Glenn Maxwell-Shakib Al Hasan

এক শাকিব এবং এক ম্যাক্সওয়েল, বিপুলা এ ক্রিকেটের ততটুকু জানি

যাঁরা শাকিবের তথাকথিত ‘অক্রিকেটোচিত’ ব্যবহারে গেল-গেল রব তুলছেন, তাঁদের কত জন ত্যাগ স্বীকার করে থাকেন বা করতেন বাংলাদেশ অধিনায়কের পরিস্থিতিতে থাকলে? ক্রিকেটে তো বটেই, জীবনেও।

Advertisement
অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
Opinion piece: Faith units Shaqib Al Hasan and Glen Maxwell in CWC

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সালটা মনে নেই। অনেক, অনেক বছর আগে। কোনও একটা অ্যাসাইনমেন্টে খুব ভোরের উড়ানে ঢাকা যাচ্ছি। হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দরে প্লেন ল্যান্ড করার পরে সামনের দরজা দিয়ে যাত্রীরা গুটিগুটি বেরোচ্ছেন। বিমানসেবিকারা পরিচিত হেঁ-হেঁ ইত্যাদি সেরে নিচ্ছেন। বেরোতে বেরোতেই চোখে পড়ল, প্রথম সারির আইল সিটটায় গুটিসুটি হয়ে, প্রায় কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে ট্র্যাকস্যুট পরিহিত একটা চেহারা। কেউ ডেকে বলছেনও না যে, উঠুন! এ বার নামতে হবে।

Advertisement

কৌতূহল হল। ঠাহর করে দেখলাম— শাকিব আল হাসান। শিশুর মতো অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। তখন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেন শাকিব। মনে পড়ল, আগের রাতে ইডেনে ম্যাচ ছিল। তার পরে হোটেলে আফটার ম্যাচ পার্টি (তখনও আইপিএলে ভোররাত পর্যন্ত এ সব হত-টত)। নির্ঘাত হদ্দ ক্লান্ত। এবং নিশ্চয়ই সেই অবস্থাতেই বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন। কলকাতা থেকে ঢাকার উড়ান দূরত্ব মেরেকেটে ৪০-৪৫ মিনিট। দেখে মনে হচ্ছিল, সেই সময়টাও নষ্ট করতে চাননি। উঠেছেন এবং সটান ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে ঘুম এতটাই গভীর যে, বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকাকে কেউ ডাকতেও সাহস পাচ্ছেন না!

তাঁর পাকা ঘুম কখন ভেঙেছিল, কখন তিনি বিমানের খোঁদল থেকে বেরিয়ে লটবহর নিয়ে ঢাকার বাড়িতে রওনা দিলেন, সে সব জানার অবকাশ ছিল না। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিশ্বকাপের ম্যাচে শাকিব এবং অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ়ের মধ্যে ক্রিকেটের গত ১৪৬ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন আউটের কারণে যে সংঘাত তৈরি হল এবং সেই ঠোকাঠুকিতে যে স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বেরোল, সেই আলোয় বহু বছর আগে বিমানের আইল সিটে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে-থাকা চেহারাটা আবার মনে পড়ল।

সেই শাকিবের সঙ্গে এই শাকিবের মিল খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে তাঁর ম্যাথুজ়কে ‘টাইম্ড আউট’ করার সিদ্ধান্ত। শাকিব যখন আবেদন করছেন, আম্পায়ারেরাও তাঁকে কৌতূহলী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘তুমি কি সিরিয়াস? এই অ্যাপিলটা সত্যিই করছ?’’

অবিচলিত শাকিব বলেন, হ্যাঁ করছেন। সারা পৃথিবী যা দেখল— একটি ডেলিভারিও না খেলে শূন্য রানে আউট হলেন ম্যাথুজ়। মাঠ থেকে বেরিয়ে ক্রুদ্ধ, স্তম্ভিত, অসহায় এবং ফুঁসতে-থাকা শ্রীলঙ্কার সিনিয়র ক্রিকেটার ডাগ আউটের দিকে ছুড়ে ফেললেন হেলমেটটা। পতনের রাগত অভিঘাতে দু’একটা ঠোক্কর এবং ডিগবাজি খেয়ে সেটা বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে আবার মাঠেই ঢুকে পড়েছিল প্রায়!

ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতল। শাকিব একা করলেন ৮০ রান। তাঁর একটা ক্যাচ পড়ল। কিন্তু শেষমেশ উইকেটটা দিয়ে এলেন সেই ম্যাথুজ়কেই। ব্যাটটা একটু আগে চলে গিয়েছিল। শর্ট মিড উইকেটে দুগ্ধপোষ্য একটা ক্যাচ উঠল। এ বার আর পড়েনি। আউট হয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতের মণিবন্ধে ডান হাতের তর্জনী ঠুকতে ঠুকতে শাকিবের দিকে খরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ম্যাথুজ়। তাঁর হাতের মুদ্রা বলছিল— তোমার সময় হয়ে গিয়েছে। টাইম আউট!

কিন্তু সে আস্ফালনে আর হবেটা কী! তত ক্ষণে বাংলাদেশের ম্যাচ জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দরজার দিকে খানিক দূর এগিয়ে গিয়েছে শাকিবের দেশ। যে কারণে ম্যাচের পরে তিনি বলবেন, ‘‘আমার বয়স এখন ছত্রিশ। বহু দিন ক্রিকেট খেলছি। মাঠে আমি যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ম মেনে লড়াই করেছি। আমাদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যাওয়ার ব্যাপার রয়েছে।’’

তত ক্ষণে অবশ্য গোটা শ্রীলঙ্কা (এবং তার সঙ্গে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পণ্ডিতও) শাকিবের মুণ্ডপাত করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ খানিকটা ব্যাকফুটে। খানিকটা লজ্জা-লজ্জা বিবৃতিও আসছে সমর্থকদের একটা অংশের কাছ থেকে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অন্যায়টা কী করলেন শাকিব? যা করেছেন, ক্রিকেটের আইনের মধ্যে থেকেই তো। আইন-বহির্ভূত কিছু তো করেননি!

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট মাঠের আকচাআকচি দীর্ঘ দিনের। কোথা থেকে এটা শুরু হয়েছিল কে জানে! কিন্তু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের মতোই এই ম্যাচটাতেও দু’দেশের ক্রিকেটার এবং সমর্থকেরা বেজায় তেতে থাকেন। এমনিতেই তামিম ইকবালের বিশ্বকাপের টিম থেকে বাদ পড়া নিয়ে টুর্নামেন্টের আগে থেকে গোটা দেশ শাকিবের পিন্ডি চটকাচ্ছে। তার পরে একের পর এক হার। নিজের ফর্ম তলানিতে। এই অবস্থায় ক্রিকেটের আইনের আওতায় দাঁড়িয়ে শাকিব যদি সময়োপযোগী আউটের আবেদন করে থাকেন, বেশ করেছেন! ‘ক্রিকেটের স্পিরিট’, ‘ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা’ ইত্যাদি বলে কি নিজের আইন-অজ্ঞতাকে ঢাকা দেওয়া যায়? এ তো যুদ্ধ! মারি অরি পারি যে কৌশলে। যাঁরা শাকিবের তথাকথিত ‘অক্রিকেটোচিত’ ব্যবহারে গেল-গেল রব তুলছেন, তাঁদের কত জন ত্যাগ স্বীকার করে থাকেন বা করতেন বাংলাদেশ অধিনায়কের পরিস্থিতিতে থাকলে? ক্রিকেটে তো বটেই, জীবনেও।

