R G Kar Hospital Incident

এক ডাকে কী ভাবে এত মেয়ে ‘রাত দখলে’ পথে নামলেন? কিসের টানে জুড়ে গেল মন

এক রাতের প্রতিবাদে সব আলো ফোটে না। কিন্তু নিজের ভেতরের যে কণ্ঠ বুধবার রাতে আমরা শুনতে পেলাম, তাকে যেন আবার অবচেতনে পাঠিয়ে না দিই। সে বিষয়ে সচেতন প্রয়াস থাকুক।

Advertisement
অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৪ ১৭:১০
Psychologist Anuttama Banerjee clarifies the relation between minds and reclaim the night movement

আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় মোমবাতি হাতে মেয়েরা। ছবি: এএফপি।

বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখেই একটি মেসেজ ঢুকল। ভয়েস নোট। এক বান্ধবী জানালেন, শ্যামবাজারের মোড়ে কিছু শিক্ষার্থী একটি দোকানে পৌঁছেছিলেন। হাতে লেখা পোস্টার। প্রিন্ট আউট নেবেন। পোস্টারের বয়ান দেখে দোকান জানিয়েছে, টাকা নেওয়া হবে না।

Advertisement

‘বিচার চাই’, যৌন হেনস্থার হাত থেকে সুরক্ষা চাই’— এই দাবি নিয়ে যখন গোটা রাত পথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন সংহতির ছোট্ট দোকানের আলো ভয়েস নোট মারফত এসে পৌঁছল।

মঙ্গলবারও একটি মিছিলে হেঁটেছিলাম। উদ্যোগ নিয়েছিল একটি নারীবাদী সংগঠন। পোস্টারে লেখা ছিল ‘নারী শরীরের উপর নারীর নিজস্ব অধিকার স্থাপনের অঙ্গীকার’। দেখেছিলাম, রাস্তার দু’পাশ থেকে সাধারণ নাগরিক স্বতস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে। যৌন হেনস্থার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কেউ স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন। কেউ নিশ্চুপে পাশে হেঁটে জানান দিচ্ছেন, আছি। কানে আসছিল ‘রাত দখলের’ ডাকে সাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা। বিক্ষিপ্ত ভাবে শুনছিলাম কিছু কিছু উক্তি।

‘আগামী কাল তা হলে ক’টার সময়?’

‘আগামী কাল কোথায়?’

‘তুমি কি অ্যাকাডেমিতে?’

‘তুই কি যাদবপুরে?’

পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে দেখছিলাম, বহু মানুষ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন একটি মাত্র প্রশ্ন দিয়ে— ‘কাল রাত্রে তুমি কোথায় থাকবে?’ অথবা ‘তুমি কোথায় দাঁড়াবে?’

রাত দখলের কর্মসূচির পোস্টারটি দেখেছিলাম গত রবিবার। তখনও যাব কি না মনস্থির করিনি। তবে মঙ্গলবারের মিছিল আমার সিদ্ধান্তকে দিশা দিচ্ছিল। তখনও ঠিক করিনি কোথায় থাকব। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, থাকব। বুধ-রাত্রে পথে থাকব। একে অন্যের পাশে থাকব।

Psychologist Anuttama Banerjee clarifies the relation between minds and reclaim the night movement

মঙ্গলবার প্রতিবাদ মিছিলে লেখক। ছবি: ফেসবুক থেকে।

গত একুশ বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি। মানুষের মনের চলন, তার বাঁক, তার গতি বোঝার চেষ্টা করাই আমার কাজ। আমার পেশা। তার শুশ্রূষা এবং নিরাময় আমার সংকল্প। যে রাত ডাক পাঠাচ্ছে বলে এত নারী পথে নামবেন, সেই সম্মিলিত মনের কাছে আমি পৌঁছব না? এত মানুষের মন একই সূত্রে বাঁধা পড়ে রাত দখল করে নিতে চাইছে! এমন নজির এর আগে চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি, আমার ‘থেরাপি সেশনে’ও তার আভাস পেয়েছি। এই চরম অপরাধ অন্য মানুষের জীবনের অমীমাংসিত অন্যায়ের স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। আরজি করের ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেক মানুষ জানিয়েছেন, তাঁদের পুরনো ট্রমা এবং যৌন হয়রানির অনেক অতীত অধ্যায় আবারও ফিরে ফিরে আসছে তাঁদের মনে। তাঁরা ‘ট্রিগার্ড’ বোধ করছেন। অনেকেই চাইছেন ওই রাত জমায়তের কাছে পৌঁছে যেতে। কিন্তু তাঁদের ‘ট্রমা’ তাঁদের পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। কেউ কেউ এ-ও বলছিলেন, ‘‘আমি তো যেতে পারছি না। কিন্তু যখন দেখছি এত মানুষ যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি একা নই। পথে যদি না-ও নামতে পারি, জানব আমার জন্য আরও অনেকে আছেন।’’

