Cricket

একমাত্র প্রেম, একমাত্র নেশা, একমাত্র ধর্ম, কারণ ক্রিকেটই পারে, একমাত্র!

ক্রিকেটই পারে সাধারণ মনুষ্যকে মহামানব করতে। ব্যাকফুটে দাঁড়িয়ে লং অনের উপর দিয়ে মারা ধীমান ছক্কার পর কোহলিকে হঠাৎ ‘অ্যাটলাস’ মনে হতে থাকে।

Advertisement
অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২২ ০৭:৪৪

ঘোর কাটছে না। কিছুতে কাটছে না। কাটছেই না!

কিসের ঘোর? বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে ওই ভাবে হারানোর ঘোর? না। বিরাট কোহলীর আধিদৈবিক পারফরম্যান্সের ঘোর? উঁহু, তা নয়। হার্দিক পাণ্ড্যর কান্নার ঘোর? নাহ্। ডাগ আউট থেকে দৌড়ে এসে রোহিত শর্মার ‘চেজমাস্টার’কে কোলে তুলে নেওয়ার মতো বৈগ্রহিক ছবির ঘোর? না। সুভদ্র এবং রুচিশীল বলে খ্যাত টিম ইন্ডিয়ার কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের ঠোঁটের কুঞ্চন পড়ে নিয়ে বোঝা যে, তিনি প্রায়, প্রায় চার অক্ষরের শব্দটা বলেই ফেলেছিলেন! সেই ঘোর? নাহ্। প্রিয় শিষ্যের জয়ের তর্জনে রবি শাস্ত্রীর উচ্ছ্বাসের ঘোর? না। বাউন্ডারির দড়ির বাইরে সত্তরোর্ধ্ব কিংবদন্তি সুনীল গাওস্করের উল্লম্ফনের ঘোর? নাহ্, তা-ও নয়।

Advertisement

আসলে ক্রিকেটের ঘোরটা কাটছে না। রবিবার রাত থেকে এতগুলো ঘণ্টা চলে গিয়েছে! ভারত-পাক মহাকাব্যিক ম্যাচের খোঁয়াড়িও কেটে এল প্রায়। ওয়াঘার ওপারে টিভি ভাঙার ভিডিয়ো এসে গিয়েছে। তা নিয়ে এ পারে যথেষ্ট খিল্লির হ্যাংওভারও ফুরোতে বসল। গোটা ভারত এখন তৈরি হচ্ছে আস্তিন গুটিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরের ম্যাচগুলোর জন্য। যার প্রথমটা বৃহস্পতিবার। ‘ডুডু-ভাতু’ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। পরেরটা রবিবার। বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। বড়দের ম্যাচ।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু ক্রিকেটের ঘোরটা কিছুতেই কাটছে না। যত বার রবিবারের ম্যাচের হাইলাইট্স দেখাচ্ছে (আর স্টার স্পোর্টস সেটা হুলিয়ে দেখাচ্ছেও বটে), হাঁ করে দেখছি। সেই প্যাকেজের প্রতিটা বিন্দুর নড়াচড়া মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। ধারাভাষ্যকারের প্রতিটা বাক্য এত বার শুনেছি যে, লিপ সিঙ্ক করতে পারি অনায়াসে। তবু একঘেয়ে লাগছে না। বোর লাগছে না। মনে হচ্ছে, শুধু ওই জাদুবাস্তবের মুহূর্তগুলো নিয়ে মশগুল থেকে আরও অনেকগুলো রাত কাটিয়ে দিতে পারি।

আর অবধারিত ভাবে মনে হচ্ছে, এত জারজায়নের পরেও ক্রিকেট খেলাটা কিন্তু থেকে গেল। টেস্ট ক্রিকেট থেকে ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল। ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল থেকে টি-২০। ইদানীং কোথাও কোথাও টি-১০ পর্যন্ত। কত কত বদলেছে ক্রিকেট! লাল বল থেকে সাদা বল। সাদা বল থেকে গোলাপি বল। শুধু দিনের টেস্ট থেকে দিনরাতের টেস্ট। সাদা ফ্ল্যানেলের শার্ট-ট্রাউজার্স থেকে ঝলমলে রঙিন জার্সি। সেই তাৎক্ষণিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞান নাম-নম্বর জ্ঞাপক জার্সির টেস্ট ম্যাচের সাদা জার্সিতেও উঠে আসা। দিন থেকে রাত। স্কিলের বদলে পাওয়ার। মাঠে আমুদে সময়চারণ থেকে জিম, সিক্স প্যাক্‌স, পাওয়ার লিফটিং। ফ্রি-হ্যান্ড কসরত থেকে থেরা ব্যান্ডের শাসনে দেহকে বেঁধে ফেলা। ভদ্রলোকের খেলা থেকে আগ্রাসী পেশাদারের দাঁত-নখ বার করা যুদ্ধ। শুরু শুরুতে ‘ভি’-এর মধ্যে সোজা সোজা খেলার বদলে দরকারে প্রথম ডেলিভারি থেকেই সুইচ হিট, আপার কাট বা রিভার্স সুইপ। প্লেয়ার্স কোটায় চাকরি-পাওয়া মাস মাইনের অ্যামেচার থেকে পাঁচ কোটি টাকার হাতঘড়ি এবং ইন্ডোর সুইমিং পুল-সহ ডুপ্লে কেনার সামর্থ্যধারী ক্রিকেটার। রোদ্দুরে কুঁচকে-যাওয়া খালি চোখের বদলে ওকলে এম-ফ্রেম ঝকমকে রোদচশমা। ঢুলঢুলে সোয়েটারের বদলে কলার-তোলা জাম্পার। ব্যাকব্রাশ বা বাঁ-দিকে সিঁথির বদলে মাথার দু’পাশে চাঁছা, মধ্যে রঙিন চুল, কানে হিরের স্টাড। উল-কাঁটার বদলে পানমশলা।