একদা এক রেডিয়ো সাক্ষাৎকারে অসামান্য বলেছিলেন শাহরুখ খান— ‘‘আগে ভালমতো টাকাকড়ি রোজগার করে নাও। তার পরে দার্শনিক হও।’’ মানে আর্থিক সংস্থানটা গুছিয়ে নিয়ে তার পরে ‘আমি তো টাকার জন্য কাজ করি না’ ইত্যাদি উদাসীন এবং বুদ্ধিজৈবিক বিবৃতি দাও। যে সমস্ত বিশুদ্ধবাদীরা প্রতিপক্ষকে বাগে পেয়েও ‘টাইম্ড আউট’ করেননি, খোঁজ নিলে নির্ঘাত দেখা যাবে, ম্যাচ সিচুয়েশনে (অথবা টুর্নামেন্টে) তাঁরা সুবিধাজনক জায়গায় ছিলেন। তাই ওই বড়লোকিটা দেখাতে পেরেছিলেন। শাকিবের এখন গরিবের সংসার। খুদকুঁড়োও তাঁর প্রয়োজন। নইলে না-খেয়ে মরতে হবে।

ফলে যা করেছেন, বেশ করেছেন! নিজের উপাখ্যান নিজে তৈরি করেছেন। নিজের অর্জিত বিশ্বাস থেকে করেছেন।

বিশ্বাস!

যে তিন অক্ষরের শব্দ এবং শব্দের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডদূতকে দিয়ে সম্প্রতি ৪০ সেকেন্ডের একটি গভীর বিজ্ঞাপন করেছে স্টার স্পোর্টস। বিরাট কোহলি বলছেন, ‘‘বলা হয়, দুনিয়া বেঁচে থাকে আশায় ভর করে। বোধহয় সেটা ভুল। কারণ, কিছু একটা থাকে, যা আশপাশে কোথাও দেখা যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। সেটা শিরা আর ধমনীতে দৌড়ে বেড়ায়। তুফান তোলে। আত্মায় আর আবেগে ঝিলিক মেরে যায়। যা আকাশকেও ঝুঁকিয়ে দিতে পারে। দুনিয়া জয় করাতে পারে। বিশ্বাস! দুনিয়া চলে বিশ্বাসে ভর করে।’’

বিশ্বাস!

যে বিশ্বাসে ভর করে সারা শরীরে মারাত্মক ক্র্যাম্প নিয়েও ওই অতিমানবীয় ইনিংস খেলে গেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। অনেক দিগ্‌গজ কপিল দেবের টার্নব্রিজ ওয়েলসে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭৫ রানের ইনিংসকে তুলনায় আনছেন। সবিনয়ে বলি, ঠিক করছেন বলে মনে হয় না। এটা ঠিকই যে, কপিল যখন নামেন, ভারত তখন ১৭-৫। ম্যাক্সওয়েল যখন নেমেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া তখন ৯১-৭। রান বেশি। উইকেট কম। কপিলের ম্যাচ ছিল ৬০ ওভারের। দ্বিতীয়ত, কপিল খেলছিলেন বিলেতে। ব্রিটিশ সামারে। গায়ে ফুলস্লিভ পুলওভার। ক্রিকেটের পক্ষে আদর্শ আবহাওয়া। ম্যাক্সওয়েলের পুঁজিতে ১০ ওভার কম ছিল। তিনি খেলছেন চিটচিটে ভারতীয় আবহাওয়ায়। যেখানে পেশাদারের চরমতম পরীক্ষা নেয় গুমোট গরম, অসীম আর্দ্রতা আর শরীরে ক্রমক্ষীয়মান জলের মাত্রা। যে কারণে ভয়াবহ খিঁচুনি শুরু হল ম্যাক্সওয়েলের শরীর জুড়ে। কোমর, হ্যামস্ট্রিং, পায়ের গোছ— সর্বত্র!

