গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উপরের ছবিটা দেখুন। ধ্বস্ত নায়ক। চোখমুখ থমথম করছে। গালের উপর শুকিয়ে আছে চোখের জলের দাগ। ইতিহাস তৈরি করে বিশ্বক্রিকেটের সূতপুত্রতা থেকে সবে রেহাই পেয়েছিলেন। কিন্তু ভঙ্গকুলীন হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাটিতে আছড়ে ফেলেছেন ক্রিকেটদেবতা। সেই মেদিনীতে, যা তাঁর বিজয়রথের চক্র গ্রাসই শুধু করেনি, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
দু’চোখের বাদামি রঙের মণিতে শূন্য দৃষ্টি। কেয়ারি করা দাড়ি মলিন দেখাচ্ছে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল অবিন্যস্ত। কী ভাবছিলেন? দেশের হয়ে ক্রিকেট মাঠে কত কত ভূমিকায় নামতে হয় তাঁকে? কখনও বলবর্ধক তাবিজ। কখনও মন্ত্রপূত কবচ। কখনও আগুয়ান নেতা। কখনও আশা বয়ে-আনা দূত। কখনও জাতির কণ্ঠ। এই কিছু ক্ষণ আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন দেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শৃঙ্গ আরোহণের স্বপ্নযানের চালক। উত্তরণের স্টিয়ারিং ধরা ছিল তাঁরই হাতে।
মাত্র ১১৫ রানের পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশকে হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে উঠেছিলেন। ক্রিকেটবিশ্ব আলোড়িত তাঁদের নিয়ে। তাবড় ক্রিকেটলিখিয়েরা বলছেন, কারা লেখে এঁদের স্ক্রিপ্ট? নিজেরাই উত্তর দিচ্ছেন— নিয়তি!
নিয়তিই বটে! যুদ্ধ আর ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত একটা দেশ। তালিবান শাসনের নাগপাশে আক্রান্ত। পোকামাকড়ের মতো মরে মানুষ। জীবনের দাম প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে কমতে থাকে। মনে আছে, আফগান যুদ্ধ কভার করতে যেতে চাই শুনে খালেদ হুসেইনির ‘দ্য কাইট রানার’ পড়ে (এবং পরে সিনেমাটা দেখে) কল্পনার আকাশে মনের ঘুড়ি উড়িয়ে দেওয়া বেয়াড়া সাংবাদিককে তৎকালীন বস্ বলেছিলেন, ‘‘মাথা খারাপ নাকি! তোকে মরুভূমির একেবারে মধ্যিখানে নিয়ে গিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে, ডলারগুলো কেড়ে নিয়ে, পশ্চাদ্দেশে একটি লাথি মেরে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। পুশতু ভাষা ছাড়া কিছু বলে না। বোঝেও না। তোর হিন্দি-উর্দু ওরা বুঝবে না। বুঝলেও না বোঝার ভান করবে। ওই মরুভূমিতেই না খেতে পেয়ে মরে পড়ে থাকবি!’’
সেই ক্যানভাস থেকে এক ধীর, নিশ্চিত এবং চমকপ্রদ উত্থান! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ ম্যাচে নিউ জ়িল্যান্ড এবং সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। বাংলাদেশকে হারিয়ে একাধারে সেমিফাইনালে ওঠা এবং তার চটকায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়। সাফল্য যখন উপুড়হস্ত, ইতিহাস লিখে গোটা টিম যখন তূরীয় আনন্দে ভাসছে, দেশের রাস্তায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটানো শিশুরা যখন উদ্দণ্ড নেচেটেচে ক্লান্ত হয়ে চাট্টি ঘুমোতে গিয়েছে জেগে উঠে আরও একটা তেজিয়ান জয় দেখবে বলে, তখনই ক্রিকেট বোঝাল, সে-ও আসলে জীবনের মতো। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দাঁড়িপাল্লায় দু’দিকেই সে সমান ওজনের বাটখারা চাপিয়ে রাখে।
ডাগ আউটে বসে-থাকা মুহ্যমান রশিদ খানকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, নিয়তি কারও কারও চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। কিন্তু কলমের কালিটাও জোগাতে হয়। নচেৎ নিয়তিদেবী বসে কলম কামড়ান। আর জীবনের পৃষ্ঠা সাদা থেকে যায়।