এত কিছু বদলে গেল। কিন্তু ক্রিকেট তার মহত্ব হারাল না। কারণ, একমাত্র ক্রিকেটই সামান্য মানবকে মহামানব বা অতিমানব করতে পারে। একমাত্র ক্রিকেট!

একদা ক্রিকেট খেলে বড় হতে চেয়েছিল যে ছেলেটি, জীবনের নানা কুম্ভীপাকে পড়ে যাকে একটা সময়ে লেখাপ়ড়ায় বেশি মনোযোগী হয়ে পড়তে হয়েছিল, সে অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে বেরিয়ে আউট্রাম রোডে কালীঘাট মাঠের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সিএবি-র লিগ ক্রিকেটের মুনুপুষু ম্যাচগুলোও দেখত। প্রেস কনফারেন্সের সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়। কিন্তু তখন অমুক বোলারটা ব্যাপক টার্ন করাচ্ছে। আর একটা ওভার দেখে যাই, তাকে অবধারিত দেরি করিয়ে দিত।

পূর্ব কলকাতার মধ্যবিত্ত এবং এজমালি আবাসনের মাঠে আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট খেলতে খেলতে সে এতটাই মগ্ন থাকত যে, আবাল্যসুহৃদের সঙ্গে রান আউট নিয়ে তুঙ্গ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে একবারও ভাবত না। বান্ধবী বাড়িতে এসে বসে থাকলেও হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ শেষের আগে ফিরে তাকাত না। বারান্দা থেকে বোন হাত-টাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কভারে ফিল্ডিং করতে করতে খানিক তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলত, ‘‘বসতে বল! বসতে বল!’’ তার পরে মান-অভিমানের যে অভিঘাত সামলাতে হত, তা আর কহতব্য নয়। কিন্তু ক্রিকেটের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার বিনিময়ে সেটাতেও সে রাজি ছিল।

ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখবে বলে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রবাসে চাকরি করার সময় কিঞ্চিৎ অনৃতভাষণ করে ভালমানুষ বসের থেকে ছুটি নিয়ে বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরে যেত সে। তার পর বেশি দুধ দিয়ে ঘাঁটা কফি বানিয়ে গাব্দা থার্মোফ্লাস্কে ভরে মেঝেতে পাতা গদিতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে মগনলাল মেঘরাজের মেজাজে বসত সেই যুবক। মোবাইল ছিল না। ল্যান্ডলাইন অফ দ্য হুক। জগৎসংসারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ম্যাচ শেষের পর দেখা যাবে দেশ-দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে!

ক্রিকেট যখন একমাত্র নেশা। ক্রিকেট যখন একমাত্র প্রেম।

ক্রিকেট যখন একমাত্র নেশা। ক্রিকেট যখন একমাত্র প্রেম।

এখনও এই মধ্য বয়সে পৌঁছেও ক্রিকেটই সে লোকের একমাত্র প্রেম। একমাত্র নেশা। একমাত্র ধর্ম। একমাত্র নিশির ডাক।

যে ডাক উপেক্ষা করতে না-পেরে মধ্য পঞ্চাশেও সে সল্টলেকের শপিং মলের ছাদে টাঙানো মশারির মধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নির্দ্বিধায় ‘টার্ফ ক্রিকেট’ খেলতে চলে যায়। উদ্যোক্তাদের চমকে দিয়ে দলবল নিয়ে ফাইনালে ওঠে এবং সেই তুমুল উত্তেজনার ম্যাচে বাউন্ডারি হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে ঈষৎ পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারের সঙ্গে বেদম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে।

এখনও সে লোক দিনে-রাতে হামেশা স্পোর্টস চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, কোথাও কোনও ক্রিকেট ম্যাচ (সে লাইভ হোক বা পুরনো) দেখাচ্ছে কি না! ভারতীয় মহিলা দলের ম্যাচ হোক, দুনিয়ার অন্য প্রান্তে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ হোক, অস্ট্রেলিয়ায় মহিলাদের বিগ ব্যাশ হোক বা দেশের রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফি অথবা ইরানি ট্রফি। ক্রিকেট হলেই হল!

