বিশ্বাস থাকুক
নন স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে পিচের মাঝখানে এসে সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে ‘বাও’ করলেন দীনেশ কার্তিক। সদ্য টেনশনমুক্তি ঘটেছে তাঁর।
ড্রেসিংরুম থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলেন রবীন্দ্র জাডেজা। শেষ ওভারে অবিমৃশ্যকারী এবং বালখিল্য শট নিয়ে টিমকে গভীর গাড্ডায় ফেলে এসেছিলেন। জাতীয় ভিলেন হতে হতে বেঁচে ফিরলেন!
কুর্নিশরত দীনেশের সম্মান প্রদর্শনের প্রত্যুত্তরে তিনি হাসলেন। দরাজ হাসি। পরিতৃপ্তির হাসি। তার পর ডান হাতের মুষ্টি ঠেকালেন সতীর্থের বাড়িয়ে দেওয়া দস্তানাবদ্ধ মুঠোয়। কয়েক পা এগিয়ে জাডেজার আলিঙ্গনে ধরা দিলেন। কিন্তু বাঁধা পড়লেন না।
এই মাত্র একটা থ্রিলারের শেষ পাতাটা লিখে ওঠা লোকটার মুখে মৃদু হাসি। চোখেমুখে সমাহিত ভাব। একটু কি বেশি সংহত? একটু কি বেশি সংযত? লোকটাকে কি দেখতেও একটু ভাল হয়েছে আগের চেয়ে? শিরস্ত্রাণের তলায় দুই অচঞ্চল চক্ষু। অপলক। ধীর লয়ে সেই চোখের পলক পড়ছে। আবার খুলে যাচ্ছে। মাথাটা এক বার হেলল ডান দিকে। হেলল শুধু। ঝুঁকল না। শোনা গেল অশ্রুত অভয়বাণী— আছি! ২২ গজ দূরে দাঁড়ানো নার্ভাস সতীর্থের কাছে চোখের ইশারায় ভেসে এল নিশ্চিত বরাভয়।
মরুশহরের স্টেডিয়ামে সময় থমকে গিয়েছে। দম ধরে বসে আছে ১৩৮ কোটির আসমুদ্রহিমাচল। লং অন-মিড উইকেটের মাঝামাঝি দিয়ে পরের ডেলিভারিটা উড়ে গেল গ্যালারিতে। গণবিস্ফোরণ ঘটল চরাচরে। লোকটা শুধু মৃদু হাসল। গ্লাভস খুলে ডান হাতটা এক বার আকাশের দিকে তুলল। তার পর গরিমা বিছিয়ে থাকা পথে যাত্রা শুরু করল ড্রেসিংরুমের দিকে।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ভারত-পাক ম্যাচের টেম্পো তোলানোর জন্য সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ঠিকই বলানো হয়েছিল রবি শাস্ত্রীকে দিয়ে। ‘‘দিস ইজ মোর দ্যান আ ক্রিকেট ম্যাচ!’’ যে ম্যাচে দর্শককুল সেনাবাহিনী হয়ে যায়। মাঝমাঠের ২২ গজ হয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। স্টেডিয়ামকে কলোসিয়াম মনে হয়। আর ক্রিকেটারদের মনে হয় গ্ল্যাডিয়েটর।
গ্ল্যাডিয়েটরই বটে!
