২৬/১১ কভারেজকে কিছু পেশাগত সহকর্মী ‘লাইফটাইম অ্যাসাইনমেন্ট’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন বটে। তাঁদের বলা যেত, এ অ্যাসাইনমেন্ট মনে রাখার মতো নয়। ভুলে যাওয়ার মতো। ফাইল চিত্র।
বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর টুইট করেছেন, ‘নেভার ফরগেট।’ কখনও ভুলব না।
ছেষট্টি বছরের জয়শঙ্করকে দেখলে সমীহ হয়। ঈর্ষণীয় তাঁর কূটনৈতিক কেরিয়ার। নয়াদিল্লির সেন্ট স্টিফেন্সের প্রাক্তনী। অতঃপর জেএনইউ হয়ে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে। দীর্ঘ ৩৮ বছর সেখানেই বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত। কালক্রমে রাজনীতিতে। এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবপ্রাপ্ত। ইম্প্রেসিভ। সমীহ এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী। তিনি যখন বলছেন, ভুলবেন না, তখন ভোলে কোন আহাম্মক!
সুপারস্টার ক্রিকেটার বিরাট কোহলী জোড়হাতে নমস্কারের ইমোজি-সহ টুইট করেছেন, ‘উই উইল নেভার ফরগেট দিস ডে। উই উইল নেভার ফরগেট দ্য লাইভ্স লস্ট। সেন্ডিং মাই প্রেয়ার্স টু দ্য ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলিজ হু লস্ট দেয়ার লাভড ওয়ান্স।’
তেত্রিশের কোহলী আধুনিক তথা তরুণ ভারতের অবিসংবাদী পূজিত বিগ্রহ। ব্যাট-হাতে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন-করা সম্রাট। আগ্রাসনের সার্থক প্রতিমূর্তি। সফল অভিনেত্রী স্ত্রী। কন্যাসন্তানের স্নেহময় এবং গর্বিত পিতা। আদতে নয়াদিল্লির বাসিন্দা অধুনা সংসার পেতেছেন আরবসাগরের তীরে। ইনস্টাগ্রামে ছবি দিলে নিমেষে লক্ষ লক্ষ ‘লাইক’। ইনিও ‘পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত’। আর যে গতিতে এগোচ্ছেন, কোনও না কোনওদিন নির্ঘাত ‘ভারতরত্ন’ হবেন। তা তিনি যদি লেখেন, এই দিনটা কখনও ভুলবেন না, তখন কি কেউ ভুলেও ভুলে যায়!
দেশের প্রধানমন্ত্রীর পরেই সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত সেলিব্রিটিদের সেলিব্রিটি তথা শ্রদ্ধেয় পিতামহ ভীষ্ম অমিতাভ বচ্চন বিশাল লেখা লিখেছেন। যেখানে তিনি জঙ্গি হামলার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশাকে। যে বক্তব্যের মোদ্দা কথা— ওইদিনটা কখনও ভুলব না। এ-ও ভুলব না যে, প্রচুর চাপ থাকা সত্ত্বেও ২৬/১১-র হামলার পর ভারত চূড়ান্ত সংযম দেখিয়েছিল।
বয়স আশির দোরগোড়ায়। দেশের সর্বত্র বিলবোর্ডে, কাগজে, চ্যানেলে-চ্যানেলে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চকাট-সমন্বিত তাঁর মুখ। তাঁর ব্যারিটোন। তাঁর নিদান। তাঁর আহ্বান। দুষ্টু লোকেরা অবশ্য বলে, বচ্চন সবসময় বচ্চনের ভূমিকাতেই অভিনয় করেন। বিজ্ঞাপনেও। কিন্তু তাতে আর পাঁচপেঁচি লোকের কী যায়-আসে! তিনি যখন বলেছেন, ভুলবেন না, তখন ভোলে কার সাধ্য! ঈশ্বরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কোন মর্কট!
