Artificial Intelligence

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: এ বার আর শুধু শ্রমিকের সন্তান নয়, আমার-আপনার ছেলেমেয়েও চাপে

এত দিন যাঁরা নিজেদের সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ মনে করেছেন, তাঁরাই এখন পালাতে পারলে বাঁচেন।

Advertisement
অর্ধেন্দু সেন
অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
Artificial Intelligence: Not only labourer’s son, our kids are now in pressure too

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মানুষ যখনই দেখেছে তার পেশিশক্তিতে কুলোচ্ছে না, তখনই সে যন্ত্রের সাহায্য নিয়েছে। শিকারে কাজে লেগেছে লাঠিসোঁটা-বল্লম। সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে পালতোলা নৌকো। মালবহনে ব্যবহার হয়েছে চাকা। যার প্রাচীন এক উদাহরণ দেখা যায় মিশরে, পাঁচ হাজার বছরের পুরনো পিরামিড নির্মাণে। পানীয় বা সেচের জল তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন আকারের পুলি এবং পাম্প। যুদ্ধে সে-ই জিতেছে, যার অস্ত্রশস্ত্র তির-ধনুক-গোলা-বারুদ-বন্দুক-কামান ছিল শত্রুর তুলনায় উন্নত।

Advertisement

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যন্ত্র কি শুধু আমাদের পেশিশক্তির বর্ধন করতে পারে? না কি তাকে বৌদ্ধিক কাজেও লাগানো যায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে চার্লস ব্যাবেজ নামে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী একটা অঙ্ক কষার যন্ত্র বা ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। সেটা চলত যান্ত্রিক শক্তিতে। বৈদ্যুতিক শক্তি তখন সবেমাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রয়োগের পর্যায়ে আসেনি। ব্যাবেজের ক্যালকুলেটর জনপ্রিয় হয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তার স্পিড কম হওয়ায়। মেশিনের স্পিড বাড়ে বিংশ শতাব্দীতে ইলেক্ট্রনিক্সের প্রয়োগে।

অঙ্ক কষার জন্য যন্ত্রের প্রয়োজন নাটকীয় ভাবে দেখা দেয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ব্রিটেন তখন সব পণ্যের জন্যই আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। জার্মান ইউ-বোট নিখুঁত ভাবে এই পণ্যবাহী জাহাজের হদিস করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু জার্মান নৌবাহিনীর কথোপকথনে ব্রিটেন আড়ি পাততে পারে না। কারণ, তারা তাদের সাঙ্কেতিক ভাষায় দৈনিক পরিবর্তন করে। ব্রিটেন চায় যে কোনও মূল্যে সেই ‘কোড’ আবিষ্কার করতে। গণিতজ্ঞদের একটা বিশেষ দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই কাজের। দলের নেতৃত্বে অ্যালান টিউরিং। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁরা এই কাজ সম্পন্ন করেন। মনে করা হয়, তাঁদের সাফল্যেই বেঁচে যায় লক্ষ লক্ষ প্রাণ।

টিউরিংকেই মনে করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক। কোন মেশিনকে বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতি বলা হবে, তিনি তার একটা সংজ্ঞাও ঠিক করে দেন। আমাকে দুটো টেলিফোনের লাইন দিয়ে বলা হল, একটা লাইনে আছেন এক জন মানুষ। অন্য লাইনে আছে যন্ত্র। আমার কাজ হবে দুই লাইনেই কথাবার্তা চালিয়ে দু’জনকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বোঝা, কোনটা কে? আজকাল আমরা এ ধরনের চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলতে অভ্যস্ত। ব্যাঙ্কে ফোন করুন বা চেষ্টা করুন ফোনে টিকিট কাটতে, দেখবেন আপনাকে সাহায্য করছে কোনও এক চ্যাটবট। ৭০-৮০ বছর আগে যিনি চ্যাটবটের কথা ভেবেছিলেন, তাঁর দূরদর্শিতার তারিফ করতেই হয়।