হার্দিক পাণ্ড্যকে দেখে সেটাই মনে হচ্ছিল। ক্ষতস্থানের রক্ত মুছে, সেলাই করে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। তফাত একটাই— তাঁর অন্তরের যোদ্ধা আর বাইরে বেরিয়ে বহ্বাস্ফোট করে না। সে ভিতরে ভিতরে নিজেকে তৈরি করে বৃহত্তম মঞ্চের জন্য। সেই যোদ্ধা মন আর স্নায়ুকে শাসন করে। সেই যোদ্ধা আয়ত্ত করেছে পরিমিতিবোধ। আয়ত্ত করেছে অচঞ্চলতার পাঠ।
জীবন কিংসাইজ কাটানোর দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। একটা সময়ে তাঁর হোয়াট্সঅ্যাপ স্টেটাসে লেখা থাকত, ‘আ কিং ইজ অলওয়েজ আ কিং’। যাপনে ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা ছিলেন তাঁর আদর্শ। দু’কানে ঝকঝক করছে প্রমাণ সাইজের হিরের ‘স্টাড’। বাহুজোড়া ট্যাটু। অক্লেশে ৪০-৫০ লক্ষ টাকার ঘড়ি কিনে ফেলছেন! সুন্দরীদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করছেন! টেলিভিশনের টক-শোয়ে গিয়ে বারফট্টাই করে বলে আসছেন, কী ভাবে জীবনে প্রথম যৌনসঙ্গম করে বাড়ি ফিরে এসে বাবা-মা’কে বলেছিলেন, ‘‘করকে আয়া হুঁ!’’
সেই ট্যাটু এখনও ফিকে হয়ে যায়নি।। কানের লতিতে সেই হীরকখণ্ড এখনও ঝলমল করে। কিন্তু এই হার্দিক ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সেরা হয়ে ৫,০০০ ডলার পুরস্কারমূল্যের অভিজ্ঞানমূলক বোর্ডটা মাটিতে নামিয়ে রাখেন। বরং বুকের কাছে আঁকড়ে রাখেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি। এবং পরে টুইট করেন, ‘দ্য কামব্যাক ইজ বেটার দেন দ্য সেটব্যাক’। বিপত্তির তুলনায় প্রত্যাবর্তন ভাল।
বেটার? তুলনায় ভাল? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? বেস্ট! সেরার সেরা! চরম!
এ আসলে এমন এক কামব্যাক-কাহিনি, যা শুরু হয়ে শেষ হতে চায় না। বা শেষ হলেও একটা বিনবিনে রেশ রেখে যায়। বাতানুকূল যন্ত্র থেকে বেরিয়ে-আসা আরামের মতো। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে চোট পেয়ে স্ট্রেচারে মাঠ ছেড়েছিলেন। ফিরেছিলেন এই ড্রেসিংরুমে। এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এই স্টেডিয়ামে। ২০২২ সালে দেশকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন। ফিরলেন সেই ড্রেসিংরুমে। সেই এশিয়া কাপে। সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সেই মাঠেই। এ কি জীবন? না লোকগাথা? নাকি রূপকথা?
আগে হলে মনে হত, কে লেখেন এই যুবকের জীবনের স্ক্রিপ্ট? হার্দিক পাণ্ড্যর প্রত্যাবর্তনের কাহিনি বলছে, লেখেন তিনি নিজেই।
ম্যাচটা দেখতে বসেছিলাম (গোটা ভারতই বসেছিল) সিংহাসনচ্যুত সম্রাটের প্রত্যাবর্তন দেখতে। এক মাস বিশ্রাম নিয়ে যিনি আরও ধারালো, আরও ঝকঝকে হয়ে ফিরবেন।
