Digital Arrest Scam

ট্রু কলার ‘ট্রু’ নয় সবসময়, ফোন নম্বর চেনার অ্যাপেই ‘ডিজিটাল অ্যারেস্টের’ ফাঁদ! এড়াবেন কী ভাবে?

ট্রু কলার জরুরি অ্যাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার তথ্য সঠিক হয়। কিন্তু তা নিয়ে যে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, মানছেন বিশেষজ্ঞেরাও। সাইবার অপরাধে এই অ্যাপেরও সুযোগ নেওয়া হচ্ছে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।

Advertisement
অঙ্গীরা চন্দ
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

রবিবারের অলস দুপুর। খাওয়াদাওয়ার পর কিঞ্চিৎ বিশ্রামের তোড়জোড় করছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী বেহালার বাসিন্দা যুবক। হঠাৎ ফোন অচেনা নম্বর থেকে। এ সব ক্ষেত্রে অনেকেই যা করে থাকেন, তিনিও তা-ই করেছিলেন। ‘ট্রু কলার’ অ্যাপে নম্বরটি ফেলে ফোনকারীর পরিচয় জেনে নেওয়া। স্ক্রিন তাঁকে আইপিএস অফিসারের নাম দেখিয়েছিল।

Advertisement

ভয়ে ভয়ে ফোন ধরার পরে ভেসে আসে অচেনা কণ্ঠ। ইংরেজিতে কথা শুরু হয়। নম্বর যাচাই করার পরে প্রশ্ন আসে, ওই যুবকের আর কোনও নম্বর আছে কি না। নেই, বলার পর আসে পরিচয়, ফোনকারী মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে কথা বলছেন। জানতে চাওয়া যায়, আগের মাসে মুম্বই গিয়েছিলেন কি না ওই যুবক। তার পরে আসে পুলিশি বাণী, ‘‘গুজরাত সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচারের সঙ্গে আপনি যুক্ত বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেই অভিযোগে এখনই আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’’

বলা বাহুল্য, তত ক্ষণে ঘাবড়ে গিয়েছেন ওই যুবক। ভয় পেয়েছেন। উল্টো দিক থেকে অনর্গল বলা হতে থাকে, তিনি কী কী অপরাধ করেছেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে ‘জেরা’। তার পরে ফোনের ওপারের সুর খানিক নরম হয়। সেই অচেনা কণ্ঠ বলে, ‘‘আমাদের মনে হচ্ছে, আপনি ফেঁসে গিয়েছেন। আপনার নাম এবং নম্বর ব্যবহার করে কেউ এই ধরনের মাদক পাচার করছে। বড়সড় চক্রে আপনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’

সমাধানও দেয় সেই কণ্ঠই, ‘‘ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আপনি আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলুন। আপনাকে আমরা ডিজিটালি অ্যারেস্ট করেছি। তাই আইনি প্রক্রিয়ায় জামিন নিতে হবে। আপনাকে একটা লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। ভিডিয়ো কল করুন। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলুন।’’ নির্দেশ মতো লিঙ্কে ক্লিক করে ভিডিয়ো কলে ঢোকেন ওই যুবক। সেখানে দেখা যায়, থানার মধ্যেই আইনজীবী বসে আছেন। পিছন থেকে থানাসুলভ কোলাহল ভেসে আসছে। আইনজীবী যুবককে জানান, ডিজিটাল মাধ্যমেই জামিন পাওয়া সম্ভব। তার জন্য দিতে হবে ৬০ হাজার টাকা। না দিতে পারলে বাড়িতে পুলিশ এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যাবে। হুমকি শুনে অনলাইনে সেই টাকা মিটিয়ে দেন যুবক। তাঁকে পাঠানো হয় জামিনের ‘রসিদ’। তার পর আর কোনও ফোন আসেনি। আসার কথাও নয়। বেহালার ওই যুবককে যে বা যারা ফোন করেছিল, তারা আদৌ পুলিশ নয়। মাদক পাচারের তদন্তের সঙ্গেও তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ৩৫ বছর বয়সি এক যুবককে স্রেফ বোকা বানিয়ে ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাইবার অপরাধীরা। নিয়েছে তাঁর বিশ্বাস আর ভয়ের সুযোগ।

একই ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতি দিন কোথাও না কোথাও ঘটছে। কেউ ফাঁদে পা দিয়ে টাকা খোয়াচ্ছেন। কেউ উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বেঁচে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমনই যে, সাইবার প্রতারকদের ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ কৌশল নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সতর্ক করেছেন দেশবাসীকে। ফোনের কলার টিউনেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেই সতর্কবাণী।

সতর্ক হওয়া যে প্রয়োজন, তা পই পই করে বলছেন বিশেষজ্ঞেরাও। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কর্তা কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট বলে তো কিছুই নেই! এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথা। গ্রেফতারি কখনও ‘ডিজিটাল’ হতে পারে না। ভারতীয় আইন অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতার করতে হলে পুলিশ আধিকারিককে তাঁকে শারীরিক ভাবে স্পর্শ করে বলতে হবে, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’। অর্থাৎ, অভিযুক্তের সামনে পুলিশকে সশরীরে উপস্থিত হতে হবে। ফোন করে কাউকে গ্রেফতারির কথা বলা যায় না। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করাও যায় না।’’