টিউরিংয়ের ধারণা ছিল, বিংশ শতাব্দীর শেষে সব যন্ত্রই পারবে এই ‘টিউরিং টেস্ট’-এ পাশ করতে। তা কিন্তু হয়নি। দুটো-তিনটে সফ্‌টঅয়্যারই পেরেছে এই পরীক্ষায় পাশ করতে। তাদের সাফল্য নিয়েও বিতর্ক আছে। লেবনার নামে এক শিল্পপতি এক লক্ষ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন এই পরীক্ষায় পাশ করা সফ্‌টঅয়্যারের জন্য। তাতেও কাজের কাজ হয়নি। একে কী বলব? আমাদের ব্যর্থতা, না সাফল্য! টিউরিং টেস্টের ব্যবস্থা করা সহজ নয়। অথচ দুষ্টু সফ্‌টঅয়্যারের হাত থেকে নিজের ওয়েবসাইটকে বাঁচানো জরুরি। তাই চালু হয়েছে ‘ক্যাপচা’। চার-পাঁচটা অস্পষ্ট অক্ষর অথবা নম্বর এলোমেলো ভাবে দেওয়া থাকবে। আপনি সেটা পড়তে পারলে তবেই পাবেন প্রবেশাধিকার। সফ্‌টঅয়্যার যতই চালাক হোক, সে কোনও ছবিকে সামগ্রিক ভাবে দেখতে পারে না। প্রতিটি বিন্দুকে আলাদা আলাদা করে দেখে। আর আমরা প্রথমেই শিখি মায়ের মুখ চিনতে। এখানে আমরা অনেকটা এগিয়ে। মুখ চেনার সফ্‌টঅয়্যার সবেমাত্র বাজারে এসেছে। বিশ্বের সব জনদরদি সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনে নিচ্ছে সেই সফ্‌টঅয়্যার। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।

টিউরিং টেস্টে পাশ করতে না-পারলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার জাল ছড়িয়েছে সর্বত্র। বিশেষ করে আশির দশক থেকে তার অগ্রগতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। নব্বইয়ের দশকে আমরা অবাক হয়ে দেখি ‘ডিপ ব্লু’ নামক একটি প্রোগ্রাম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে দাবায় হারিয়ে দেয়। সম্প্রতি টেসলা কোম্পানির দৌলতে ড্রাইভারহীন গাড়ি বেশ কিছু মাইলফলক পেরিয়েছে। বেঞ্জ গাড়িও এখন সব দিক দেখে নিজেই ওভারটেক করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এআই (কৃত্রিম বুদ্ধামত্তা)-চালিত ক্ষেপণাস্ত্র বহু দিন ধরেই যুদ্ধের অপরিহার্য অঙ্গ। এখন কোথায় কখন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হবে সে সিদ্ধান্তও নিতে পারে এআই। কোন কোম্পানির শেয়ার কেনা উচিত, কোন শেয়ার এ বেলা বিক্রি করে দেওয়া উচিত— আমাদের এই জ্ঞান এত কাল দিয়ে এসেছেন দালাল স্ট্রিটের বাঘা বাঘা ‘এক্সপার্ট’। এই কাজও এখন এআইয়ের আওতায়।

সফ্‌টঅয়্যার-চালিত বড় বড় মেশিন এখন কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনে ওয়েল্ডিঙের কাজ করে। একই সঙ্গে এই রোবট মাইক্রো সার্জারির মতো সূক্ষ্ম কাজেও হাত পাকিয়েছে। চ্যাটবটের ব্যবহারে বড় সুবিধা যে, তার সঙ্গে আমরা নিজের ভাষায় কথা বলি। ‘এলাইজা’ বা ‘বার্ড’-এর মতো চ্যাটবট এখন ঘরে ঘরে। তবে একটা সমালোচনা সবার ক্ষেত্রেই খাটে। এরা কেউই ভার্সাটাইল নয়। যে গাড়ি চালায়, সে শুধু গাড়িই চালায়। আমরা যেমন রান্নাও করি চুলও বাঁধি, সে রকম নয়। সেটা হয়তো আসবে পরের স্তরে। এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স) পরিণত হবে এজিআই (আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স)-তে। তবে সে কত দূর, তা কেউ জানে না।