প্রথম বল অফস্টাম্পের বাইরে। ব্যাট তুলে নিশ্চিন্ত জাজমেন্ট। ফলো-থ্রু শেষ করতে করতে তরুণ বোলার আফসোসই করে ফেললেন! যেন আর একটু হলেই! স্বাভাবিক। ভারত-পাক হাই টেনশন ম্যাচে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছে তাঁর। ভিতরের অ্যাড্রিনালিন একটু বেশিই ঝরছে। তারই কিছু উপচে এল সংযমের কূল ছাপিয়ে। হেলমেটের আবডালে বিস্মিত দৃষ্টি এবং হাতের প্রশ্নসূচক মুদ্রায় বোঝা গেল, বিপক্ষ বোলারের সেই বালখিল্যতা এবং অতি উৎসাহে খানিক অবাকই হলেন সম্রাট।
পরের বল আবার অফস্টাম্পে। এ বার একটু টেনে দেওয়া। পা এবং ব্যাট বাড়ালেন রাজা। খানিক ‘অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য বডি’ কি? সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ভীমবেগে বল উড়ে গেল দ্বিতীয় স্লিপে। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল দিগ্দিগন্তে। ক্যাচটা পড়ল। বিরাট কোহলীর নিশ্বাস পড়ল। সঙ্গে সারা ভারতের।
পরে কয়েক ওভারে দুটো ডেলিভারি ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্প ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙল না। তবে তার মধ্যেই কিছু জাদুকরী মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল। চাবুক এবং তাঁর ট্রেডমার্ক পুল শটে বাউন্ডারি। বাউন্সারে হুক শট মিসহিট হয়ে উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা। কভারের উপর দিয়ে তুলে সপাটে চার।
কিন্তু কোথাও একটা তালমিল হচ্ছিল না। ব্যাটের সঙ্গে বলের নরম, আদুরে এবং ঈপ্সিত সংযোগ ঘটছিল না। মস্তিষ্ক থেকে পেশিতে মোটর সঙ্কেত কি সামান্য দেরিতে আসছিল? নিজের উপর হতাশা এবং বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন আপাত-কক্ষচ্যুত সম্রাট। ব্যক্তিগত ৩৫ রানের মাথায় যে আউটটা হলেন, সেটাও ‘বিরাটোচিত’ নয়। হাফ হার্টেড। খানিকটা অনিচ্ছাও ছুঁয়ে ছিল কি শটটায়? খানিকটা আলগোছ? কে জানে! উইকেটে সম্ভবত বল খানিকটা থমকে আসছিল। স্পিনারকে তুলতে গিয়েছিলেন লং অফের উপর দিয়ে। হল না। হয় না। সময় খারাপ থাকলে হয় না। চারদিকটা যেন একটু মেঘলা হয়ে গেল। একটা বৃষ্টি-বৃষ্টি স্যাঁতসেঁতে ভাব।
কিন্তু ইতিহাস বলে, ভারত-পাক ম্যাচ নতুন নতুন তারকা তৈরি করে। তৈরি করে নতুন মঞ্চ। কে জানত, সম্রাটের জন্য অপেক্ষারত সেই মঞ্চে তারকা হয়ে আবির্ভূত হবেন আঠাশের যুবক! যিনি একদা বয়সভিত্তিক রাজ্য দল থেকে বাদ পড়েছিলেন ‘অ্যাটিটিউড’-এর কারণে।
গুজরাতের সুরাতের বাসিন্দা হিমাংশু পাণ্ড্য তাঁর ‘কার ফিনান্স’-এর ব্যবসায় ঝাঁপ ফেলে বডোদরা গিয়ে ভাড়াবাড়িতে উঠেছিলেন। রোখা জেদ— আধুনিক পরিকাঠামোর সুযোগসুবিধা-সহ দুই পুত্রকে ক্রিকেটার বানাবেন! তা এক মাত্র সম্ভব বডোদরায় কিরণ মোরের অ্যাকাডেমিতে গেলে। অতএব, সুরাতের পাট গুটিয়ে বডোদরা। সেই শহরের ভাড়াবাড়ির সেই ঘর থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িতে চড়ে অ্যাকাডেমিতে যেত পাঁচ বছর বয়সি কিশোর হার্দিক এবং তার ভাই ক্রুণাল। ক্লাস নাইনের বেশি লেখাপড়া হয়নি হার্দিকের। কারণ, ক্রিকেট তত দিনে জীবনের বাকি সব কিছু গিলে ফেলেছে।
