গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে এমন বিষয় কল্পনা করা দুরূহ যে, একজন পারিষদীয় আধিকারিক পুলিশকে নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নির্দেশ প্রদান করছেন। একমাত্র ইন্দিরা গাঁধী-ঘোষিত জরুরি অবস্থার কালেই এমন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। জরুরি অবস্থার কথা মনে রেখেও বলা যায়, এমন কোনও সময়ের বিষয়ে আমরা জানি না, যখন সেনাবাহিনীর চার-তারকা লাঞ্ছিত কোনও আধিকারিক শৃঙ্খলায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েও কোনও ‘সন্ত্রাসবাদীর’ (সম্ভবত জনতার দ্বারা চিহ্নিত) বিরুদ্ধে গণহিংসাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীন ভারতে যে সমস্ত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম।
ভারতের ইতিহাসে হিংসার উদাহরণ আদৌ বিরল নয়। কখনও তা এসেছে আক্রমণকারী বা অন্যদের হাত ধরে। অনেক সময়ে হিংসাকে অহিংসার মুখোশ পরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, বিশেষ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে। তার পরে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের রূপ নেওয়ায় সেই মুখোশ খসেও পড়েছে। এ দেশে দলিতদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত এবং পর্যায়ক্রমিক হিংসা সংঘটিত হওয়ার উদাহরণ অবিরল। সেই সঙ্গে ক্ষমতাহীন উপজাতীয় মানুষকে তাঁদের স্বাভাবিক বাসভূমি থেকে বলপূর্বক উৎখাত করার দৃষ্টান্তও প্রচুর। সম্প্রতি এ সবের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবিকাহীন করার এক নিষ্ঠুর অথচ নৈমিত্তিক প্রক্রিয়া, যা অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিকে বিপুল ভাবে বিপর্যস্ত করছে। এই প্রক্রিয়াকে বিধিবদ্ধকরণের (ফর্মালাইজেশন) নাম দিয়ে দস্তুরমতো উদ্যাপনও করা হচ্ছে।
বেশির ভাগ সমাজে হিংসা অবধারিত ভাবেই দুর্বলের প্রতি সবলের দ্বারা, জীর্ণ বেশধারীদের উপর চকচকে উর্দিধারীদের দ্বারা, সংখ্যাগুরুদের দ্বারা এক বা একাধিক উপায়ে নির্ধারিত ‘সংখ্যালঘু’দের প্রতি প্রযুক্ত হয়। সংজ্ঞার দিক থেকে দেখলে হিংসার উপরে রাষ্ট্র একতরফা অধিকার ভোগ করে বলে মনে হতেই পারে। ফলে, রাষ্ট্র কখনও নিজে হিংসা নামক দুষ্কর্মের সংঘটক, কখনও অনুঘটক আবার কখনও বা সহায়তা প্রদানকারী দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আপনি এর পিছনে যুক্তি হিসেবে সামাজিক-ডারুইনবাদকে খাড়া করতেই পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে একটি প্রাচীন হিন্দি প্রবাদকেই সব থেকে বেশি লাগসই বলে মনে হয়। সেটি হল—‘জিসকি লাঠি, উসকি ভঁইস’ (বঙ্গার্থ: যার লাঠি, তারই মোষ)।
ডারুইনবাদ-কথিত ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’-এর তত্ত্বের সমান্তরালে গত বছর ব্রায়ান হেয়ার এবং ভেনেসা উডস নামে বিজ্ঞান-লেখক দম্পতি একটি বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেটির নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট’ বা ‘সব থেকে বন্ধুভাবাপন্নের টিকে থাকা’। তাঁদের রচিত গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফ্রেন্ডলিয়েস্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং আওয়ার অরিজিনস অ্যান্ড রিডিসকভারিং আওয়ার কমন হিউম্যানিটি’ (বঙ্গার্থে, আমাদের উৎসকে বোঝা এবং মানবত্বের সাধারণ সূত্রগুলিকে পুনরাবিষ্কার করা)। এই গ্রন্থে হেয়ার এবং উডস যুক্তি দিচ্ছেন, ডারউইনবাদকে বন্ধুভাবাপন্নতার পাশাপাশি ফেলে দেখার অবকাশ রয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবৃত্তিগত ক্ষমতাকেও বিচার করা প্রয়োজন, যার সাহায্যে মানুষ তার অভিযোজন সূত্রে নিকটতম আত্মীয়দের থেকে এগিয়ে থেকেছে। কর্পোরেট সংস্কৃতিতে বিষয়টি যতখানি নির্মম সত্য, সত্য ক্রিকেট দল বা একক মানুষের ক্ষেত্রেও, ঠিক ততখানিই সত্য সামগ্রিক অর্থে সমাজের ক্ষেত্রে। এই নিয়ম অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও সত্য।
