সেই নিষ্পাপ মুখ। সুকুমার, অপাপবিদ্ধ চেহারা। মাথা ঢাকা নীল দোপাট্টায়। কান্না চেপে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মুখের পেশি অহরহ কুঁচকে যাচ্ছে।
বুশরা এখন কত বড় হল?
আলাপ ১৯৯৩ সালে। শেষ দেখাও বোধহয় সে বারই। শ্রীনগরের ‘এসপ্ল্যানেড’ লালচকের কাছে বুশরার বাড়ি। প্রতি সন্ধ্যায় সেই বাড়িতে ঢুকলেই খুদে বুশরা ঝাঁপ দিয়ে চলে আসত ‘ইন্ডিয়া’ থেকে আসা এক যুবকের কাছে। ‘ইন্ডিয়ান আঙ্কল’।
উর্দুতে ‘বুশরা’। বাংলা অনুবাদে ‘সুসংবাদ’। সুখবর।
বুশরার দাদার (নাকি ভাই?) নাম ‘জুনেইদ’। যে উর্দু শব্দের অর্থ ‘যোদ্ধা’। নামখানা সার্থক করে সে একটু ডানপিটে। তার সঙ্গে ‘ভারতীয় আঙ্কল’-এ সম্পর্কটা খুব একটা আঠালো হয়নি। সে দূর থেকে বড় বড় চোখে দেখত এক আজব আগন্তুককে। যে রোজ সূর্যাস্তের পর তাদের বাড়িতে ঢুকে মেঝের কার্পেটের উপর ল্যাটকা মেরে বসে কী সব লিখত। ঘন্টা তিনেক পর ফ্যাক্স মেশিনে কাগজ ঢুকিয়ে বিপুল কষ্ট করে সংযোগ স্থাপনের পর তৃপ্ত হয়ে কয়েক ফার্লং দূরত্বের হোটেলে ফিরে যেত।
কার্পেটের উপর থেবড়ে বসে সেই যুবক রিপোর্টার যখন কলকাতার অফিসে ফ্যাক্স করার জন্য এ ফোর সাইজের কাগজে অচেনা ভাষায় দৈনিক ডেসপ্যাচ লিখত, তখন তার কোল ঘেঁষে চুপটি করে বসে থাকত উমনো-ঝুমনো চুলের বুশরা। কাঠের উঁচু ছাদ থেকে ঝুলন্ত বাল্বের লো ভোল্টেজের টিমটিমে আলোয় লিখতে অসুবিধে হলে বুশরা সন্তর্পণে নিয়ে আসত উজ্জ্বল আলোর লম্ফ। লণ্ঠনের সেই আলো আভা ছড়াত বালিকা বুশরার লাল টুকটুকে গালে। তার দেবশিশু সুলভ মুখমণ্ডলে।
আঙ্কলের কাজ শেষের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কত সন্ধ্যায় যে কার্পেটের উপরেই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন শ্রীনগর প্রতিনিধি রশিদ আহমেদের বালিকা কন্যা। আর খসখস করে কপি লিখতে লিখতে ভিনরাজ্য থেকে-যাওয়া যুবক মাঝেমধ্যে সেই খুকির মাথায় রাখত ভরসা আর আদরের হাত।
বুশরার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মজ্জাগত স্বার্থপরতা, আলস্য এবং জীবনের নানা কুম্ভীপাকে পড়ে খোঁজও রাখিনি। যেমন ১৯৯৩ সালের প্রথম কাশ্মীর সফর এবং তার পর আরও কয়েকটা সফরের পর থেকে ‘অনিন্দ্যভাই’-এর সঙ্গে আর যোগাযোগ থাকেনি ‘রশিদভাই’-এর। যেমন সাধারণত হয়ে থাকে জীবনে। একই রেলসফরে একই কামরায় একই টিফিনবক্স থেকে খাবার ভাগ করে নেওয়ার নৈকট্য আর উষ্ণতা সহযাত্রীদের মধ্যে ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ ট্রেন তার গন্তব্যে না পৌঁছয়। স্টেশনে নেমে আবার তারা পরস্পরের কাছে অচেনা হয়ে যায়।
বুশরাও তেমনই মিলিয়ে গিয়েছিল বিস্মরণের কুয়াশায়। গত সপ্তাহে ঝপ করে বুশরাকে মনে পড়ে গেল!