কী ভাবে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’-এ ট্রু কলারের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়টিও ব্যাখ্যা করেছেন কল্যাণ। তাঁর কথায়, ‘‘ডিজিটাল অ্যারেস্টে প্রতারকেরা একটা বিশেষ ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করে। এতে অদ্ভুত ভাবে ট্রু কলারের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। মানুষ এই অ্যাপে যা দেখে, তা চট করে বিশ্বাস করে। ধরুন, আমি একটা নতুন সিম কিনে আমার পরিচিত কয়েক জনকে সেই নম্বর দিলাম এবং কোনও আইপিএস অফিসারের নামে সেই নম্বর সেভ করতে বললাম। ট্রু কলার কিন্তু তখন সেই নামটিই সকলকে দেখাবে। ফলে ওই অ্যাপের মাধ্যমে ভুয়ো ছবি এবং ভুয়ো নাম নিয়ে ডাকাবুকো পুলিশ আধিকারিক সাজা জলভাত। সেই ফাঁদেই অনেকে পা দিয়ে ফেলছেন।’’

থানা থেকে বলছি

কৌশলে থানার পরিবেশও তৈরি করছে সাইবার প্রতারকেরা। কল্যাণ বলেন, ‘‘ফোন করে পুলিশ সেজে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘আপনাকে ডিজিটালি গ্রেফতার করা হল’। ফোনে এবং ভিডিয়ো কলে হুবহু থানার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।’’ যা দেখে মনে হবে, থানায় বসেই জেরা করছেন পুলিশ আধিকারিক। ডিজিটাল গ্রেফতারির ফাঁদে ফেলে বলা হয় ডিজিটাল জামিনের কথা। সেই জামিন বাবদেই টাকা চাওয়া হয়। কারও থেকে ২০ হাজার, কারও থেকে দু’লক্ষও। শিকার ধরার আগে তার সামর্থ্য বুঝে নেয় প্রতারকেরা। যেমন তারা করেছিল বেহালার ভুক্তভোগী যুবকের সঙ্গে।

ফোনও প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে

ডিজিটাল অ্যারেস্টের কয়েকটি ঘটনায় অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, তাঁদের ফোন বা ল্যাপটপ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না! যে কয়েক ঘণ্টা তাঁরা প্রতারণা চক্রে আটকে থাকছেন, সেই সময়ের মধ্যে কেউ মেসেজ পাঠালে তা দেখা যাচ্ছে না। ফোন আসছে না। এমনকি, নিজের অজান্তেই বন্ধুদের কাছে চলে যাচ্ছে ‘আমি ঠিক আছি’ মেসেজ! কল্যাণ জানিয়েছেন, সাইবার অপরাধের জগতে খুব চেনা শব্দ ‘ট্রোজান’। এটি এক ধরনের ভাইরাস, যার মাধ্যমে অন্য কারও ফোন বা ল্যাপটপ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট ‘ডিভাইসে’ কোনও ব্যক্তিকে স্ক্রিন শেয়ার করতে বলা হয়। ডিজিটাল অ্যারেস্টেও এই কৌশল অবলম্বন করা হয়। ভিডিয়ো কলে স্ক্রিন শেয়ার করলেই ওই নির্দিষ্ট ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অন্যের ডিভাইসে। তার পর সেই ডিভাইস দূর থেকে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

কী করণীয়?

ট্রু কলার জরুরি অ্যাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অ্যাপের তথ্য সঠিক হয়। কিন্তু সবসময় নয়। নিয়মের ফাঁকফোকর খুঁজে প্রতারকেরা এই অ্যাপ কাজে লাগাচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আরও সতর্ক হতে হবে। পুলিশ-প্রশাসন নয়, সতর্কতা এবং সচেতনতাই ডিজিটাল অপরাধের হাত থেকে বাঁচাতে পারে সাধারণ মানুষকে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের ডিআইজি অঞ্জলি সিংহের কথায়, ‘‘ট্রু কলার বা ওই ধরনের যে কোনও অ্যাপের সুযোগ নিতে পারে প্রতারকেরা। অন্য কারও মুখোশ পরে তারা বোকা বানানোর চেষ্টা করে। অপরিচিত নম্বর নিয়ে সতর্ক থাকুন।’’ কোনও অপরিচিত উৎস থেকে আসা অপরিচিত লিঙ্কে ক্লিক না-করার পরামর্শও দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কোন লিঙ্কে কী ফাঁদ লুকিয়ে আছে, কেউ জানে না। অনেক সময়ে অসাবধানতার একটি ক্লিকই বিপদ ডেকে আনতে পারে। কল্যাণের পরামর্শ, ‘‘ডিজিটাল অ্যারেস্টের কোনও আইনি ভিত্তি নেই। এই ধরনের কথা কেউ যেন বিশ্বাস না করেন। এই ধরনের ফোন এলে অবশ্যই পুলিশকে জানান। আপনি অন্যায় না-করে থাকলে কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। অচেনা কোনও লিঙ্কে না বুঝে ক্লিক করবেন না।’’

সাইবার অপরাধের জাল বিস্তৃত অনেক দূর পর্যন্ত। তবে দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সে ফাঁদ এড়ানোও যায়। আরও সজাগ হতে হবে। স্মার্টফোন নিয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তা হলেই সাইবার অপরাধীরা আর সফল হবে না। (চলবে)

Advertisement
আরও পড়ুন