হেয়ার এবং উডসের পূর্ববর্তী গ্রন্থটির নাম ‘দ্য জিনিয়াস অব ডগস: হাউ ডগস আর স্মার্টার দ্যান ইউ থিঙ্ক’ (বঙ্গার্থ: ‘কুকুরের প্রতিভা: আপনি যা ভাবেন, তার চাইতেও কুকুর কতটা চৌখস’)। এই গ্রন্থে তাঁরা দেখাতে চেয়েছিলেন, মানুষের প্রতি কুকুরের বন্ধুভাবাপন্নতা আসলে তাদের বুদ্ধিমত্তা থেকেই জাত।
এ সমস্ত কিছুই সেই ভারতের জন্য প্রাসঙ্গিক, যেখানে নিত্য ঘৃণা-বাচনের উদ্গমন এবং বহিঃপ্রকাশ ঘটে চলেছে। যেখানে আইনানুগ এবং বেআইনি পথ-হিংসা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও মুহূর্তে ধাবমান হতে পারে। কেন তারা অন্য রকমের খাদ্য গ্রহণ করে— এমন অজুহাতে তাদের উপর যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। এমন সম্প্রদায়, যারা এতটাই দুর্বল যে এ ধরনের হিংসা রোধ করার সামর্থ্যই রাখে না অথবা সংখ্যাগুরুর সঙ্গে কোনও একটি বিষয়ে সহমত পোষণ করে না, তারাই এই হিংসার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক এই কারণেও যে, সহযোগিতামূলক আচরণেরও একটি তমসাচ্ছন্ন দিক রয়েছে: কোনও বিচ্ছিন্ন মানুষকে আক্রমণ করার ব্যাপারে একটি গোষ্ঠীর ভিতরেও মানুষ সহযোগিতা চালাতে পারে, যে শিক্ষা আমরা পেয়েছিলাম ‘মিসিসিপি বার্নিং’ (১৯৮৮) ছবিটি থেকে। কিন্তু এমন হিংসা প্রায়শই উঠে আসতে পারে কোনও এক দিনের এক বিশেষ মুহূর্তের উপলব্ধি থেকে। বিশেষ করে যখন তার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানগত এবং নীতিগত ভাঙন, তখন তা বৃহত্তর সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে পরিস্থিতিকে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমেরিকার সমাজকে কোনও অর্থেই সুস্থ বা নিরাপদ সমাজ বলা যায় না। কারণ, এই দেশে জনসংখ্যার নিরিখে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ কারান্তরালে বাস করেন। একই সঙ্গে এ-ও লক্ষণীয় যে, কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই শ্বেতাঙ্গ নন।
কখনও কখনও এক বিশেষ লক্ষ্যে পরিকল্পিত হিংসা অনভিপ্রেত লক্ষ্যগুলিতে বিস্ফোরিত হয়। মনমোহন সিংহ মাওবাদী (বিশেষ করে আদিবাসীদের) বিদ্রোহগুলিকে দেশের সব থেকে বড় অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে অভিহিত করেছিলেন। যে ভাবে একতরফা নিষ্পেষণমূলক আইন দ্বারা কাশ্মীরে আবদুল্লাদের কারান্তরালে নিয়ে যাওয়া হয়, তা-ও তো অভিপ্রেত ছিল না! আবার কংগ্রেস আইনের কেতাবে বেআইনি কার্যকলাপ (রক্ষা) আইন (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট) প্রবিষ্ট করার সময়ে অনুমানই করতে পারেনি যে, ‘আইন-বহির্ভূত কার্যকলাপ’-এর সংজ্ঞাটিই প্রসারিত হতে হতে এক বিরাট আকার ধারণ করবে এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে এমন এক ‘আইনহীন আইন’-এর তত্ত্বাবধান তথা সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য বিবিধ শ্রেণির আধিকারিকদের সংখ্যা।
সুতরাং, বাস্তবে বিষয়টি নিতান্তই সরল। এক মুক্ত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজ, যা তার বাসিন্দাদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমন্বয়ের দ্বারা সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং তা থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের মধ্যেকার বিভাজনরেখাগুলিকে মুছে দেবে। এবং সমাজে যত বেশি সংখ্যায় বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীর জন্মের প্রবণতা দেখা দেবে, গণহিংসা বা অন্তর্দ্বন্দ্ব-জাত গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়বে, তত বেশি পরিমাণে প্রতিষ্ঠানের তরফে প্রয়োজন পড়বে সব থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষগুলির টিকে থাকার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা, শুধু মাত্র ‘বলবান’ বা ‘যোগ্যতমে’র টিকে থাকাকে নয়।