গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারতের ভৌগোলিক তথা ভারতবাসীর মানস মানচিত্রে ‘স্থপতি’ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান নিয়ে ভাবতে বসলে দেখা যাবে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর এমন ভাবমূর্তি আর দেখা যায়নি। নয়া দিল্লির কেন্দ্রস্থলে নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ দ্বারা সরকারি পরিকাঠামোর পুনর্বিন্যাসই হোক অথবা বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি নির্মাণই হোক, মোদী সেই সব স্থাপনার দিকেই এগিয়েছেন, যেগুলির প্রতীকী এবং পরিদর্শনযোগ্য তাৎপর্য রয়েছে।
অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের করিডর নির্মাণ এবং একই সঙ্গে হিমালয়ের প্রাচীন তীর্থক্ষেত্রগুলিকে পুণ্যার্থীদের কাছে সুগম করে তুলতে চার ধাম পথ-প্রকল্পের দ্বারা তিনি হিন্দুমানসে নিজেকে দৃঢ়প্রোথিত করতে সমর্থ হয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য ভাবে সম্পদগত দিক থেকে সরকার দেশের ভৌগোলিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের অঙ্গীকার করে রেখেছে। যেমন কেন নদীর সঙ্গে বেতোয়া বা বেত্রবতী নদীর সংযোগের প্রকল্প (এমন অ-বাস্তব ৩০টি প্রকল্পের তালিকার শীর্ষে এটি), নতুন হাইওয়ে এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ‘বুলেট ট্রেন’, উচ্চগতি সম্পন্ন মালবাহী গাড়ি চলাচলের উপযোগী করিডর, নতুন বিমানবন্দর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উন্নততর সংযোগের জন্য বিভিন্ন সেতু নির্মাণ, যার মধ্যে দেশের সব থেকে দীর্ঘ রেল ও সড়ক সেতু (৪.৯ কি.মি) এবং দীর্ঘতম সেতুটিও (১৯ কি.মি) রয়েছে।
এই সব বহুমুখী পরিকল্পনার উপস্থাপন অনিবার্য ভাবে মোদীর সঙ্গে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর তুলনা টেনে আনছে। তাঁর দিক থেকে মোদী বাস্তব এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দুই নৌকায় পা রেখে চলছেন। শেষোক্তটির পিছনে রয়েছে নিজের ভাবমূর্তির অস্বাভাবিক বিবর্ধনের অদম্য প্রচেষ্টা এবং একই সঙ্গে দলের ভিত্তিগত সমর্থক বলয়ে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার প্রয়াস। যদি তুলনা টানা যায়, দেখা যাবে নেহরু সেই সব নির্মাণকার্যের উপর জোর দিয়েছিলেন, যেগুলিকে তিনি ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’ বলে বর্ণনা করতেন। তাঁর নির্মাণকর্মের উদাহরণ দেশের প্রধান জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সমূহ (ভাকরা-নাঙ্গাল, হিরাকুঁদ, রিহান্দ এবং দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা), সেই সঙ্গে দেশে ভারী শিল্পের ভিত্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে ইস্পাত, তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের উপযোগী যন্ত্র উৎপাদন, বাষ্পীয় এবং বৈদ্যুতিক রেল ইঞ্জিন নির্মাণের কারখানা, ট্রেনের কামরা তৈরির কারখানা, সেনাবাহিনীর জন্য সাঁজোয়া গাড়ি তৈরির কারখানা এবং সেই সঙ্গে চণ্ডীগড়ের মতো নগরীর পত্তন।
নেহরু যা নির্মাণ করেছিলেন, তা বাস্তবের পরিকাঠামোকে ছাড়িয়ে অনেক বেশি দূর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। মনে রাখতে হবে, তিনিই মহাকাশ ও পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির গোড়াপত্তন করেছিলেন, বেশ কিছু প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, বেশ কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, একই সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন বেশ কিছু গবেষণা সংস্থা এবং আধুনিক পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে। জাতীয়করণ ও একত্রীকরণের মাধ্যমে তাঁরই উদ্যোগে জন্ম নিয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, জীবনবিমা নিগম, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন এবং এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সংস্থা (মনে রাখা দরকার, নেহরু জমানায় এয়ার ইন্ডিয়ার অবস্থা এতটাই উন্নত ছিল যে, তা সিঙ্গাপুরকে তার আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা নির্মাণে সহায়তা প্রদান করেছিল)।