অতএব বাবাসকল, ২৬/১১ হামলার ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তিতে বার্তা একটাই— ভুলব না। যা পড়তে পড়তে এক প্রান্তবাসী ভাবছিল, গত ১৩ বছর ধরে সে যে ক্রমাগত ভোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তা কি আসলে ভুল!
আচ্ছা, এই লেখাটা কি লিখতে দেরি হয়ে গেল? দেরি হয়ে গেল শোকপ্রকাশে? স্মৃতিরোমন্থনে? ঠিকই। দেরি হয়ে গেল। দেরি হয়ে গেল প্রায় দেড়শো ঘন্টা! এবার কী হবে? দ্রুতধাবমান চতুর্পাশ্ব তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন ঘটনাপ্রবাহে। নতুন নতুন শোক-রাগ-বিস্ময়-ক্ষোভ-অভিযোগ-অনুযোগ প্রকাশে। কুলুঙ্গি থেকে ধুলো-টুলো ঝেড়ে নামানো পুরোন এই পুঁথি কেউ পড়ে দেখবে তো!
২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর চলে গিয়েছে সেই শুক্রবার! এই লেখা বেরোচ্ছে তার পরের বুধবার। দেরি তো হলই! ২৬/১১-র শোক, প্রতিজ্ঞা, ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ়বদ্ধ সংকল্প— সব ট্রাঙ্কে তুলে রেখে সারা দেশের মন তো আবার নিজ নিজ নিকেতনে চলে গিয়েছে।
বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে।
কানপুর টেস্ট থেকে বিরতি নিয়ে মুম্বই টেস্টে দলে ফেরত আসার আগে ক্যাপ্টেন কোহলী অপূর্ব নিসর্গশোভিত দিঘির পাড়ে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে ঘন হয়ে বসে থাকার ছবি দিচ্ছেন ইনস্টাগ্রামে। সঙ্গে মনোহরা ক্যাপশন, ‘তুমি না থাকলে যে এই জীবনটা নিয়ে যে কী করতাম!’
বচ্চন ফিরে গিয়েছেন ‘কওন বনেগা ক্রোড়পতি’-র স্নেহশীল জাতির দাদুর ভূমিকায়। যেখানে তিনি টাকার ঝুলি নিয়ে কম্পিউটার’জির সামনে বসে থাকেন। মুখে উচাটন ভাব— কখন টাকার তোড়া গুঁজে দিতে পারবেন উল্টোদিকে-বসা নবীন ভারতের পকেটে।
এঁরা ২৬/১১ ভুলবেন না। এঁরা প্রতিবছর নতুন করে প্রতিজ্ঞা করবেন— যে ভোলে ভুলুক, আমি কভু ভুলিব না!
কিন্তু ভুলতে চায় ভিনরাজ্য থেকে মুম্বই হামলা কভার করতে-যাওয়া এক পেশাদার সাংবাদিক। ভুলতে চায় তিনদিন তিনরাতের সেই বিভীষিকা! যেখানে মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। আহত হয়েছিলেন ৩০৮ জন।
ভুলতে চায় কয়েক হাত দূর থেকে ফটফট ফটফট করে উজি সাব মেশিনগানের স্ট্যাকাটো বার্স্ট ফায়ার। ভুলতে চায় গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে থেকে ‘মাঙ্কি ক্রল’ করে কমান্ডোদের তাজমহল হোটেলে ঢোকার প্রাণান্তকর চেষ্টা। ভুলতে চায় সেই পাথুরে জমিতে (অন্যথা যেখানে সবসময় খুশিয়াল ভিড়। মুম্বই-দর্শনের অন্যতম টুরিস্ট স্পট) উপুড় হয়ে শোওয়া