কম্পিউটারের ব্যাপক প্রয়োগ হলে বহু মানুষ কাজ হারাবে, এ কথা বলে বামপন্থীরা অপ্রিয় হয়েছিলেন। কৃত্রিম মেধার প্রয়োগ যে হারে বাড়ছে, তাতে নিশ্চিত বলা যায়, অনেকে কাজ হারাবেন। এ বার শুধু শ্রমিকের ছেলেমেয়ে নয়, আমার-আপনার ছেলেমেয়েও রয়েছে চাপে। ডাক্তারবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট যিনি রোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কেস হিস্ট্রি তৈরি করেন, উকিলবাবুর মোক্তার যিনি চুক্তির খসড়া তৈরি করেন, আকাউন্ট্যান্টবাবু যিনি আপনার ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন তৈরি করেন— এঁরা সবাই দেখছেন অল্পবিস্তর কাজ চলে যাচ্ছে কৃত্রিম মেধাপ্রাপ্ত চ্যাটবটের অফিসে। এই সমস্যার সমাধান না-করে কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুফল ভোগ করা যাবে না।

দাবা খেলায় কোনও চাল দেওয়ার আগে বুঝতে হয়, অন্য দিক থেকে কোন চাল আসতে পারে। তার পাল্টা কী হতে পারে তা-ও ঠিক করে রাখতে হয়। বুদ্ধির দরকার হয় এখানেই। চ্যাম্পিয়নরা পারেন ২০-২৫টা চালের কথা অগ্রিম ভেবে রাখতে। সে জায়গায় ‘ডিপ ব্লু’ ভেবেছিল ২৫ লক্ষ চালের কথা। এই খেলাকে কি বুদ্ধিদীপ্ত বলা চলে?

একই প্রশ্ন উঠতে পারে এআইয়ের চমকপ্রদ সাফল্য ‘চ্যাটজিপিটি’র বেলায়। এই প্রোগ্রাম ব্যবহার করে এখন ছেলেমেয়েরা হোমওয়ার্ক করছে। ‘চ্যাটজিপিটি’ রচনা লেখে একটা একটা করে শব্দ চয়ন করে। কোথা থেকে আসে শব্দ? উইকিপিডিয়ার পুরোটাই ঢোকানো আছে প্রোগ্রামে। তার সঙ্গে আছে কয়েক লক্ষ বই। প্রতিটি শব্দ তোলা হয় এই মহাসমুদ্র মন্থন করে। আমরা কেউ চাইব আমাদের ছেলেমেয়েরা এই পদ্ধতিতে কাজ করুক? নিশ্চয়ই নয়।

এই অদ্ভুত পদ্ধতিতে কাজ করলে যা হওয়ার ছিল তা-ই হয়েছে। যথেষ্ট সময় দিলে হয়তো শেক্সপিয়রের সব নাটকই পাওয়া যাবে। আপাতত মাঝে মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থহীন বা ভুল কথা লেখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, একটা রচনায় লেখা হয়েছে, ‘‘আমি হিটলারকে শ্রদ্ধা করি। তিনি যাদের ঘৃণা করতেন আমিও তাদের ঘৃণা করি।’’ সাহেবরা এত ভদ্র যে, এ কথা দেখে বিচলিত হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির প্রথম সারির এক হাজার ‘নেতা’ একটা খোলা চিঠি দিয়ে বলেছেন, সরকার এআই-কে নিয়ন্ত্রণে রাখুক। না হলে সর্বনাশ। এত দিন যাঁরা নিজেদের সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ মনে করেছেন, তাঁরাই এখন পালাতে পারলে বাঁচেন।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)

আরও পড়ুন
Advertisement