নেহরুর সঙ্গে মোদীর তুলনা করা অবশ্য সঙ্গত নয়। কারণ প্রথমোক্ত ব্যক্তির শাসনকাল ছিল ১৭ বছর আর মোদী মসনদে রয়েছেন তার ঠিক অর্ধেক সময়। আবার এর বিপরীতে এ কথাও বলা যেতে পারে যে, নেহরুর বেশির ভাগ উদ্যোগই ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দশ বছরের মধ্যে গৃহীত। এমন একটি দেশে এই পরিকল্পনাগুলি গৃহীত হয়েছিল, যার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ছিল নিরক্ষর এবং মানুষের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ছিল মধ্য ত্রিশের আশপাশে। বিস্ময়ের কথা এই যে, নেহরু সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র নিরিখে) বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন এবং আর্থিক বৃদ্ধির হার চার গুণ বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন।
প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে মোদীর অবদান ডিজিটাল পরিকাঠামো নির্মাণে। তিনি আর্থিক ক্ষেত্রের ডিজিটালাইজেশনের কাজটি সম্পন্ন করেছেন, স্টার্ট-আপ ব্যবসার সূচনা ঘটিয়েছেন এবং সরকারের লাভ হয়, এমন সংস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়েছেন। পরিবেশ ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের সাপেক্ষে অর্থনীতির পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন এবং শিল্পোন্নয়নের এক নবপর্যায় সূচিত করতে বৃহৎ আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে চলেছেন।
নেহরু এবং মোদী, উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈপরীত্য— দুই’ই রয়েছে। তাঁরা দু’জনেই আধুনিকীকরণের পক্ষে। কিন্তু মোদী একই সঙ্গে একজন পুনর্জাগরণবাদীও বটে। তাঁরা উভয়েই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির দ্বারা নির্মিত ভিত্তিগত কিছু জায়গাকে এড়িয়ে গিয়েছেন। যেমন, উচ্চগুণগত মানসম্পন্ন সর্বজনীন স্কুল ব্যবস্থা, গণস্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়গুলি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। মোদীর সমালোচকরা বলতেই পারেন, তিনি যতখানি সিমেন্ট আর ইস্পাতের জঙ্গল তৈরির ব্যাপারে লিপ্ত, শাসনকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ততখানি নয়। কিন্তু জওহরলাল দ্বিতীয় বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন। সেই সঙ্গে এ-ও স্বীকার্য যে, মোদীর নির্মাণ ভারতকে আরও ঘনবদ্ধ করে তু্লবে, এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে সন্নিবিষ্ট করে তুলবে। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক ভাবে মানুষকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়েছেন। এর বিপরীতে আবার এ কথাও ঠিক যে বিশালাকার নদীবাঁধকে আজ আর উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা বলে গণ্য করা হয় না। পাশাপাশি মনে রাখা দরকার, একটি নদীর সঙ্গে আর একটি নদীর সংযোগও উন্নয়নের অভিজ্ঞান নয়। শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে হবে যে, নেহরু জোর দিয়েছিলেন সরকারি ক্ষেত্রগুলির উপর, কারণ সেটি ছিল সময়ের দাবি। সেই সময়ে বেসরকারি উদ্যোগ ছিল নিতান্তই সীমিত। কিন্তু নেহরুর সেই নীতি শেষ পর্যন্ত ভাল ফল দেয়নি।