চেহারাগুলো। প্রত্যেকের সামনে বেঁটে বেঁটে স্ট্যান্ডের উপর রাখা মিসাইল এবং রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড লঞ্চার। ভুলতে চায় ৪৫ ডিগ্রি কোণে তাদের উদ্যত মুখ থেকে আগুন উগরে একেকটা বিস্ফোরক নিক্ষেপ। যেগুলো গিয়ে গদাম গদাম করে ফাটছিল কখনও কয়েকশো মিটার দূরের হোটেলের দোতলার রেস্তোরাঁর মধ্যে, কখনও একতলার পোর্টিকোয়। ভুলতে চায় কমান্ডোর কড়া ধমকে হোটেলের পাশ ঘেঁষে যাওয়া দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়া।
ভুলতে চায় তাজমহল হোটেলের বিখ্যাত মেরুন গম্বুজের পাশ বেয়ে অতিকায় অজগরের মতো উঠতে-থাকা কালো ধোঁয়া। ভুলতে চায় প্রতিটা ব্রাশ ফায়ারের সঙ্গে উড়তে-থাকা পায়রার ঝাঁকের পাখার ঝটপট শব্দ। উড়তে উড়তে তাদের দিগন্তে মিলিয়ে-যাওয়া। তার পর আবার একটা পাক খেয়ে ফেরত আসা মুম্বইয়ের অন্যতম বিখ্যাত অভিজ্ঞানের সামনে।
ভুলতে চায় ইহুদিদের আবাস দক্ষিণ মুম্বইয়ের তিনতলা বাড়িটার কথা। নরিম্যান হাউস। চাবাদ হাউস। ভুলতে চায় সেই চাবাদ হাউসের ঠিক পাশের বাড়ির ছাদে হাঁচোড় পাঁচোড় করে ওঠা। যার প্রতিটি তলায় আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, প্রত্যয়হীনতা জমাট বেঁধে আছে। প্রতিটি ঘরের সিলিং থেকে অনিশ্চয়তা ঝুলে আছে বাদুড়ের মতো। সেই বাড়ির উপর বিছিয়ে-থাকা আকাশে ভীমবেগে ঘুরছে ভারতীয় বায়ুসেনার এমআই-১৬ হেলিকপ্টারের রোটর ব্লেড। সেই ঘূর্ণায়মান চক্রে বাতাস কাটতে কাটতে অন্তরীক্ষে স্থির হয়ে রয়েছে অতিকায় খেচর। তার অভ্যন্তর থেকে মোটা মোটা দড়ি বেয়ে আশপাশের বাড়ির ছাদে নেমে আসছেন এনএসজি কমান্ডোরা। কাঁধে আড়াআড়ি ঝুলছে কালান্তক মেশিনগান। কোমরে ঝুলছে কার্তুজের একস্ট্রা ম্যাগাজিন।
কৌতূহলী হয়ে সেই আগন্তুক জানতে চেয়েছিল ওই সড়াৎ সড়াৎ করে দড়ি বেয়ে নেমে আসাটাকে কী বলে! নাম না-জানা অথচ বিজ্ঞ সহ নাগরিক বলেছিলেন, ‘স্লিদারিং ডাউন।’ নতুন-জানা শব্দটা নোটবইতে টুকে নিতে নিতে ভারতের নাগরিক ভূমিতে তদবধি প্রথম জানকবুল যুদ্ধের রিংয়ের ধারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসনে বসে-থাকা যুবক ভেবেছিল, রাতে ডেসপ্যাচ পাঠানোর সময় এই টেকনিক্যাল বিষয়টা কপিতে রাখতে হবে।
ঠিক তখনই তার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যাচ্ছিল সামনের বাড়িটার ভিতরে ক্রমাগত ছুড়ে-দেওয়া গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে। ছাদের পাঁচিলের আড়ালে শুয়ে পড়তে হয়েছিল নরিম্যান হাউসের ভিতর থেকে ছুটে-আসা অ্যাসল্ট রাইফেলের জবাবি গুলিবৃষ্টি থেকে বাঁচতে!
