সেই মুখ হয়ে ওঠেন অর্জুন। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়া ভাটপাড়ার বিধায়ক বিজেপি প্রার্থী হয়ে যান ২০১৯ সালে। ওই আসনে ২০০৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে তড়িৎবরণের কাছে পরাজিত অর্জুন জিতেও যান। বিজেপির ভোট বাড়ে আরও প্রায় ২১ শতাংশ। সিপিএম নেমে যায় ১০.৩৬ শতাংশে। তৃণমূলের ভোটও ৪ শতাংশের মতো কমেছিল।

এই অঙ্কেই এ বার লোকসভা ভোটের লড়াই। কিন্তু একটা বদল হয়েছে। ২০১৯ সালে বিজেপি এই আসনের পাঁচটি বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ভাটপাড়ায় অর্জুন-পুত্র পবন সিংহের জয় ছাড়া বাকি ছ’টি বিধানসভাই হতাশ করে পদ্মকে।

এর পরেই দলবদল। অর্জুন তৃণমূলে গিয়েও লোকসভার ঠিক আগে ফিরে গিয়েছেন বিজেপিতে। ১০ মার্চ ব্রিগেডের সভা থেকে তৃণমূল প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেছিল। আগে থেকে আভাস পেলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্জুন আশায় ছিলেন তাঁর ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে। কিন্তু তৃণমূল ব্যারাকপুরের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে রাজ্যের মন্ত্রী তথা নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকের নাম। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলেও যাঁর প্রভাব রয়েছে। যিনি ‘আবার প্রলয়’ ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করে আরও খানিক নাম কুড়িয়েছেন। তবে ব্যারাকপুরে ‘প্রলয়’ ঘটাতে পার্থের থেকে তাঁর বাহিনীর ভূমিকা বড় হতে হবে। তাঁর পক্ষে আশার কথা এই যে, পাশে রয়েছেন একের পর এক বিধায়ক। আমডাঙার রফিকুর রহমান, বীজপুরের সুবোধ অধিকারী, নোয়াপাড়ায় মঞ্জু বসু, ব্যারাকপুরে রাজ চক্রবর্তী এবং জগদ্দলের সোমনাথ শ্যাম। এঁরা সকলেই ঘোষিত অর্জুন-বিরোধী।

২০১৯ সালের ভোটে অর্জুনের জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা নিয়েছিলেন মুকুল রায় ও মণীশ শুক্ল। খাতায়কলমে মুকুল এখনও কৃষ্ণনগর উত্তরের বিজেপি বিধায়ক। তবে রাজনীতি থেকে দূরে। তিনি বিজেপি কিংবা তৃণমূলে থেকেও নেই। যদিও মনোনয়ন পাওয়ার পর মুকুলের বাড়ি গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন অর্জুন। গত বারের ভোটে অর্জুনের বড় শক্তি ছিলেন বিজেপি নেতা মণীশও। কিন্তু ২০২০ সালে ব্যারাকপুরে খুন হয়ে যান তিনি।

ব্যারাকপুর লোকসভা আসনের উত্তরে নৈহাটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মভিটে। আবার হালিশহরে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। বাংলার সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ভট্টপল্লিই আজকের ভাটপাড়া। তবে ঐতিহ্যের চেয়ে ব্যারাকপুরের এখনকার পরিচয় হল জুটমিলের শ্রমিকদের উপরে আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ের ভূমি। এখন মেঘনা জুটমিলের নিয়ন্ত্রণ অর্জুনের হাতে। আর অ্যালায়েন্স জুটমিল সোমনাথের। সোমনাথের বড় পুঁজি অর্জুন বিরোধিতা। অর্জুন তৃণমূলে থাকার সময়েই তাঁর সঙ্গে বিবাদ ছিল জগদ্দলের বিধায়ক সোমনাথের। এক সময়ে ভাটপাড়া পুরসভার প্রধান ছিলেন অর্জুন। সোমনাথের মা রেবা রাহা ছিলেন কংগ্রেসে। ২০১৯ সালে যে দিন অর্জুন বিজেপিতে যান, তার পর দিনই সোমনাথ তৃণমূলে আসেন। অর্জুন সে খেলা ‘ড্র’ করে দেন তৃণমূলে ফিরে। দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। কিন্তু এখন আবার তাঁরা প্রতিপক্ষ দলে। পার্থ প্রার্থী হলেও অর্জুনের বিরুদ্ধে তৃণমূলের পক্ষে আসল লড়াই সোমনাথের।

বাংলার বাকি আসনের তুলনায় ব্যারাকপুর অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। এখানে স্পষ্ট ভাগ রয়েছে বাংলাভাষী এবং হিন্দিভাষী ভোটারের। নৈহাটির ‘বড়মা’ (কালী) ভক্ত যেমন রয়েছেন, তেমনই বজরংবলী আর রামভক্তের সংখ্যাও কম নয়। পেশিশক্তি এই আসনে সব সময় গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। বোমা-গুলি-হামলা নৈমিত্তিক ঘটনা। সেই তড়িৎবরণের সময় থেকেই। অর্জুন-সোমনাথেরা তাঁরই উত্তরসূরি। তবে এ বার নির্বাচনের আবহে ব্যারাকপুর এখনও পর্যন্ত শান্ত।

তড়িৎবরণ না থাকার পর থেকেই কোনও বিদ্যুৎতরঙ্গ নেই বাম শিবিরে। পরীক্ষামূলক ভাবে এক অভিনেতাকে প্রার্থী করেছে সিপিএম। নাম দেবদূত ঘোষ। মূলত পরিচিত ছোটপর্দায় অভিনয়ের কারণে। তবে নাটকের মঞ্চেও পরিচিত মুখ। যখন বোমা-বন্দুকের ব্যারাকপুরের প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়, তখন তিনি নাকি শুটিংয়ের ফাঁকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই হাতে বসে ছিলেন। কবিতায় মগ্ন থাকতে থাকতেই জানতে পারেন নতুন পথে হাঁটতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে শ্রমিকনেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। এ বারে গার্গী-সহ এত জন টিকিট-প্রত্যাশী ছিলেন যে, বাধ্য হয়েই অন্য ক্ষেত্রে ‘বামমনস্ক’ দেবদূতে ভরসা রাখে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে টালিগঞ্জ কেন্দ্রেও তাঁর উপর এমনই আস্থা রেখেছিল সিপিএম। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বনাম তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের লড়াইয়ে দেবদূতের স্থান হয়েছিল তৃতীয়।

তবে ভোটের অঙ্ক আর ব্যারাকপুরের আবহ বলছে, নিজের দল নয়, ভোট কাটাকাটি করে তিনি তৃণমূল বা বিজেপি কোনও এক দলের কাছে ‘দেবদূত’ হয়ে উঠতে পারেন। টিভি ধারাবাহিকের মতো ব্যারাকপুরের ভোটেও তিনি পার্শ্বচরিত্রে। এখন দেখার, কোন ফুল দেবদূতের কৃপাধন্য হয়।

আরও পড়ুন
Advertisement