অনেক মানে কত? কত জন আছেন, বুধবার মধ্যরাতে টের পেলাম।

রত্নাবলীদির (মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়) সঙ্গে যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, জানতে পারলাম, আমার পাড়ার মোড়েও অনেকে জড়ো হচ্ছেন। যত এগোচ্ছিলাম, চোখে পড়ছিল ছোট ছোট দলে বিভক্ত মানুষ। নারী অবশ্যই, পুরুষও। একে অপরের পাশে কেউ কেউ এসে চুপ করে দাঁড়াচ্ছেন। কারও হাতে মোমবাতি, কোথাও পোস্টার, কোথাও কিচ্ছু না। শুধু পাশে থাকা। সেন্ট পলস্‌ ক্যাথিড্রালের সামনে দেখলাম ব্যারিকেড। অনেক পুলিশ। গাড়ি থামিয়ে দিতে হল। ড্রাইভার দানীশভাইকে বলা হল গাড়ি নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করতে। আমি আর রত্নাবলীদি হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গে আরও অনেকে হাঁটছিলেন। নিশ্চুপে হাঁটছিলেন। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম, একটা মঞ্চ থেকে স্বর আসছে। ‘বিচার চাই’ স্লোগান ভেসে আসছে। দাবি উঠছে, যৌন হয়রানি বন্ধ হোক। ভিকটিমের দিকে আঙুল তোলা আইনের আওতায় আসুক। প্রতিবাদের স্বর আসছে।

আমরা সেই স্বরটির দিকে এগোচ্ছিলাম। পরিচিত যে বন্ধুদের আসার কথা, তাঁদের মেসেজ আসতে শুরু করেছে। আসব বলে আসছেন না, এমন একটি নামও মনে করতে পারছি না। একে একে মেসেজ আসছিল, ‘তুমি এখন ঠিক কোথায়?’ বা ‘তুমি এখন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে?’ পরিচিত মুখের ভিড় বাড়ছিল। অপরিচয়ের দেওয়াল ভাঙছিল। টের পাচ্ছিলাম, যে যেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি, একা দাঁড়িয়ে নেই। এক একটা স্লোগানের মধ্যে অনেক গলা মিলছে। একের ভাষায় অন্যের আখ্যান মিলছে। কিন্তু সেই প্রত্যেকটি স্লোগানের উদ্দেশ্য এক— হিংসা বন্ধ হোক। নারীবিদ্বেষ রুখতে হবে। যৌন হেনস্থা বন্ধ হোক। এই মিলন উৎসবের মিলন নয়। এই মিলন প্রতিবাদের জমায়েত। অনেকে কটাক্ষ করছিলেন, এই রাতদখল সাজুগুজু সেল্‌ফিযাপন হতে চলেছে। না। অনেক তথাকথিত সেলিব্রিটি থাকলেও সেল্‌ফির হিড়িক নজরে এল না। ভিড় নিজেই নিজেকে সংহত করছিল।

সেই ভিড়ের মধ্যেই কিছু প্রশ্ন কানে আসছিল। কিছুটা আত্মনিরীক্ষণ মূলক। আমরা তো অমুকের সময় এমন সমাবেশ দেখিনি? নিজেও তো পথে নামিনি তা হলে এখন কেন? এর আগেও দেশের অন্যত্র, আমাদের রাজ্যেও ধর্ষণ-খুন, হিংসা দেখেছি। তথাপি এই স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তো দেখিনি। অনুমান কানে আসছিল। কেউ কেউ বলছিলেন, তবে কি চিকিৎসক বলে এত মানুষ পথে? উনি যদি এক জন সাধারণ নাগরিক হতেন? যদি বিত্তের দিক থেকে, শিক্ষার দিক থেকে এই অবস্থানে না থাকতেন? তাঁর জন্যও কি শহর পথে নামত? ভাঁড়ের চা ফুরনোর আগেই সেই যুক্তি ফেলে দিয়ে কেউ বলছিলেন, ‘হায়দরাবাদেও তো মেয়েটি চিকিৎসক ছিল। তখন তো এ ভাবে আমরা জুড়তে পারিনি।’ আমরা এত দিন একে অপরের দিকে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছি, ‘হোয়াটঅ্যাবাউটরি’, আমাদের পরস্পরকে বিদ্ধ করার পরিচিত লব্জ। কিন্তু বুধবার রাতে অনেকে নিজেকে নিয়েও বিস্মিত হচ্ছিলেন। নিজের কাছে প্রশ্ন রাখছিলেন, ‘‘এখনই কেন সাড়া দিলাম? এত মানুষ কোন ডাকে সাড়া দিচ্ছেন?’’