রশিদ খানকে ওই জীবন্মৃত অবস্থায় বসে থাকতে থাকতে তাঁর অভিযাত্রার কথা মনে পড়ছিল। ১০ ভাইবোন। জালালাবাদের আদি বাসিন্দা। যদিও তাঁর জন্ম পূর্ব আফগানিস্তানের নানগরহর নামে এক আধা শহরে। সেখানে তাঁদের পরিবার টায়ারের ব্যবসা করত। বড়লোক না হলেও একেবারে হ্যাক-ছিও নয়। আফগান যুদ্ধের সময় (পেশাগত অভিজ্ঞতার তাড়নায় যে যুদ্ধ কভার করতে যেতে চেয়েছিল কলকাতার এক ডেঁপো সাংবাদিক) তাঁর পরিবার ব্যবসা গুটিয়ে পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানেই ভাইদের সঙ্গে খেলতে খেলতে তাঁর জীবনের ক্রিকেটখড়ি। বোলিংয়ে ‘আদর্শ’ ছিলেন পাক অলরাউন্ডার শাহিদ আফ্রিদি। তাঁর বোলিং অ্যাকশন নকলও করতেন। ব্যাটিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডিভিলিয়ার্স। প্রথমে ব্যাটটাই মন দিয়ে করতেন (সম্ভবত সে জন্যই আইপিএলে মাঝেমধ্যে স্নায়ুর উপর বিপুল চাপ নিয়েও ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ-জেতানো ইনিংস খেলে বসেন)। পরে লেগ স্পিনে ঝুঁকে পড়েন পেশোয়ারের ইসলামিয়া কলেজে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কম্পিটার সায়েন্সের ছাত্র। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। লেখাপড়াটা আর হয়নি। কিন্তু তাতে কী! ঢুকেছিলেন তো সেই স্পোর্টস কোটায়। খেলা-খেলা-পড়া।
কয়েক মাস আগে এক ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া রশিদ খানের সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছিল। ‘‘আঙুলে এনার্জিটা টের পেলে বুঝতে পারি ভাল বল করছি। উপরওয়ালার দয়ায় আমার আঙুলগুলো অন্য অনেক স্পিনারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু আঙুলে এনার্জির তরঙ্গ টের না পেলে নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না। মনে হয়, আমি নই, মাঠে অন্য একটা লোক বল করছে। আমি ঠিক যে ভাবে চাই, সে ভাবে বলটা আমার হাত থেকে বেরোচ্ছে না। সে যতই উইকেট পাই না কেন!’’
শুধু গুগলিরই তিন রকম প্যাঁচ রয়েছে রশিদ খানের আঙুলে। প্রথমটা সকলের মতো। গুগলি যেমন হয়। দ্বিতীয়টা সামান্য উঁচু থেকে ছাড়া। যাতে পিচ পড়ার পর বাউন্স বেশি হয়। তৃতীয়টা মধ্যমার পিছন থেকে ছাড়া। যাতে গতি সামান্য শ্লথ হয়। স্পিনটা ভাঙে একটু দেরিতে এবং একটু বেশি। এই তিন রকম গুগলির সঙ্গে ‘ফ্লিপার’ আছে। কখনও-সখনও ‘সিম আপ ডেলিভারি’ আছে। যদিও ওই ডেলিভারিটা তিনি ছাড়েন একটু তেরছা করে, তালুর পাশ থেকে।
কিন্তু সে সব ‘শিল্প’ এই মানুষটিকে গড়েনি। তাঁকে গড়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই স্পটে বল ফেলে যাওয়ার শৃঙ্খলা, সাধনা, এনার্জি, জেতার জন্য বন্য-উদগ্র তীব্রতা আর দলের জন্য ঘামের শেষ বিন্দুটুকু ব্যয় করার প্যাশন। সেই তিনি ওই বসে আছেন। বিফল পরিশ্রমের স্বেদবিন্দুর সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে মন ভেঙে দেওয়া অশ্রুবিন্দু।
রশিদ খানকে বলা হয় ‘আফগান ক্রিকেটের সচিন তেন্ডুলকর’। তিনি আফগানিস্তানের ক্রিকেটে অশ্রুতপূর্ব পেশাদারিত্ব এনেছেন। বাংলাদেশকে হারানোর পরে আফগান টিমের সহকারী কোচ রইস আহমদজ়াই ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে বলেছিলেন, ‘‘এটা ফ্লুক নয়। এটা আমাদের অর্জিত সাফল্য। আমরা খুব ভিতর থেকে মনে করেছিলাম, আমাদের প্রথম চারে যাওয়ার যোগ্যতা আছে। সেই ক্ষমতাও আছে। আমরা পরিশ্রম করেছি, পারফর্ম করেছি, আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি।’’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সাধে ২০২৩ সালের ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের পরে আফগানিস্তানে ক্রিকেট অ্যাকাডেমির সংখ্যা হু-হু করে বেড়েছিল! স্বপ্নের ডানায় ভর করে আফগান ক্রিকেট যে আশ্চর্য উড়ান নিয়েছিল, সেটাই তাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।