বয়সে একটু বড়। কিন্তু অবিকল সেই নিষ্পাপ মুখ। সুকুমার, অপাপবিদ্ধ চেহারা। মাথা ঢাকা নীল দোপাট্টায়। কান্না চেপে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মুখের পেশি অহরহ কুঁচকে যাচ্ছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে ঘন কালো দুই ভ্রূ। ঠোঁট কাঁপছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। দমকে দমকে কান্না আসছে গলা ঠেলে। বুজে আসছে কণ্ঠস্বর।
কান্না গিলতে গিলতে ১৩ বছর বয়সী সেই কিশোরী অসহায়, বিস্মিত এবং বিহ্বল গলায় বলছে, ‘‘ওহ্ হাস রহে থে! হাস রহে থে! উনি বেহায়ার মতো, নির্লজ্জের মতো হাসছিলেন। যব ম্যায় উনকো বোল রহা থা, আঙ্কল, ইয়ে আপনে কেয়া কিয়া? ক্যায়সে কিয়া? আপ কো ক্যায়সে লগা কি মেরা বাপ…! আঙ্কল, আপনি কী করে ভাবলেন আমার বাবা এটা করবে! তখন উনি হাসতে শুরু করলেন। তো ওহ্ হাস রহে থে। ম্যায় কেয়া রেসপন্স দুঁ উসকো! কী জবাব দিতাম! কী বলতাম ওঁদের আমি! উনি তো হাসছিলেন!’’
কিশোরীর নাম নাইফা আলতাফ। উর্দুতে ‘নাইফা’। বাংলা অনুবাদে ‘উন্নত’। উন্নতশির।
নাইফার বাবার নাম মহম্মদ আলতাফ। পেশায় ব্যবসায়ী। শ্রীনগরের হায়দরপোরায় এক বাণিজ্যিক বহুতলে পুলিশের গুলিতে গত সোমবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর সঙ্গেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন আরেক শ্রীনগরবাসী মুদস্সর গুল। পেশায় দন্তচিকিৎসক। ওই বাণিজ্যিক বহুতলে তাঁর একটি চেম্বার ছিল। আলতাফ ছিলেন ওই বহুতলের মালিক। সেখানে তাঁরও একটি দফতর ছিল।
আলতাফ নাইফার বাবা। যে বাবাকে গুলি করে মারতে চাওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিল কিশোরী কন্যা। আর তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিলেন এক ফৌজি। হাসছিলেন! ‘‘উনি তো হাসছিলেন!’’ বলার সময় দুঃখ-রাগ-হতাশা ছাপিয়ে নাইফার গলায় উঠে আসছিল এক অপার বিস্ময়। অবোধ বিহ্বলতা।
হায়দরপোরায় পুলিশের সঙ্গে সেই ‘এনকাউন্টারে’ মারা যায় এক পাক জঙ্গি এবং তার এক সঙ্গী। তাদের নাম আমির মাগরে এবং হায়দর। সেইখানেই বুলেটবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নাইফার বাবা আলতাফ।
প্রথমে পুলিশ বলেছিল, আলতাফ এবং মুদস্সরকে জঙ্গিরাই গুলি করে মেরেছে। কিন্তু পরে তারা জানায়, ওই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে সেনাবাহিনী-জঙ্গির গুলির লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে। পরিভাষায় যাকে বলে ‘ক্রসফায়ার’। তবে আরও পরে তারা জানায়, নিহত আলতাফকে জঙ্গিদের ‘আশ্রয়দাতা’ হিসেবেই ধরা হবে। কারণ, তিনি তাঁর ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে পুলিশ-প্রশাসনকে আগে থেকে সতর্ক করেননি। ওই ভাড়াটিয়াদের মধ্যে একজন ছিল পাকিস্তানি উগ্রপন্থী।