মনোসমীক্ষার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিজেকে নিরপেক্ষ ভাবে দেখতে শেখায়। নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে যে কোনও আচরণের অন্তর্নিহিত শিকড় চিনতে শেখায়। নিজেকে আবারও জিজ্ঞেস করছিলাম, আমি ঠিক কেন এই ‘রাতদখল’ নেওয়ার ডাকে শামিল হলাম? শুধু অন্যের মন বুঝতে? মনে হল, এটা যুক্তির ভান। এ উত্তরে আমার সৎ আবেগ ধরা পড়ছে না। তা হলে? মনে পড়ছিল ফলিত মনোবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স করার সময় আরজি কর মেডিক্যাল কলেজেই ইন্টার্নশিপ করেছি। তবে কি সেই অতীত যোগসূত্র আমাকে পথে নামতে বলছে? আমি ঠিক কোন ‘আমি’র ডাকে সাড়া দিচ্ছি? কোনও এক প্রাক্তনী সত্তা? ‘ফেলো ফিলিং’? সম্ভবত না। আরজি করের ঘটনা, এই ধর্ষণ, এই হত্যা আরও অনেক জমাট যন্ত্রণার গুহামুখ খুলে দিয়েছে। যে আমি বুধবার অ্যাকাডেমিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সে আর শুধু ওই একটি কলেজে ঘটে যাওয়া একটি নৃশংসতার আবহে আটকে নেই। যে উত্তর আমার পরিপার্শ্বেও অনেকে নিজের মধ্যে খুঁজছেন, সেই উত্তরও শুধুমাত্র একটি ঘটনাতে আবদ্ধ নয়।

Psychologist Anuttama Banerjee clarifies the relation between minds and reclaim the night movement

স্বাধীনতার মধ্যরাতে মশাল হাতে কলকাতায় মেয়েদের রাত দখল। ছবি: পিটিআই।

ফ্রয়েডের তত্ত্বে পড়েছি, মনের অনেকগুলি স্তর থাকে। আমাদের সচেতন ভাবনা, আচরণ, সিদ্ধান্ত মনের যে স্তর থেকে নির্মিত হয়, তা শুধু মনের উপরিভাগ। এই সচেতন মন একটি ক্ষুদ্র অংশ। হিমশৈলের মতো মনের এক বৃহৎ অংশ আমাদের নিজেদেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সচেতন মনের ঠিক পরের স্তরেই থাকে প্রাক্‌-চেতন। যেখানে আমাদের সাম্প্রতিক অতীত, সাম্প্রতিক স্মৃতি থাকে। ওই অংশটি তবুও বা ছুঁয়ে ফেলা যায়। এ যেন আগের রাতে দেখা স্বপ্নের কিছু অংশবিশেষের মতো। এ যেন আগের দিন কোন বন্ধুর সঙ্গে কী নিয়ে মতান্তর হল ফিরে গিয়ে দেখার মতো। এখনই না ভাবলেও তার কাছে ফিরে যাওয়া কঠিন হয় না।

কিন্তু যে ভাগটি আমাদের মনের বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে এবং আমাদের বহু আচরণের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে (অন্তত ফ্রয়েডের মতে), তা অবচেতন মন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষোভ, হতাশা, যন্ত্রণা এমনই অব্যক্ত তাগিদ মনের গহিন স্তরে অপেক্ষমান। আমরা বলি বটে, ‘জনস্মৃতি ক্ষণস্থায়ী’। কিন্তু আদতে তার রেশ, তার রসদ রয়ে যায়। যা নিয়ে আমাদের কথোপকথন, সংলাপ, চর্চা থেমে গিয়েছে তারা আমাদের ভিতর থেকে হারিয়ে যায় না। আমাদের অবচেতন মনে তাদের সক্রিয়তা বজায় থাকে। আমাদেরই অজ্ঞাতে আমাদেরই মধ্যে সে বাস করে। আমাদের অতীতের সমস্ত অ্যালবামের দায়িত্বে থাকে আমাদের অবচেতন মন। মন এই আপাত ভুলে থাকার মোড়কে আসলে সবই জমিয়ে রাখে। কিছু কিছু মুহূর্ত সেই মনের সেই সুড়ঙ্গপথ উন্মুক্ত করে দেয়। আরজি করের ঘটনা তেমনই স্ফুলিঙ্গ। ঠিক সেই কারণেই এই নৃশংস হত্যা বহু মানুষকে ‘ট্রিগার’ করছে। অনেকের অসম্মানের ইতিহাস, অনেক সুরাহা না হওয়া অন্যায় আবারও নিষ্পত্তি চাইছে। এক জনের প্রতি ঘটে যাওয়া নৃশংসতা আমাদের নিজেদের জীবনের অজস্র ক্ষোভের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানোর ডাক দিচ্ছে।