একটা সিঙ্গলস নেওয়ার পরে নন স্ট্রাইকার প্রান্তে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে কাতরাতে শুরু করলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার। সারা শরীর যন্ত্রণায় ক্রমাগত কুঁকড়ে যাচ্ছে। দুই আম্পায়ার দৌড়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন কম্পনরত ক্রিকেটারের পাশে। ছুটে এসেছেন ফিজিয়ো। তাঁদের সামনেই ওই শোওয়া অবস্থা থেকে একটা ঝটকা লাগল ম্যাক্সওয়েলের শরীরে। কোমর থেকে বুঝি বা এক বিদ্যুৎতরঙ্গই খেলে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে! দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট মাঠে কি আরও একটা ট্র্যাজেডি ঘটছে?

যখন মনে হচ্ছে তাঁকে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হবে, ফিজিয়ো হাতের ম্যানপ্যাকে সম্ভবত নির্দেশ দিচ্ছেন অ্যাম্বুল্যান্স তৈরি রাখার, পরের ব্যাটার অ্যাডম জ়াম্পা এসে দড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, উঠে দাঁড়ালেন ম্যাক্সওয়েল। এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে (এক বার সিঙ্গল্‌স নিলেন এবং কমেন্টেটর বললেন, ‘‘হি ইজ় ওয়াকিং লাইক চার্লি চ্যাপলিন।’’ কিন্তু সেই বিবরণীর মধ্যে কোথাও লঘু চপলতা নেই। কোনও অশ্রদ্ধা নেই। মশকরা নেই। সত্যিই ম্যাক্সওয়েলকে মনে হচ্ছিল, চার্লির মতো পা ঘষে ঘষে হাঁটছেন) যখন তিনি একের পর এক আফগান বোলারকে মাঠের বাইরে ওড়াচ্ছেন (তার মধ্যে একটি সুইচ হিট!), কালো রিস্ট ব্যান্ডের আবডাল থেকে মুহুর্মুহু ফেটে বেরোচ্ছে স্বেদসিক্ত, পেশল দুই বাহু (ম্যাচটা জেতানোর পর উচ্ছ্বসিত ধারাভাষ্যকার বললেন, ‘‘ওকে গোটা অস্ট্রেলিয়া টিমের কাঁধে করে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া উচিত’’), তখন মনে পড়ছিল চার বছর আগের বিশ্বকাপ মঞ্চ এবং জনৈক গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের আখ্যান।

২০১৯ সালের বিশ্বকাপের সময় নেটে বাউন্সারে চোট পেয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল ম্যাক্সওয়েলকে। তখন তাঁর এমনই মানসিক অবস্থা যে, প্রার্থনা করছেন, আঘাতটা যেন যথেষ্ট সিরিয়াস হয়। যাতে আর বিশ্বকাপে খেলতে না হয়। কারণ, সেই বিশ্বকাপের মধ্যেই তাঁর মানসিক অবসাদের গহ্বরে ঢুকে যাওয়ার শুরু। হোটেলের ঘরে তৎকালীন প্রেমিকার (এখন স্ত্রী) সামনে আচমকাই ভেঙে পড়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। কারণ, তাঁকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের চূড়ান্ত টিমে রাখা হয়েছে। কিন্তু মানসিক ভাবে তিনি সেই ‘বিগ ম্যাচ’ থেকে পালাতে চাইছেন।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে ম্যাক্সওয়েলকে গুচ্ছের ব্যথাহরা ওষুধ গিলিয়ে, নেটে নিয়ে গিয়ে জাস্টিন ল্যাঙ্গার এবং রিকি পন্টিং কড়া খাটুনি খাটান। যাতে কায়িক পরিশ্রমের চোটে মনের জঞ্জাল সাফ হয়ে যায়। কোনও লাভ হয়নি। ম্যাক্সওয়েল প্রাণপণে চাইছিলেন, টুর্নামেন্টটা দ্রুত শেষ হোক। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া যেন হারে ইংল্যান্ডের কাছে। পাঁচ মাস পরে ম্যাক্সওয়েল ঘোষণা করেন, তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছেন। ক্রিকেট থেকে ছুটি চান। ব্যাট তুলে রাখেন। যান ক্রীড়া মনোবিদের কাছে।