আলতাফের আত্মীয়া সালিমা টুইটারে দাবি করেছেন, জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে আলতাফকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল ভারতীয় সেনা। যে ভারতীয় সেনা পরে জানিয়েছে, ওই বাণিজ্যিক বহুতলে ঘাঁটি গেড়ে পাক জঙ্গিরা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নাশকতা ঘটানোর ছক কষছিল।
পুলিশে খাতায় নিহত ‘জঙ্গি’-দের একজন— আমিরের বাবা আব্দুল লতিফ মাগরে বলেছেন, তাঁর পুত্র আদৌ জঙ্গি নয়। সে শ্রীনগরের একটি দোকানে কাজ করত। পুত্রহারা আব্দুল আরও বলেছেন, তাঁর পরিবারের কেউ জঙ্গি হতে পারে না! কারণ, আব্দুল জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে কাশ্মীরের রামবানে পাথর ছুড়ে তিনি স্বয়ং জঙ্গি নিকেশ করেছিলেন। সে জন্য ভারতীয় ফৌজের তরফে দরাজ শংসাপত্রও পেয়েছিলেন। এখন সেই আব্দুল বলছেন, ‘‘আমি নিজে পাথর ছুড়ে জঙ্গি মেরেছি। সেই ঘটনার পর ১১ বছর ধরে জঙ্গিদের ভয়ে বার বার বাসা বদল করতে হয়েছে আমাদের। এই তার পুরস্কার! আমার ছেলে জঙ্গি?’’
নিহত আলতাফ-মুদাস্সরের দেহ তাঁদের পরিবারের হাতে দেওয়া হয়নি। গন্ডগোলের আশঙ্কায় কয়েক’শ কিলোমিটার দূরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ‘দাফন’ করা হয়। যার প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছিলেন মুদাস্সরের স্ত্রী। তাঁর দাবি একটাই— তাঁর পুত্রকে একবার বাবার মুখটা দেখতে দিতে হবে। অভ্যস্ত ইংরেজিতে তিনি বলছিলেন, ‘‘আই হ্যাভ জাস্ট ওয়ান ডিম্যান্ড। আই ওয়ান্ট টু সি দ্য ফেস অব মাই ডেড হাজব্যান্ড। আই ওয়ান্ট আওয়ার সন টু সি হিজ ফাদার্স ফেস ফর ওয়ান লাস্ট টাইম।’’ লাভ হয়নি। বিবৃতি দিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লা। কাজ হয়নি।
যেমন কাজ হয়নি এক ত্রয়োদশীর বিস্মিত প্রশ্নে। যে বলছিল, ‘‘সকাল ১০টা নাগাদ আমার চাচু একটা ফোন পেয়ে কাঁদতে শুরু করে। আমি বাড়িতেই ছিলাম। অনেকে চিৎকার করছিল। কান্নাকাটি করছিল। আমি ওই চিৎকার-আর্তনাদ নিতে পারিনি। দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। একটা ঘরে ঢুকে আল্লাহর কাছে শুধু প্রাণপণে প্রার্থনা করছিলাম।’’
কিন্তু ঈশ্বর বা আল্লাহ আর কবে নাচারের প্রার্থনা শুনেছেন! তা হলে তো চারপাশটা অন্যরকম হত। কান্না চাপতে চাপতে কিশোরী আরও বলছিল, ‘‘আমার এক কাজিন বলছিল, ও ঘটনাটা দেখেছে নিজে। ও সাক্ষ্যও দিয়েছে। আব্বাকে তিনবার ধরেছিল ওরা। আগের দু’বার ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তৃতীয়বার গুলি করে মারে। ওরা বলেছিল, আব্বাকে নাকি সাক্ষী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওরা আব্বাকে গুলি করে মেরে দিল! অন্য সাক্ষীকেও গুলি করে মারল! ওঁর ছেলে আর আমার ভাই এক ক্লাসে পড়ে। আমরা কী বলব ওকে? ও ওর বাবাকে খুব ভালবাসত। আমিও আমার বাবাকে খুব, খুব ভালবাসতাম। কিন্তু…কিন্তু এখন আমি কী করব! মা-কে নিয়ে কী করব। মা তো কিচ্ছু খাওয়াদাওয়া করছে না। শুধু কাঁদছে!’’