রবিবার রাতে মনে হচ্ছিল, ভাগ্যিস দেখি! কারণ, একমাত্র ক্রিকেটই পারে এক সাধারণ মনুষ্যকে মহামানব বানিয়ে দিতে। ব্যাকফুটে সটান দাঁড়িয়ে হ্যারিস রউফকে লং অনের উপর দিয়ে মারা ধীমান ছক্কার পর বিরাট কোহলীকে হঠাৎ ‘অ্যাটলাস’ মনে হতে থাকে। মনে হয়, লোকটা দেড়শো কোটি লোককে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তাকে আরও চকচকে, আরও উজ্জ্বল দেখায়। তার যাবতীয় আতিশয্য, যাবতীয় আগ্রাসন, যাবতীয় উচ্চকিত ভঙ্গিভাঙ্গা মুছে যেতে থাকে। যখন মনে হয়, এই অনতি-অতীতেও বিবিধ বিশেষজ্ঞ (তাঁরা কেউই খুব একটা ফেকলু নন) বলতে শুরু করেছিলেন, বিরাট কোহলীকে কি অস্ট্রেলিয়াগামী বিশ্বকাপের টিমে আদৌ রাখা উচিত, তখন সামান্য হলেও মনে মনে একটু অপরাধবোধ হয়। মনে হয়, ছেলেটার মধ্যে নিষ্ঠা আছে। একমুখিতা আছে। তেজ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, দায়িত্ববোধ আছে। বোধহয় অতটা না বললেও হত।

একমাত্র ক্রিকেটই পারে এমন ভাবাতে! একমাত্র।

ক্রিকেটই পারে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। শেখায় বিশ্বাস করাতে।

ক্রিকেটই পারে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। শেখায় বিশ্বাস করাতে।

বিরাট কোহলীকে ভারতীয় ইনিংসের নবম ওভারে যেমন লাগছিল, উনবিংশ ওভারে আর তেমন লাগে না। প্রথম দিকে যে অনুজ সহকর্মী বলেছিল, বিরাট পারছে না, অক্ষর পটেল রান আউটটাও তো হল ওর জন্য, ওরই তো কল ছিল। সেই সহকর্মীই ম্যাচের পর বলে, ভারতের শেষ ৩১ রানের মধ্যে ৩০ রান তো কোহলীই করল! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তফাত মাত্র ১০টা ওভারের। একটা ঘণ্টার। তার মধ্যেই একটা লোকের সম্পর্কে ধারণা ওলটপালট হয়ে যায়। বিরক্তি বদলে যায় বিশ্বাসে।

ক্রিকেটই পারে। একমাত্র ক্রিকেটই পারে!

পৃথিবীর বৃহত্তম স্পোর্টিং এরিনা মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড জুড়ে শব্দব্রহ্মের অবিরল, অবিশ্রান্ত, মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ। পলকে পলকে পাল্টে যাচ্ছে ৯০ হাজার মুখ, ৯০ হাজার জোড়া চোখের দৃষ্টি। হর্ষ, বিষাদ, আশা, হতাশা— খেলে যাচ্ছে একের পর এক রং।

একমাত্র ক্রিকেটই এই রংধনু দেখাতে পারে! জাদু! মায়া। বিভ্রম।

একদা উপেক্ষিত, অপমানিত, কোণঠাসা যুবক আকাশের দিকে আঙুল তোলে। তার কৃচ্ছ্রসাধনকৃত ধারালো চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে চায় বেভুল জলের ধারা। সতীর্থেরা ঘেঁটে দিতে থাকে তার ঘামে-ভেজা মাথার চুল। ম্যাজিক! পরাবাস্তব! ক্রিকেটই পারে।

হাজার হাজার মাইল দূরে এক মধ্যবয়সিকে ঘিরে দাঁড়ায় আউট্রাম রোডের পাশে গাড়ি দাঁড়-করিয়ে খেলা দেখতে-থাকা ফাঁকিবাজ তরুণ। বান্ধবীকে আপাত-অনাদরে বাড়িতে বসিয়ে রাখা উদাসীন প্রেমিক। অফিসে গুল মেরে বাড়ি ফিরে বিশ্বকাপ দেখতে বসা যুবক। নীল দৈত্যাকার মশারির মধ্যে থেকে বাইরের দর্শককুলের সঙ্গে ২০০ ডেসিবেলে গলা-চড়ানো নেশাড়ু ক্রিকেটার। তারা সমস্বরে বলে, এখনও ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে আছিস? বেশ করেছিস! ক্রিকেটই পারে। একমাত্র ক্রিকেটই পারে।

মধ্যবয়সি নিশ্চিন্ত হয়ে রিমোটে অভ্যস্ত আঙুল রাখে। প্রেম-ধর্ম-নেশা-নিশির ডাকের ককটেলে ঘোর ক্রমশ ঘনঘোর হয়।

(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

আরও পড়ুন
Advertisement