কিছুক্ষণ পর সে ছুটেছিল কোলাবায় ‘লিওপোল্ড কাফে’-তে। যার কথা সে পড়েছিল জেল পালিয়ে মুম্বইয়ে এসে-পড়া অস্ট্রেলীয় ব্যাঙ্ক ডাকাত গ্রেগরি ডেভিস রবার্টের লেখা ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘শান্তারাম’ নামের এক পেল্লাই উপন্যাসে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ‘পুলিশ লাইন, ডু নট ক্রস’ লেখা বাঁধন টপকে ভিতরে গিয়ে সে দেখেছিল দক্ষিণ মুম্বইয়ের অভিজাত আড্ডাস্থল কাফে লন্ডভন্ড। উল্টে পড়ে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। দেওয়ালে গুলির গর্ত। তার আশেপাশে শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে রক্তের দাগ। চোখ বুজে সে কল্পনা করার চেষ্টা করেছিল, কী ধুন্ধুমার হয়েছিল আগের রাতে।
তার পরেই সে দৌড়েছিল ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে। সেখান থেকে কামা হাসপিটালে। সেখান থেকে ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেলে। হাতে নোটবুক-কলম। সামনে সারি সারি অপরিচিত আতঙ্কিত মুখ। হাসপাতালের মর্গে লাশের সারি। আর হাঁটু গেড়ে থম মেরে বসে-থাকা দেশের অসহায় বাণিজ্যিক রাজধানী।
১৩ বছর পরেও তার কানে অবিশ্রান্ত বাজে মেশিনগানের সেই আওয়াজ আর ঝটপট করে পায়রা উড়ে যাওয়ার শব্দ। তার সঙ্গে মিলেমিশে যায় অতিকায় হেলিকপ্টারের প্রপেলারের আওয়াজ আর লাশকাটা ঘরের সামনে একটানা গোঙানির মতো কান্নার আওয়াজ। বায়োস্কোপের ছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে থাকে বিভিন্ন স্থিরচিত্রের কোলাজ। ট্রাইডেন্ট হোটেলের খিড়কির দরজার সামনে দাঁড়-করানো বাস। হাঁকুপাঁকু করে সেখানে এসে উঠছে সব সম্ভ্রান্ত চেহারা। বিস্রস্ত, ধ্বস্ত, প্রাণভয়ে ভীত, দমফোট উত্তেজনায় কণ্ঠা ওঠানামা করছে। অ্যাডামস অ্যাপলে থমকে আছে ভয়। সীমাহীন ভয়।
ভুলতে চাই। ভুলতে চাই।
২০০৮ সালের শেষাশেষি ২৬/১১ কভারেজকে কিছু পেশাগত সহকর্মী ‘লাইফটাইম অ্যাসাইনমেন্ট’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন বটে। তাঁদের বলা যেত, এ অ্যাসাইনমেন্ট মনে রাখার মতো নয়। ভুলে যাওয়ার মতো।
হেমন্ত কারকারে, বিজয় সালাসকর, অশোক কামটে— মুম্বই পুলিশের জঙ্গিদমন শাখার তিন ডাকাবুকো অফিসারের পরিবার, পরিজন, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা, মনে রাখতে চাইবেন? ভুলতে চাইবেন না?
কেউ রাখেন তাঁদের খোঁজ? কেউ রেখেছেন?
এনএসজি-র মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণনের বৃদ্ধ পিতা কি মনে রেখেছেন দিনটা? মনে রাখতে চেয়েছেন? একমাত্র পুত্র জঙ্গির গুলিতে তাজমহল হোটেলের লবিতে লুটিয়ে পড়ার পর যাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন কর্নাটকের মন্ত্রী। পু্ত্রহারা বৃদ্ধ তাঁকে খেদিয়ে দিয়েছিলেন।
বৈশালী ওম্বলে মনে রেখেছেন দিনটা? মনে রাখতে চেয়েছেন? যাঁর বাবা মুম্বই পুলিশের কনস্টেবল তুকারাম ওম্বলে প্রাণের ভয় না করে ধরেছিলেন আজমল আমির কসাবকে? তুকারাম না-থাকলে মুম্বই হামলার একমাত্র জীবিত অভিযুক্তকে হাতে পেত না ভারত সরকার। আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রমাণ করা যেত না ২৬/১১ হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ।
কর্নাটকের সেই বৃদ্ধ কি আরও বৃদ্ধ হয়েছেন? নাকি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন পরপারে? জীবিত থাকলে তিনি কি বলতেন, ‘‘ভুলছি না! ভুলব না!’’