স্বপ্ন দেখা আসলে এক ছোঁয়াচে রোগ।
কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তব করতে কিছু অনুঘটকও লাগে। তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের কাছে সেই ভূমিকায় হাজির হয়েছিল আইপিএল। রুজির ধান্দায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে বেড়ান আফগানিস্তানের ক্রিকেটারেরা। সেই সুবাদেই তাঁরা এসে পড়েছিলেন পৃথিবীর ধনীতম ক্রিকেট লিগের গ্রহে। রইসের কথায়, ‘‘আইপিএল খেলতে গিয়ে আমাদের ছেলেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। ওরা পৃথিবীর বড় বড় সব ব্যাটারের উইকেট নিয়েছে। দুনিয়ার তাবড় বোলারদের মোকাবিলা করেছে। আইপিএলের মতো কঠিন মঞ্চে আমাদের ছেলেরা পৃথিবীর সেরা বোলারদের পিটিয়ে রান করেছে। সেখান থেকে ওদের এই বিশ্বাসটা তৈরি হয়েছে যে, ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির হয়ে যদি এই পারফরম্যান্স করতে পারি, তা হলে দেশের হয়েও এই খেলাটা আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলতে পারি।’’
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান টিমে যে ১১ জন খেলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আট জনই আইপিএলে খেলেন। ক্যাপ্টেন রশিদ খান খেলেন গুজরাত টাইটান্স নামক চ্যাম্পিয়ন ফ্র্যাঞ্চাইজ়িতে (২০২৩ সালের আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। যদিও এ বছরের আইপিএলে খানিকটা নিষ্প্রভ ছিলেন। ছন্দ ঠিকঠাক ছিল না। ১০ ম্যাচে মাত্র ১২ উইকেট। ওভারপ্রতি গড় রান ৮.৪০। কিন্তু তাতে ভড়কে যাননি)। টাকাপয়সা তো আছেই। কিন্তু আইপিএল আফগানিস্তানের উঠতি ক্রিকেটারদের মধ্যে একটা দুর্মর আশাবাদ তৈরি করেছে। রইসের কথায়, ‘‘সকলে শুধু আইপিএল খেলে টাকা কামানোর কথাটাই বলে। টাকা আছে ঠিকই। কিন্তু পারফর্ম না করলে কি কেউ শুধু শুধু টাকা দেয়? না কি ক্রিকেটারদের উপর বাজি ধরে? ট্যালেন্ট না থাকলে কেন টাকা লগ্নি করবেন দল মালিকেরা? আমাদের ক্রিকেটারদের স্কিল আছে। তাই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি মালিকেরা তাদের উপর টাকা লগ্নি করছেন। সেটাই দেশের বাচ্চাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।’’
স্বপ্ন দেখা আসলে এক ছোঁয়াচে রোগ।
উপরের ছবিটা আরও এক বার দেখুন। ওই যে বসে আছেন পঁচিশ বছরের স্বপ্নদ্রষ্টা। আফগানিস্তানের টি-টোয়েন্টি দলের নেতা। থমথমে মুখ। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। গালের উপর রেখে গিয়েছে অব্যর্থ দাগটুকু। রথচক্র গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্ডারগার্টেনের ছাত্রদের মতো ব্যাট করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের বিশ্বকাপে সর্বনিম্ন স্কোর করেছে তাঁর দল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দলগত স্কোরও তাঁরই দলের নামের পাশে লেখা— ছাপ্পান্ন অল ডাউন! দক্ষিণ আফ্রিকা যে রানটা হেলাফেলায় তুলে দিল একটু আগে।
ছবিটা আরও এক বার দেখুন। নিজের ভিতরের আওয়াজ কি শুনতে পাচ্ছিলেন রশিদ খান? সে আওয়াজ কি তাঁকে বলছিল, নিয়তি চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। কিন্তু কলমের কালিটা নিজেকে জোগাতে হয়। নয়তো নিয়তিদেবী চুপচাপ বসে শুকনো কলম কামড়ান আর জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠা সাদাই থেকে যায়।