প্রথমে বডোদরা। তার পর আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স এবং গত আইপিএল থেকে গুজরাত টাইটান্স। আইপিএলের মঞ্চ থেকেই ভারতীয় দলে উত্থান। বিতর্ক এবং ক্রমান্বয়ে চোট-আঘাতে বিপর্যস্ত ক্রিকেটজীবন। এবং সেই ছাইয়ের গাদা থেকে এই প্রায় অত্যাশ্চর্য উড়ান! আইপিএলে দায়িত্ব নিয়ে আনকোরা টিমকে চ্যাম্পিয়ন করানো (শেন ওয়ার্নও প্রথম আইপিএলে রাজস্থান রয়্যাল্সকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাঁধে অতীতের সাফল্যের ভার ছিল না। হার্দিক আগে মুম্বইয়ের হয়ে আইপিএল জিতেছেন। যে মুম্বই তাঁকে মেগা নিলামের আগে ছেড়ে দিল। আসলে ছেঁটে ফেলল) যদি তাঁর স্থিতধী সাফল্যের প্রথম সোপান হয়, তা হলে পাকিস্তান ম্যাচে স্নায়ুকে কব্জায় রেখে ওই প্রেশার কুকার পরিস্থিতি থেকে টিমকে জিতিয়ে আনা সেই উত্তরণে সম্ভবত দুটো অতিরিক্ত পাখনাই জুড়ে দিল। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’ থেকে যে উড়ানে ‘পোস্টার বয়’ হয়ে গেলেন হার্দিক।
ফ্ল্যাশব্যাকে হার্দিকের যাত্রা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ভাল-খারাপের মধ্যে পার্থক্য মাত্রই একচুলের। অথবা একসুতোর। হার্দিক সম্ভবত তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। মনে হচ্ছিল, ব্রহ্মাণ্ডের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। সেই নিয়মেই জগৎ এবং জীবন নড়াচড়া করে। সেই আলোড়নই ব্যক্তিবিশেষকে ঠিক সময়ে ভাসিয়ে তোলে। তবে সেই ‘ঠিক’ সময়ের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হঠাৎ ব্যাপারটা ঘটে যায়! যাকে আমরা ‘ইট মোমেন্ট’ বলি। হাফ-পেডালে সাইকেল চালানো শিখতে শিখতে যেমন হঠাৎ কখন যেন ব্যালান্স চলে আসে। মুক্তির আনন্দ হয়। ভিতর থেকে অসূয়া চলে যায়। অপ্রাপ্তির বোধ চলে যায়। কোনও ক্রমে উতরে দেওয়ার প্রবণতা চলে যায়। স্থৈর্য আসে। ধৈর্য আসে।
সেই মুহূর্ত বলে, চারপাশে যা দেখছ, এগুলো আসলে একটা ঘোর। প্রতি দিন সকালে উঠে নিজেকে এই কথাটা বলতে হয়। বলতে হয়, কোথায় থামতে হবে। বলতে হয়, জিনিয়াসের লক্ষণই হল কোথায় থামতে হয় সেটা জানা। নিজেকে নিরন্তর বলতে হয়, কোথায় শুরু করতে হবে। কোথায় থামতে হবে। কোথায় কতখানি দিতে হবে। আবার কোথায় নিজের থেকে কতটুকু বা কতখানি কেড়ে নিতে হবে। যাকে জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞরা ‘পরিমিতিবোধ’ বলেন। পরিমিতিবোধ থাকলে অভেদ্য হওয়া যায়।
সেই বোধ থাকলে বোঝা যায়, ঠিক জায়গা থেকে আলোর প্রক্ষেপণ হচ্ছে কি না। তাতেই কেউ রাজা, কেউ ফকির হয়। কেউ ভাঁড়, কেউ নায়ক। কেউ শয়তান, কেউ ভগবান। আলো যেখানে থাকবে, তার উপর নির্ভর করে ছায়াটা কোথায় থাকবে আর কত লম্বা হয়ে পড়বে। তার কতটা প্রভাব পড়বে পরিপার্শ্বে। আলো যদি ঘুরে মাথার উপর চলে আসে, তা হলে ছায়াও গুটিয়ে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। তার আর কোনও প্রভাব থাকে না। আলো দূরে থাকলে ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে। তার প্রভাবও তত দূর পর্যন্ত যায়।