চার বছর পরের সেই বিশ্বকাপের মঞ্চে ৪০ বলে বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরি করলেন (মানছি নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে। কিন্তু মহাজনেরা বলে গিয়েছেন, সেঞ্চুরি হল সেঞ্চুরি। সে গলির ক্রিকেটে হলেও) জনৈক গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তার পরে আফগানিস্তানের সঙ্গে ওই অরণ্যোদেবোচিত কাণ্ড! হতে পারে, আফগান বোলারেরা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাঁকে পায়ের গোড়ায় টোপা টোপা বল করেছেন। সপ্তম স্টাম্পে ডেলিভারি করলে ওই শরীর নিয়ে তিনি বলের কাছে পৌঁছতে পারতেন না। হতে পারে, তাঁর দুটো ক্যাচ পড়েছে। হতে পারে, লেগ বিফোর হয়ে বেরিয়ে যেতে যেতেও তিনি ডিআরএসের সৌজন্যে ক্রিজে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ঘাড়ের উপর ন’নম্বর টেল এন্ডারকে নিয়ে ওই সংহারটা তো ভূতে করেনি!

ম্যাক্সওয়েলের ২০১ অপরাজিত ইনিংসটা নিয়ে সচিন তেন্ডুলকর লিখেছেন, ‘‘জীবনের সঙ্গে ক্রিকেটের অনেক মিল। জীবনে অনেক সময় যা আপনাকে পিছনে টেনে রাখে, সেটাই আবার সামনে ঠেলে দেয়। স্প্রিংয়ের মতো। ম্যাক্সওয়েলের ক্র্যাম্প ওর পায়ের নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ওকে ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু তার ফলে ওর মাথাটা স্থির ছিল। ও বলটা অনেক কাছ থেকে দেখছিল। সেই অনুযায়ী হাত আর চোখের সমন্বয়টাও দারুণ হচ্ছিল। তার সঙ্গে ওই অবিশ্বাস্য ব্যাট স্পিড! একটা ম্যাচের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ফুটওয়ার্ক দরকার হয়। অনেক সময় নো ফুটওয়ার্কও দুর্দান্ত ফুটওয়ার্ক হয়ে দেখা দেয়।’’

কিন্তু সে তো ক্রিকেটের টেকনিক্যাল কথা। ঈশ্বরের অনুবীক্ষণের লেন্স থেকে বেরিয়ে আসা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছেরা দেখবে ওই তিন অক্ষরের শব্দ— বিশ্বাস।

নিজের উপর বিশ্বাস ছিল বলেই নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে-থাকা অধিনায়ক প্যাট কামিন্স (যিনি ম্যাক্সওয়েল মহাকাব্যে প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেলেন) তিন বার বলা সত্ত্বেও ম্যাক্সওয়েল মাঠ ছেড়ে বেরোলেন না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিঙ্গল্স নিয়েও উল্টে কামিন্সকে আড়াল করলেন। পায়ে কেউ গজাল পুঁতে ক্রিজে আটকে দিয়েছে, এমন অবস্থায় ব্যাটটাকে প্রায় টুথপিকের মতো ব্যবহার করে ২০১ রানের ইনিংস খেলে ফেললেন। চার বছর আগের হতাশার আখ্যান বদলে গেল কালজয়ী উপাখ্যানে।

বিশ্বাস!

তিন অক্ষরের ওই শব্দটা থেকে একটা বিভা বেরোয়। মহাকীর্তির উপর না-পড়লে তার অস্তিত্ব ঠাহর হয় না। আলোর মতো। নিজের ভিতরে তাকে লালন করতে হয়। যাতে সে শিরা-ধমনীতে দৌড়ে বেড়ায়। তুফান তোলে। আত্মা আর আবেগে ঝিলিক মেরে যায়। আকাশকে নতজানু করাতে পারে। দুনিয়া জয় করাতে পারে।

ঠিকই। আশা নয়, দুনিয়া চলে বিশ্বাসে ভর করে।

আরও পড়ুন
Advertisement