রাতদখলের ডাক যিনি পাঠিয়েছেন, যাঁরা পাঠিয়েছেন, তাঁরা ‘বিশিষ্ট’ কেউ নন। তত পরিচিত মুখও নন। হওয়ার দরকারও নেই। এখানে কে ডাকছেন গৌণ। কী জন্য ডাকছেন, সেটাই মুখ্য। সেই ডাক কোন পথ উন্মুক্ত করল তা ভেবে দেখার।

যৌন হেনস্থার ঘটনা, ধর্ষণ, এমনকি, তৎপরবর্তী মৃত্যুর পরে বহু সময় দেখেছি, যিনি ‘ভিকটিম’ তাঁর দিকেই আঙুল উঠছে। আরজি করের ক্ষেত্রেও তেমন উক্তি কানে আসছে! ‘সে কেন অত রাতে অমুক ঘরে গেল!’ দিল্লির ঘটনার পরেও আমরা শুনেছিলাম, ‘রাতে কেন ও রাস্তায় বেরিয়েছিল?’

নারীশরীর লঙ্ঘিত হলে বার বার রাত্রিকে ঢাল বানানো হয়। নির্যাতকের ঢাল। ধর্ষকের ঢাল। পুরুষতান্ত্রিকতা বরাবর মেয়েদের চলন, মেয়েদের সময়, মেয়েদের যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করেছে। যেন সে বাড়িতে থেকে গেলেই ভাল হত। একান্তই যদি বাইরে যায়, ঘড়ির কাঁটা মেপে তার প্রত্যাবর্তন আবশ্যক। তা না হলেই যেন তার চরিত্রে ‘দাগ’। তা না হলেই সে যেন ‘রাস্তার মেয়ে’। অর্থাৎ, রাস্তা মেয়ের হতে পারে না। যেন পথে তার অধিকার নেই। রাতে তার অধিকার নেই। রাতদখলের এই ভাবনা আপাতভাবে প্রতীকী। এক রাতের। কিন্তু এক রাতের ডাকে শামিল হওয়ার পেছনে অনেক রাতের ভয়ের অধ্যায় রয়ে গিয়েছে। আমরা দেখি, মেয়েদের চরিত্র এখনও ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা হয়ে রয়ে গিয়েছে। মেয়ে কাজ সেরে ফিরছে না ‘অকাজ’ করে ফিরছে, তার হিসাবও নেয় রাত।

মেয়েদের দিকে আঙুল ওঠার আরও নজির আছে। যৌন হয়রানির ঘটনা পরিবারের মধ্যে হলেও বহু সময় তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। এই ঘটনাতেও মেয়েটির ‘আত্মহত্যা’র ভুয়ো খবর তার বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল বলে শুনছি। রাজনৈতিক দলমতনির্বিশেষে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এই আখ্যান আমাদের অনেকের অবচেতনে এখনওও অমীমাংসিত ক্রোধ হয়ে রয়ে গিয়েছে। মন নিজের যুদ্ধ নিজেই ভুলে দিন গুজরান করে। করতে বাধ্য হয়। মানুষ অন্যায় সহ্য করতে করতে অসাড় হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আদতে অভ্যস্ত হয় না। সে-ও অর্থহীন, গতানুগতিক হুল্লোড়, বিতর্ক, কেজো সংলাপের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের অস্ত্বিত্বকে একটা লক্ষ্য দিতে চায়। কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন সেই অসাড়তার বাঁধ ভাঙে। বাইরের ডাকে আমাদের ভিতরের ডাক গলা মেলায়। পা মেলায়।

