সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ভাবে কমিউনিস্টদের লড়াই স্রোতের বিরুদ্ধে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
লেখকেরা লেখেন এবং পাঠকেরা পড়েন। কিন্তু সাধারণ ভাবে একটি লেখা প্রস্তুত করার সময় লেখকেরা পাঠকদের নির্বাচন করেন না। সেই জায়গাটা সামান্য বদলাচ্ছি আমরা। তাই এই লেখার শুরুতেই আমরা অভিপ্রেত পাঠকদের নির্বাচন করছি। অভিপ্রেত পাঠক মূলত বামপন্থী কর্মী-সমর্থক এবং কিছু ফেন্স-সিটার যাঁরা সৎ রাজনীতির পক্ষে এবং বামপন্থীদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল, কিন্তু বামপন্থীদের নির্বাচনী বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে আছেন। এবং হয়তো অনিচ্ছার সঙ্গে তৃণমূল বা বিজেপি-কে সমর্থন করছেন বা কাউকেই করছেন না। অভিপ্রেত পাঠকের মধ্যে বামপন্থী নেতৃত্বও আছেন যাঁরা ভাবনায় খুব বেশি নির্বাচন-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছেন এবং তাই হয়তো নির্বাচনে জেতার শর্টকাট খুঁজছেন। এর বাইরেও যদি এই লেখা কেউ মন দিয়ে পড়েন ও সমালোচনা করেন তবে তা শিরোধার্য।
একইসঙ্গে এই লেখাটিকে আমরা দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি। প্রথমত, লেখক যখন অভিপ্রেত পাঠকের দলে, আর দ্বিতীয়ত, লেখক যখন কিছুটা ধন্দে। কিন্তু লেখার উদ্দেশ্য একটিই। সেটি হল পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া যে রাজনীতিতে বামপন্থীদের একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ এবং দায়িত্ব আছে। সেটা পালন করাই, নির্বাচনী জয়-পরাজয় যাই ঘটুক, তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাদের রাজনৈতিক কাজ এবং ভোটে জেতার যেটুকু সম্ভাবনা, তাও শুধু সেই দায়িত্ব পালন করতে পারলেই।
এ বার আসছে প্রেক্ষিত। সাম্প্রতিক কলকাতা পুরনির্বাচনের ফলে ভোট শতাংশে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট। একক দল হিসেবে ধরলে সিপিএম-এর ভোটও বিজেপি-র থেকে সামান্য বেশি। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে বামেদের সমর্থন কমতে থাকার যে প্রবণতা, তা এই প্রথম বদলালো ১০ বছর পার করে। স্বভাবতই বামপন্থীরা বেশ খুশি।
রাজনৈতিক ভাবে ভারতবর্ষে বিজেপি আর বামফ্রন্ট সবথেকে বিপরীতধর্মী। সুতরাং এতে বিজেপি যে খুশি হবে না তা বলাই বাহুল্য। তার উপর তাদের নিজেদের ভোট কলকাতা পুরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ মত কমল। আট মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনে কলকাতা পুর-এলাকায় ২৭.৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। পুরভোটে সেটা তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে ৯.২১। এই প্রসঙ্গে তাদের অভিযোগ, শাসক দল শুধু নিজের জন্যে নির্বাচনী বেনিয়ম করেনি, সঙ্গে বামফ্রন্টকেও অল্প কিছু ভাগ পাইয়ে দিয়েছে। আর তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব হাসিমুখে জানান দিচ্ছেন যে বামপন্থীদের সামান্য ভোটবৃদ্ধিতে তাঁরা খুশি।
অর্থাৎ এই মুহূর্তে তৃণমূলের মূল ঘোষিত মূল শত্রু বিজেপি। বামফ্রন্টের প্রতি শত্রুতা কম। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে বিজেপি এবং তৃণমূল একই তত্ত্বকে সামনে আনছে। বামফ্রন্টের ভোটবৃদ্ধি যেন কিছুটা হলেও তৃণমূলের কৃপাধন্য। অর্থাৎ তৃণমূল এবং বিজেপি দু’জনেই কলকাতা পুরনির্বাচনের আগে কিংবা পরে যে সত্যটাকে সামনে আনতে চাইছে তা হল তারাই মুখোমুখি লড়ছে। অন্য দিকে বামফ্রন্টের মূল প্রচার, তৃণমূল আর বিজেপি-র মধ্যে গোপন আঁতাত। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলকে জায়গা করে দেবে বিজেপি আর দেশ জুড়ে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে বিজেপি-কে সুবিধে করে দেবে তৃণমূল। আপাতত জনগণ কী বিশ্বাস করে কোন দিকে ভোট দেয় তার জন্যে নতুন বছরের শুরুর দু’-একটা মাস অপেক্ষা করতে হবে। সারা রাজ্য জুড়ে আসছে অনেকগুলি পুরনির্বাচন।