বিরাট আর হার্দিককে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আলো ঘুরে গিয়েছে। বাতাস অন্য দিকে বইছে।
মনে হচ্ছিল, কম্পিটিটিভ স্পোর্ট হল অসূয়াপ্রবণ প্রেমিকার মতো। তাকে সব সময় জাপ্টে, জড়িয়ে, সাপ্টে ধরে থাকতে হয়। সে-ই হল পেশাদার ক্রীড়াবিদের আসল প্রেম। বিরাট কি সেই প্রেম থেকে খানিক বিচ্যুত হয়েছেন? তিনি কি খুব বেশি চাকচিক্য আর চকমকির মধ্যে চলে গিয়েছেন? ইনস্টাগ্রামের চকমকি, সোশ্যাল মিডিয়ার চকমকি। সে জন্যই কি তুমুল খাটাখাটনি বা মাপমতো বিশ্রাম সত্ত্বেও কোথাও গিয়ে আর পুরনো ছন্দটা ফিরে পাচ্ছেন না? তাঁর আশপাশ থেকে অন্যেরা হু-হু করে উঠে আসছে! সে জন্যই কি কলোসিয়ামের মধ্যবিন্দুতে দাঁড়ানো ছিপছিপে চেহারার হার্দিককে ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের মতো দানবীয় লাগছিল? যাঁর চোখের পলক পড়ে এই বার্তা নিয়ে যে, এখনও সব কিছু শেষ হয়নি। যিনি তিন বলে ছ’রানের সামনে দাঁড়িয়েও স্থির, অচঞ্চল থাকেন। সঙ্কটসময়ে ‘ডট’ বল খেললেও উল্টোপ্রান্তে দাঁড়ানো সতীর্থকে অভয় দেন এবং টুথপিকের মতো ব্যাট ঘুরিয়ে অবলীলায় ওভার বাউন্ডারি মেরে ম্যাচ শেষ করেন!
মনে হচ্ছিল, একদা উড়নচণ্ডী, বখাটে, নারীসঙ্গলিপ্সু হার্দিকের সঙ্গে বোধ হয় সেই লোকটার দেখা হয়ে গিয়েছে। আমাদের সকলের ভিতরেই যে লোকটা বাস করে অথচ আমরা সকলে যার দেখা পাই না। কেউ কেউ পায়।
যারা পায়, তারা লোকটাকে ভিতরে ভিতরে জাগিয়ে রাখে। যে সময়ে সময়ে পিছন দিকে টেনে ধরে। বলে, ‘‘ওরে! আর এগোস না। সামাল-সামাল।’’ ওই লোকটাকে খুঁজে তার সঙ্গে একটা বনিবনা তৈরি করতে হয়। একটা ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’। যে লোকটা সময় থাকতে সতর্ক করবে। সাবধান করবে।
ভিতরের সেই লোকটাই কি রগড়ানির পর হার্দিককে জীবনের সঠিক ট্র্যাকে এনে ফেলল? সেই লোকটাই বলল বয়সে দু’বছরের বড় সার্বিয়ান বান্ধবী নাতাশা স্ট্যানকোভিচের সঙ্গে থিতু হতে? সন্তানের পিতা হতে? দায়িত্বশীল হতে? সাফল্য-ব্যর্থতায় অবিচল থাকতে?
সম্ভবত তা-ই। ভাগ্যিস বলল! ভিতরের লোকটার ছোঁয়ায় এই হার্দিক একটা বদলে-যাওয়া লোক। মরুশহরের কলোসিয়ামে যে ছক্কাটা মেরে তিনি সারা দেশের আয়ু খানিক বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন, সেটা স্কিল দিয়ে হয় না। ওটা স্কিলের ছক্কা নয়। মনের ছক্কা!
যত দিন ওই মনের ছক্কাটা থাকবে, তত দিন বিশ্ব নতজানু হবে। দীনেশ কার্তিকের চেয়ে আরও একটু বেশি ঝুঁকে থাকবে। আরও একটু বেশি নত হবে।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)