বুধবার রাতে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে যখন আমরা অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সমাজমাধ্যমে ফুটে উঠছিল অন্যান্য এলাকার ছবিও। সেখানেও বহু নারী একে অপরের পাশে হাঁটছেন। পুরুলিয়ার রাস্তায় যখন কিছু কিশোরীর মোমবাতি নিয়ে হাঁটার ভিডিয়ো দেখছি, যখন দেখছি শিলিগুড়িতে অনেক মানুষ জড়ো হচ্ছেন, তখনও সেই জ্বলে-ওঠা আলোর দিকে তাকিয়ে কানে আসছিল কিছু কিছু উক্তি। অন্তত এই রাতটা আমার বাড়িওয়ালা দেখুক। রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে যারা প্রশ্ন করে, সেই পাড়া নিজেই মোড়ের মাথায় মেয়েদের এগিয়ে দিক। এই রাত তাঁদের। এই রাস্তা তাঁদের।

শুধুই কি সমাজমাধ্যম এই ডাক একের থেকে অন্যের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছে? এমন প্রজন্মকেও বুধবার ভিড়ের মধ্যে দেখেছি, যাঁরা সমাজমাধ্যমে তেমন সক্রিয় নন। কিন্তু এসেছেন। যে প্রৌঢ়া তাঁর নাতির হাত ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছিলেন, তাঁর চলতে অসুবিধে হয়। নিঃসঙ্কোচে বলছিলেন, ‘‘আমায় তো আসতেই হত। বহু দিন আগে ডাক্তারি পাশ করেছি। এখনও মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করি। এই মেয়েটির কথা যত বার শুনেছি, মনে হয়েছে, এটা আমার কথাও হতে পারত।’’

অন্যের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাওয়ার যে মন, সেই মন আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই নিহিত থাকে। কোনও সংলাপ ছাড়াই এক মনের নিহিত আবেগ অন্যের মনের সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে পারে। ইউং বলেছিলেন, ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’-এর কথা। অর্থাৎ, আমাদের মনের অবচেতনও শুধু তাঁর ব্যক্তি মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বহু সময় সে এক থেকে অন্যতে সঞ্চারিত হতে থাকে। সমবেত মনেরও এক নিজস্ব গুপ্তকুঠুরি আছে। চোরাপথ আছে। আমাদের অনেকের মধ্যে লালিত বিশ্বাস, উদ্যম কিছু কিছু সময়ে একই ধারায় প্রবাহিত হয়। সেই সমবেত অবচেতনের সম্ভার থেকে যে উচ্চারণ উঠে আসে তা সংক্রামক। তা অদম্য।

এত মানুষের সমাগম কি আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত? এর মধ্যে কি কোথাও কোনও রাজনৈতিক ইন্ধন নিহিত ছিল? এমন প্রশ্নও যে কানে আসেনি তা নয়। রাজনীতি মানে তো শুধু দলীয় রাজনীতি নয়। লিঙ্গবৈষম্যের যে রাজনীতি, ক্ষমতার আস্ফালনের যে রাজনীতি, বুধবার আমরা তার বিরুদ্ধেও দাঁড়াচ্ছিলাম। দলীয় রাজনৈতিক ডাক আমাদের অনেক বেশি বিভাজিত করে। তোমার দলের ডাকে আমি আসব না। আমার দলের ডাকে তুমিও আসবে না। এই চিত্র আমাদের পরিচিত। বুধবার অ্যাকাডেমি চত্বরে কিন্তু এ ছবি চোখে পড়েনি। বরং এমন অনেক মানুষকে দেখেছিলাম, যাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা বলেই ব্যক্তিগত সূত্রে জানি। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ও আলাদা। কিন্তু তাঁরা একে অপরের সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। ভাঁড়ের চা ভাগ করে নিচ্ছিলেন। আলোচনা করছিলেন সুরক্ষা নিশ্চিত করার নানা পথ নিয়ে। আশা রাখি তাঁরাও দলীয় ভূমিকার দায়ে এই সংলাপ ভুলে যাবেন না।

এক রাতের প্রতিবাদে সব আলো ফোটে না। কিন্তু নিজের ভেতরের যে কণ্ঠ বুধবার মধ্যরাতে আমরা শুনতে পেলাম, তাকে যেন আবার অবচেতনে পাঠিয়ে না দিই। সে বিষয়ে সচেতন প্রয়াস থাকুক। আমাদের জীবনে রাত্রি নামুক। কিন্তু আমরা যেন অন্ধকারকে প্রশ্রয় না দিই।

(লেখক পেশায় মনোবিদ। মতামত নিজস্ব)

আরও পড়ুন
Advertisement