কেউ রাখেন তাঁর খোঁজ?
২৬/১১ হামলার একবছর পূর্তিতে দাদার পুলিশ লাইনে তুকারামের আবাসনে গিয়ে এক যুবক দেখেছিল, নীচে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তির জন্য। সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে পায়রার খোপের মতো একটা ফ্ল্যাট। কলিং বেল শুনে দরজা খুলে দিয়েছিলেন সাধারণ চেহারার এক কন্যা। সদর দিয়ে ঢুকে টেবিলের উপর বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে চন্দনকাঠের মালা। ছবি থেকে জগৎসংসারের দিকে অপলক তাকিয়ে এক সাধারণ উর্দিধারী। মুখে মৃদু হাসি। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বৈশালী বলেছিলেন, যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। বাবার জন্য গর্ব হয় ঠিকই। কিন্তু মনে হয়, সেদিন কেন ডিউটিতে গেলেন! বলেছিলেন, তিনি প্রাণপণে তাকিয়ে আছেন মুম্বই পুলিশের করণিকের চাকরিটার দিকে। সেটা না-পেলে তাঁদের জীবন সঙ্কটাপন্ন পড়বে।
কেউ রাখেন তাঁর খোঁজ?
প্রায় তার কাছাকাছি সময়ে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ায় দাঁড়িয়ে ক্লিন্ন চেহারার গাইড হাঁকছিলেন, ‘‘আসুন! দেখে যান কোথায় কোথায় হামলা হয়েছিল এক বছর আগে।’’ শুনতে শুনতে আগন্তুক যুবকের মনে হয়েছিল, এ তো ‘টেরর ট্যুরিজ্ম’! সন্ত্রাসের পর্যটন। সে লিখেছিল, ‘যো দিখতা হ্যায় ওহ্ বিকতা হ্যায়’। যা দেখা যায়, তা-ই বাজারে বিকোয়।
চোখ বুজলে সেই যুবক এখনও দেখতে পায়, মলিন খুপরির মতো ফ্ল্যাটে রাখা ছবির সামনে ধূপদানি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে তাজমহল হোটেলের মেরুন গম্বুজের পাশ থেকে উঠে-আসা কালো অজগর। ছেয়ে ফেলছে। গিলে নিচ্ছে চরাচর। নীচে দাঁড়ানো দমকলের ইঞ্জিন অবিশ্রান্ত জল ছিটিয়ে দাউ দাউ আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। ‘মাঙ্কি ক্রল’ করে এগোচ্ছেন এনএসজি কম্যান্ডোরা। ৭২ ঘণ্টার ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’ দীর্ঘস্থায়ী পদচিহ্ন রেখে গিয়েছে তার পেশাদার জীবনে। মাঝেমধ্যেই ঘুরেফিরে আসে সেই বাহাত্তর ঘণ্টা। তখন সে ঝুম হয়ে বসে ভাবে। সে ভুলতে চায়। প্রাণপণে ভুলতে চায়। ভুলতে পারে না!
জয়শঙ্কর-কোহলী-বচ্চনের মতো দেবাদিদেবরা তাঁদের বাৎসরিক প্রতিজ্ঞায় অনড়-অটল-অটুট থাকুন। কিন্তু দিনটাকে ভুলতে বারণ করবেন না প্লিজ! ভুলতে দিন! দয়া করুন!