বামেদের আসন এবং ভোট যখন ক্রমাগত কমেছে তখন অনেক বার প্রশ্ন উঠেছে এ রাজ্যে বামপন্থী ভাবনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছেন অনেক বামপন্থী কর্মী-সমর্থক এবং তার থেকে পৌঁছেছেন কিছু সহজ নেতিবাচক অনুসিদ্ধান্তে। এখন শতাংশের হিসেবে কিছুটা ভোট বেড়েছে। তাই ইতিবাচক কথাবার্তাও বর্ধমান। এই সময়টাতেই, হারিয়ে যাওয়ার আগে তুলে ধরা যাক একটি কেন্দ্রীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নির্বাচনের ফল দিয়ে কি বামপন্থীদের সাফল্য মাপা যুক্তিযুক্ত? বস্তুত এই ভোটকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বামপন্থী আদর্শের পরিপন্থী নয় কি? ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’-তে মগনলাল মেঘরাজের মুখ দিয়ে সত্যজিৎ রায় বলিয়েছিলেন (সিনেমাটি সন্দীপ রায় পরিচালিত হলেও চিত্রনাট্য সত্যজিৎ রায়ের) – ‘পৈসা কামানোর হাজারো উপায় আছে, মোস্টলি ডিজনেস্ট!’ সে রকমই আমাদের দেশে ভোটে জেতার অনেক উপায় আছে, আর তার অনেকটাই ‘ডিজনেস্ট’। ডিজনেস্ট বলতে শুধু রিগিং বা ভোটের দিনের বেনিয়ম নয়, তা ছাড়াও অনেক বৌদ্ধিক অসততা আছে, অনেক লোক-ঠকানো কৌশল আছে। বামপন্থী রাজনীতি তার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাওয়ার কথা নয়।
তাই এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আরও গভীর একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার, তা হল আজকের পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটি কমিউনিস্ট পার্টির কী প্রয়োজন? কারণ মানুষ কমিউনিস্টদের সমর্থন করবে, নির্বাচনে হোক বা অন্যত্র, তাদের নিজেদের ভূমিকা পালন করার জন্য, অন্য কারও ঠেকা নেওয়ার জন্যে নয়। শ্রমের ন্যায্য মূল্য, কৃষির ন্যায্য মূল্য, কাজের অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, বিজ্ঞানচেতনার প্রসার, পরিবেশরক্ষার লড়াই, এগুলিই তো আজকের দিনে কমিউনিস্টদের কাজ!
তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এগুলিকে একসূত্রে গাঁথতে পারার ক্ষমতা সম্ভবত ভারতের অন্য আর কোনও পার্টির নেই। তাই এগুলো করতে পারলেই কমিউনিস্ট পার্টি তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে, না হলে নয়, সে নির্বাচনে জিতুক কিংবা হারুক। আর এই কাজগুলি করতে পারলেই একমাত্র মানুষ সমর্থন করবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সরকারে থাকলে সিঙ্গুরে কারখানা করার প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু পুঁজিপতিদের দিয়ে কারখানা করানোর জন্য মানুষ বামপন্থীদের ভোট দেবে না, অন্য অনেক পার্টি এই কাজটা একই রকম বা আরও ভাল ভাবে করবে। তাই নিজেদের কাজেই মন দিতে হবে বামপন্থীদের। গত এক দশকে ভারতের বামপন্থীরা এই কাজগুলি কিছুটা করেছে, যেমন কৃষক আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করা, শ্রমিক-কৃষকের সংহতি স্থাপনের দিকে এগনো, ইত্যাদি। অনেক কাজ চলছে, আবার খুব স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক জায়গায় ঘাটতি আছে।
এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ভাবে কমিউনিস্টদের লড়াই স্রোতের বিরুদ্ধে। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে যার হাতে সম্পদ, তার হাতেই ক্ষমতা, তার হাতেই ধর্ম, তার হাতেই প্রচারযন্ত্র। স্রোত সম্পদের আরাধনা, ক্ষমতার আরাধনা, স্রোত হাজার বছরের ধর্মীয় সংস্কার ও কুসংস্কার, স্রোত সামাজিক বিভাজন, স্রোত বিজ্ঞাপন ও প্রচার, স্রোত ক্রমশ দুর্নীতিকে মেনে নেওয়া... ইত্যাদি। আর কমিউনিস্টদের কাজ এই পোড়খাওয়া সিস্টেমটাকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করা। খুব কঠিন কাজ! কারণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরাও সারাদিন এই সিস্টেমের মধ্যে কাটান, তাই এই সিস্টেমের বিভিন্ন রকম ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা হামেশাই। নির্বাচন-সর্বস্বতাও সে রকমই একটি ফাঁদ। আর একটা ফাঁদ হচ্ছে মানুষ যা চাইছে সেটাই দিতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব সেটা হতে পারে না, তাদের কাজ হওয়া উচিত, মানুষকে সঠিক দাবি পেশ করতে শেখানো। সেই জন্যই তো ‘ভ্যানগার্ড’! মানুষ কাজের দাবি করতে পারছে না, ন্যায্য মজুরির দাবি করতে পারছে না, হয়তো তাই সে লক্ষ্মীর ভান্ডারের ৫০০ টাকার জন্য বসে আছে।