তেরো বছরের নাইফাকে দেখতে দেখতে, তার কান্নাজড়ানো গলা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এই আমাদের দেশ! যেখানে এক কিশোরী উর্দিধারী বাহিনীকে অসহায় প্রশ্ন করে (মনে রাখুন, ‘আঙ্কল’ সম্বোধনে), ‘‘আপনারা কী করে ভাবলেন আমার বাবা এটা করেছে?’’ আর কাঁধে অ্যাসল্ট রাইফেল-ঝোলানো সেই ‘আঙ্কল’ দাঁত বার করে হাসে। শুধু হাসে। যেন কিছুই হয়নি। যেন কোথাও কোনও বিচলন, কোনও বৈকল্য ঘটেনি। গাছে গাছে ফুল ফুটছে। ফল ধরছে। এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশে উঠছে সাতরংয়ের রংধনুক। আর বেনিয়াসহকলা-র সেই মায়াবি আলো গায়ে মেখে জগৎ পারাবারের তীরে শিশুরা সব দিব্যি খেলে বেড়াচ্ছে।
সেই আনন্দমেলায় শুধু এক কিশোরী একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ঢাকা নীল দোপাট্টায়। অপাপবিদ্ধ মুখ। কান্না চেপে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় সেই মুখের পেশি অহরহ কুঁচকে যাচ্ছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে ঘন কালো দুই ভ্রূ। ঠোঁট কাঁপছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। দমকে দমকে কান্না আসছে গলা ঠেলে। বুজে আসছে কণ্ঠস্বর। সে বলছে, ‘‘ওহ্ হাস রহে থে! হাস রহে থে!... ম্যায় কেয়া রেসপন্স দুঁ উসকো! কী বলব!’’
সত্যিই তো। কী বলব! কী বলব নাইফা আলতাফকে? কী বলব বুশরা আহমেদকে? যে খুকির সঙ্গে সেই ১৯৯৩ সালের পর আর যোগাযোগই রাখিনি, তার কথা মনে পড়িয়ে দিল এক নাচার মুখ। নীল দোপাট্টার আড়াল থেকে বেরিয়ে-আসা সেই মুখের পাশাপাশি ভেসে এল উলোঝুলো চুলের এক বালিকা। শ্রীনগরের এক প্রায়ান্ধকার ঘরে ‘আঙ্কল’-এর অসুবিধে দূর করতে জন্য যে খুকি বয়ে নিয়ে আসত উজ্জ্বল আলো। তার পর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত ‘ইন্ডিয়া’ থেকে-যাওয়া আঙ্কলের পিঠে হেলান দিয়ে। আর ঠোঁটে মৃদু স্নেহের হাসি নিয়ে সেই আপাত-অপরিচিত আঙ্কল সন্তর্পণে তার মাথায় রাখত যত্নের হাত।
অতীতচারী হতে হতেই মনে পড়ল আরেক আঙ্কলের কথা। ভীরু, স্থির, জলে-ভেজা দু’টি চোখ যার কাছে জানতে চাইছিল, ‘‘কেন এমন করলেন?’’ আর সেই ‘আঙ্কল’ হাসছিলেন। জয়ের হাসি। অনুকম্পার হাসি। করুণার হাসি। বিদ্রূপের হাসি।
কী বলব উন্নতশির নাইফাকে? কী বলব সুসংবাদের বুশরাকে? কী-ই বা বলব কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে-থাকা এমন অসংখ্য কন্যাকে?
কিছু বলব না। শুধু ক্ষমা চাইব।
(ছবি: মুখতার খান)