(বাঁ দিক থেকে) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে শ্রীরামপুর লোকসভায় জোড়া জনসভা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি ডোমজুড়ে। অন্যটি শ্রীরামপুরে। সোমবার সেখানে ভোট। শনিবার ছিল প্রচারের শেষ দিন। কিন্তু দেখা গেল, প্রচারপর্বে এক দিনও শ্রীরামপুরে পা রাখলেন না দলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, অভিষেক একাধিক জনসভা করেছেন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে। যেমন আরামবাগ লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী মিতালি বাগের সমর্থনেও গিয়েছেন প্রচারে। কিন্তু শ্রীরামপুরে যাননি।
ঘটনাচক্রে, উত্তর কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোড়া প্রচারপত্রে দলের সেনাপতি অভিষেকের ছবি নেই বলে সমাজমাধ্যমে সরব হয়েছেন কলকাতা পুরসভার ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোনালিসা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে যিনি ‘সম্মান পাচ্ছেন না’ অভিযোগ তুলে মাসখানেক আগে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে আমরণ অনশনে বসেছিলেন। তাঁকে শরবত খাইয়ে অনশন ভাঙাতে সেখানে ‘সুদীপের দূত’ হিসেবে পৌঁছেছিলেন কুণাল ঘোষ।
শ্রীরামপুরে কল্যাণের প্রচারে অভিষেকের না যাওয়া এবং সুদীপের প্রচারপত্রে অভিষেকের ছবি না থাকার ঘটনাকে পাশাপাশি রেখে শাসক শিবিরের অনেকেই তৃণমূলের অন্দরে ‘নবীন-প্রবীণ’ সমীকরণে জুড়ে দিতে চাইছেন। যদিও কল্যাণ নিজে বিষয়টিকে ততটা আমল দিতে চাইছেন না। শনিবার প্রচারলগ্নের শেষ পর্বে তিনি বলেন, ‘‘কে কোথায় প্রচারে যাবেন, তা মমতাদি ঠিক করেন। দিদি নিজে দু’টি জনসভা করেছেন। তিনিই বলেছেন, কল্যাণ একাই ১০০! আর অভিষেককে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে দল পাঠাচ্ছে। শ্রীরামপুর তো আমাদের শক্তপোক্ত জায়গা। এখানে অভিষেক কেন, ববিরাও (ফিরহাদ হাকিম) তো কেউ আসেনি!’’ সেই সূত্রেই দলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়েছে এই মর্মে যে, অভিষেক কি সৌগত রায়ের দমদম এবং সুদীপের উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে প্রচারে যাবেন? নাকি যাবেন না? আগামী ২৭ মে সুদীপের সমর্থনে উত্তর কলকাতায় পদযাত্রা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সুদীপের প্রচারে অভিষেক কবে যাবেন বা আদৌ যাবেন কি না, তা শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তৃণমূল জানায়নি। ঘটনাচক্রে, ওই দু’টি কেন্দ্রের সঙ্গে একইদিনে অভিষেকের নিজের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারেও ভোট। একেবারে শেষ দফায় ১ জুন। ফলে একদিকে যেমন হাতে এখনও সময় রয়েছে, তেমনই এ-ও বাস্তব যে, তার আগে অভিষেক নিজের কেন্দ্রে প্রচার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। ডায়মন্ড হারবারে শেষ দফায় ভোট হওয়ায় তিনি রাজ্যের বিভিন্ন আসনে ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে পেরেছেন। ডায়মন্ড হারবারে শনিবার তিনি একটি রোড শো করেছেন। তাতে ভিড় হয়েছিল বিপুল। দলীয় সূত্রের খবর, এর পরে তৃণমূলের সেনাপতি নিজের কেন্দ্রে প্রচারের সময় বাড়াতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দমদম বা উত্তর কলকাতায় তাঁর প্রচারে না যেতে পারা ‘স্বাভাবিক’ বলেই ধরে নেওয়া হবে।
অভিষেক-প্রণীত ‘বয়সনীতি’ নিয়ে যখন তৃণমূলে ‘নবীন-প্রবীণ’ মন্থন চলছিল, তখন যে সব এলাকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি জল্পনা শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে শ্রীরামপুর, উত্তর কলকাতা এবং দমদম অন্যতম। সেই প্রেক্ষাপটেই শ্রীরামপুরের প্রচারে অভিষেকের অনুপস্থিতি নিয়ে শাসকদলে জল্পনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, ‘‘যদি দেখা যায়, অভিষেক শ্রীরামপুরের মতো দমদম এবং উত্তর কলকাতাতেও প্রচারে যাননি, তা হলে বুঝতে হবে নিশ্চয়ই কিছু ব্যাপার আছে। আর তা না হলে বুঝতে হবে শ্রীরামপুর নিছকই ব্যতিক্রম।’’
উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের প্রবীণ তৃণমূল প্রার্থী সুদীপের প্রচারপত্রে অভিষেকের ছবি না থাকা নিয়ে দলের কাউন্সিলর মোনালিসা ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘উত্তর কলকাতার প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি প্রচার পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতগুলো পাতায় এতগুলো ছবি। সেখানে আমাদের যুব সমাজের আইকন, ক্যাপ্টেন অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের অন্তত একটিও ছবি থাকলে ভাল হত।’ মোনালিসার সুদীপকে নিয়ে ক্ষোভ ছিল। পরে কুণালের ‘মধ্যস্থতা’য় তা মিটমাট হলেও অভিষেকের ছবি না-থাকা ঘিরে ওই কাউন্সিলরের ক্ষোভ আবার বেরিয়ে এসেছে।
কল্যাণের অবশ্য কোনও ক্ষোভ নেই। ঘটনাচক্রে, একটা সময়ে দলের অন্দরে অভিষেকের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কল্যাণ। ভরা কোভিডের সময়ে অভিষেক-বর্ণিত ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’কে প্রকাশ্যেই নস্যাৎ করেছিলেন শ্রীরামপুরের তিন বারের সাংসদ। তার প্রতিবাদে কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় কল্যাণের কুশপুতুল জ্বালিয়েছিলেন অভিষেকের অনুগামীরা। অভিষেকের ভাই আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে একটি পোস্টার পোস্ট করেছিলেন— ‘শ্রীরামপুর নতুন সাংসদ চায়।’ তবে এ-ও বাস্তব যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ প্রকাশ্যে একাধিক বার অভিষেকের নেতৃত্বের তারিফই করেছেন। বলেছেন, ‘‘অভিষেক এখন অনেক পরিণত রাজনীতিক।’’
তবে কল্যাণের প্রচারে অভিষেকের ‘অনুপস্থিতি’ নিয়ে আলোচনা থামছে না। উত্তরপাড়ার এক তৃণমূল নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেছেন, ‘‘অভিষেক যখন একই জেলার বাকি দুই কেন্দ্রে (হুগলি এবং আরামবাগ) এত বার এলেন, তখন তাঁর শ্রীরামপুরে না আসাটা ইঙ্গিতপূর্ণ।’’ রিষড়ার এক যুব তৃণমূল নেতা আবার রসিকতা করে বলেছেন, ‘‘লকডাউনের সময়ে যা ঘটেছিল, তা নিউ নর্মালেও স্বাভাবিক হয়নি।’’
গত জানুয়ারি মাস থেকে তৃণমূলের অন্দরে সবচেয়ে বড় আলোচনা ছিল, অভিষেক ডায়মন্ড হারবারের ‘গণ্ডি’ পেরিয়ে সারা রাজ্যে প্রচারে সময় দেবেন কি না। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেই ‘শৈত্য’ কাটতে শুরু করে। অবশেষে ব্রিগেড সমাবেশের নীল নকশা আঁকা থেকে যাবতীয় প্রচারের কৌশল ঠিক করার কাজে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন সেনাপতি অভিষেক। কিন্তু কল্যাণের শ্রীরামপুরে তাঁর প্রচারে না-যাওয়া নজর কাড়ছে বৈকি!