ভোটে জেতার অনেক ফিকির আছে। আর তাই নির্বাচনের জয়-পরাজয় অনেক সময়ই ভাল বা খারাপ কাজের সঙ্গে মেলে না। বামফ্রন্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ করেছিল যার জন্য তারা সমর্থন পেত, যেমন ভূমিসংস্কার বা পঞ্চায়েত। কিছু খারাপ কাজ করেছিল যার জন্য তারা কালক্রমে অর্জন করেছিল বিরোধিতাও। আবার এ রকম কিছু ভাল কাজও করেছিল যা সচেতন ভাবে ভোট জোটানো বা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ধান্দায় নয়। এর একটি উদাহরণ বিভিন্ন সার্ভিস কমিশন তৈরি করা, শক্তিশালী করা এবং বেশি বেশি চাকরির পোস্ট সার্ভিস কমিশনগুলোর আওতায় নিয়ে আসা। বলাই বাহুল্য এটাই ছিল উচিত কাজ, কিন্তু এর ফলে চাকরির ক্ষেত্রে পার্টির নিয়ন্ত্রণ অনেক কমে যায়।
মুশকিল হয় যখন সার্ভিস কমিশনগুলো অনেকাংশে অকেজো হয়ে যায়, যখন চাকরি হয় মূলত রাজনৈতিক নেতাদের কৃপায় এবং ঘুষ দিয়ে। মজার ব্যাপার হল যে, যিনি ঘুষ দিচ্ছেন বা একশো দিনের কাজে নিজের প্রাপ্য পয়সা পেতে কাটমানি দিচ্ছেন, তিনিই হয়তো আবার ভাবছেন যে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার দৌলতেই তিনি যা পাওয়ার পেলেন। তাই তিনি ঘুষও দিচ্ছে, আবার ভোটও দিচ্ছেন! এ রকম উদাহরণ আমাদের রাজ্য বা দেশ জুড়ে বর্তমান।
উপসংহারে বক্তব্য এইটুকুই যে কমিউনিস্টদের ভোটে জেতার কোনও শর্টকাট নেই, কোনও ফন্দিফিকির নেই। এমনকি কৌশলের ভূমিকাও সামান্য। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হচ্ছে যে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থেকে বামপন্থী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনেকের মনেও এই নির্বাচন-সর্বস্বতা ঢুকে গিয়েছে। তাঁরাও ভাবছেন কোন কৌশলে একটু ভোট বাড়ানো যায়, কোন গানটা পাবলিক খাবে, মিডিয়া কেন দেখাচ্ছে না... ইত্যাদি। এই প্রেক্ষিতেই বাম রাজনীতির আনুসারীদের মনে রাখা প্রয়োজন যে নির্বাচনী সংগ্রাম কমিউনিস্টদের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না। তাঁরা যে-মানুষ এবং যে-সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার হয়ে নিরন্তর সংগ্রাম চালানোই তাঁদের প্রধান কাজ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, আগামী কোনও একটি নির্বাচনে, সে পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা, যাই হোক না কেন, বামফ্রন্ট জিতল। তাতেই বা খুব নতুন কী ঘটবে? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আবার কয়েক বছর পর তারা হারবে, তার পর আবার হয়তো কোনও সময় জিতবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনীতিকের লক্ষ্য কোনওক্রমে ক্ষমতা দখল করে যতদিন পারা যায় টিকে থাকা, এবং, অসৎ রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে, সেই সুযোগে নিজের সম্পদ যথাসম্ভব বাড়িয়ে নেওয়া। অন্যদিকে বামপন্থীদের লড়াইটা হওয়া উচিত চলমান। একটা ভোট, কিংবা একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে, একটা গোটা প্রজন্মেও অনেক রাজনৈতিক বিতর্কের মীমাংসা হবে না। প্রতিটি প্রজন্মে বামপন্থীদের মূল কাজ সেই লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর নির্বাচনে জেতারও যেটুকু সম্ভাবনা, তা ওই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, দীপাঞ্জন গুহ সঙ্গীতশিল্পী এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ)