Bhoot Chaturdashi

ভূত চতুর্দশীর ডাকে তাঁরা যদি সত্যিই এসে পড়েন? ছমছমে আঁধারে যদি কথা বলতে শুরু করেন?

সমাজ ও সাহিত্যে ভূত, তার পরম্পরা ও পরিবর্তমানতা বিষয়ে গবেষণা ও সামান্য যেটুকু লেখালেখি করি, তাতে এ বারের ভূত চতুর্দশীতে মনে হয়েছে, ভূত আসুক!

Advertisement
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
An imaginary consequence if mysteriously dead persons reveal the cause of their death before bhoot chaturdashi

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হিমের রাতের সূচনালগ্নে আরও এক ভূত চতুর্দশী। লোকায়ত বিশ্বাস হল, বছরের নির্দিষ্ট এই দিনে আমাদের এখানে পরলোকগত মানুষেরা এসে হাজির হন। আলোর উৎসবের আগের দিন তাঁদের স্মরণ করে আবার বুঝিয়ে দেওয়া, এখানে তাঁদের আর জায়গা নেই। বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বেলে রেখে তাঁর ঘর, সিঁড়ি, উঠোন জুড়ে শূন্যতার মাঝেই তাঁকে স্মরণ করা। তার পর ভূত চতুর্দশীর দিনের কিছু উপচার পালন। পাশ্চাত্যে তার নাম ‘হ্যালোউইন’। সত্যি ছায়ার মতো তাঁরা যদি চেনা জায়গায় এসে দাঁড়ান? বেঁচে থাকা সময়ের কোনও কষ্টের কথা যদি বলতে শুরু করেন? বিস্মৃতির পরতে চলে যাওয়া মুখ আর কণ্ঠস্বরগুলি আচমকা সরব হয়ে উঠলে? না-জানা অনেক কথা চাপা পড়ে থাকা গুমোট থেকে আচমকা বাইরে বেরিয়ে এলে? সামাজিক স্থিতাবস্থায় সব কিছু ঠিক থাকবে তো! ঠিক যেমন ভাবে শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকে চার বার ফিরে এসেছিল নায়ক হ্যামলেটের মৃত পিতার আত্মা। নিজের সঙ্গে হওয়া অবিচারের জবানবন্দি আর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার প্রতিকার চেয়ে নিজের সন্তানকে জানান দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।

Advertisement

এ জীবনে ভূত নেই। লোকবিশ্বাস, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, মনের গহিন বিন্যাসে ভূত বা ভয় ভৌতিকতার আবহ নিয়ে থাকলেও সত্যি সত্যি ভূতের উপস্থিতি নেই। বাড়ির ছাদে জ্বেলে রাখা আকাশপ্রদীপ থেকে ভূত চতুর্দশীর ১৪ প্রদীপ— সময়মতো নিজেই ফুরিয়ে যায়। কেউ এসেছিল কি না তা জানার আগেই। সমাজ ও সাহিত্যে ভূত— তার পরম্পরা ও পরিবর্তমানতা বিষয়ে গবেষণা ও সামান্য যেটুকু লেখালেখি করি, তাতে এ বারের ভূত চতুর্দশীতে মনে হয়েছে, ভূত আসুক! মনে হয়েছে ব্রহ্মদৈত্য, একানড়ে, শাঁখচুন্নি, মামদো ভূতের রূপকে নয়। সরাসরি আসুন কেউ কেউ...।

সুটিয়া: বরুণ বিশ্বাস

এ বার সুটিয়াতে ভূত আসুক। ভূত আসুক ভিড়ে ঠাসা শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকালে। হেমন্তের হিম-ঘেরা সন্ধ্যায় যখন ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জুড়ে আস্তে আস্তে পোকাদের জমায়েত আরও ঘন হয়ে আসছে সুটিয়ার রাস্তায়, ১১ বছরের পুরনো এক বাইক আরোহী ফিরে আসুন। আগের ঘটনা, নতুন করে তৈরি হওয়া জল্পনা— খুন হয়ে যাওয়া বরুণ বিশ্বাস সকলের সামনে নিজেই এসে জানান দিন, বাইক স্টার্ট করার আগে গোবরডাঙা স্টেশনে বুকের ভিতর বিঁধে যাওয়া বুলেটের আগাম আঁচ কতটা তাঁর জানা ছিল। তিনি নিজেই এসে অমানিশার ঘেরাটোপে ঢাকা এই সামাজিক কাঠামো আর সত্যি-মিথ্যের দোলাচল ভেঙে দিয়ে বলে উঠুন, যারা শাস্তি পেয়েছে তারা ছাড়াও আর কে কে বাকি থেকে গিয়েছে! রাতের অন্ধকারে হিমের ভিতর দিয়ে মোটরবাইকের আলো গ্রামের রাস্তা জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় ভিড়ে ঠাসা শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকালে স্কুলফেরত মাস্টারমশাই বলে উঠুন, ‘‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন! সিনেমায় নয়, আর কিছু ক্ষণ পর ট্রেন থেকে নেমে গ্রামের পথে পথে চলুন। জানতে পারবেন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের গল্প। আলো-ছায়ার পথে এখন আর বুলেটও ছুঁতে পারবে না আমায়।’’

কামদুনি: নির্যাতিতা কিশোরী

ভূত আসুক কলকাতা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। যেখানে এখনও মেয়েরা একা যেতে ভয় পান বড় রাস্তা থেকে গ্রামের ভিতরে। তাই বাড়ির কাউকে ফোন করেন। পরিত্যক্ত কারখানার পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের অনেকেরই বুকের ভিতর আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়। ১০ বছরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। মিছিল, ধর্না, পারস্পরিক মতান্তর— সব কিছু পার করে জীবন এগিয়েছে নিজের স্রোতে। কামদুনিতে কেউ আকাশপ্রদীপও জ্বালান। কোনও কোনও এলাকা এখনও অন্ধকারে। এ বারের ভূত চতুর্দশীতে কামদুনির পরিত্যক্ত কারখানার পাঁচিল বেয়ে নেমে আসুন সেই মেয়ে। গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে দিন তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অত্যাচারের জবানবন্দি। রাস্তার ধারের দু’পাশে বাড়িতে বাড়িতে মোমবাতি। এগুলি ওঁর জন্য আগেও জ্বলেছে কয়েক বার। নিজের ব্যথার কথা বলছেন মেয়েটি। বলছেন, ‘‘ডায়েরির পাতায় ওই ঘটনার দু’দিন আগে লিখেছিলাম— টার্গেট এক, ভাল পরীক্ষা মানে সরকারি চাকরি। দুই, ভাইয়ের পড়াশোনা, বাবার চোখের চিকিৎসা।’’ আকাশে কয়েকটা ফানুস উড়ছে। দীপাবলিতে কলকাতা জুড়ে আলোর রোশনাই। মেয়েটি বলছেন, ‘‘আমি এসেছি। আমার সঙ্গে ঘটে-যাওয়া ঘটনা সব নিজের মুখে বলব।’’

যাদবপুর: অকালমৃত পড়ুয়া

ভূত আসুক হস্টেল করিডরে। অদূরে ডালপালা মেলে সাউথ সিটি। ছুটির মেজাজ থাকায় হস্টেলে অনেকেই নেই। লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছেলেটি। গত বছর এমন সময়ে সাইকেল নিয়ে টিউশন পড়তে যাওয়া ছিল। বড় শহরে এসেছিল সে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকার জায়গায় অনেক রকম সিনিয়র। একটু চেষ্টা করলে মন বসে যেত ঠিক। চেষ্টা তো ছিলই। চেষ্টা ছিল উপর থেকে নীচে পড়ে গিয়েও দম ধরে রাখার। মাথার ভিতরে তখন অদ্ভুত এক শব্দ আর আলোর আসা-যাওয়া। এক বার ক্লাসরুম, সাহিত্যের ইতিহাসের বইগুলোর নাম, পাশে বসা নতুন বন্ধু হতে চাওয়া ছেলেটির মুখ— তার ঠিক পরেই পাড়ার বন্ধুদের মুখ। মায়ের হাসি আর ছোটবেলার খেলার মাঠের ঘাস। তার পরে আবার সব অন্ধকার। ভূত চতুর্দশীতে পরনের গামছাটা আঁকড়ে ধরে ছেলেটি বলুক, ‘‘সত্যিটা শুনবেন? সত্যিটা হল, আমি আর খবরে নেই। নতুন সমস্যা, নতুন বিনোদন আপনাদের মনের দখল নিয়ে নিয়েছে। সে দিন কী হয়েছিল বলতে শুরু করলেও এখন শোনার লোক কম। একে আলোর উৎসব, তার উপরে বিশ্বকাপের মরসুম। অন্ধকার বারান্দা দিয়ে একা একাই হাঁটছি। তুবড়ি-রংমশাল পোড়ানো হয়ে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কি না!’’

এ বার ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় এমনই কিছু মুহূর্তেরা আসুক। অমাবস্যার মতো অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমাজে নিজেদের আগমনবার্তা জানান দিক। হিমেল বাতাস ফিসফিস করে কান থেকে কানে পাচার করতে থাকুক, ‘‘মৃতের মুখে সেই কাহিনি বসিয়ে দাও শুনি/ বসিয়ে দাও সে যে ভাবেই হোক/ সেই সুবাদে চিনতে পারি কারা আসল খুনি/ কারা আসল বিরোধী ভয়ানক।”

(লেখক গবেষক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
Advertisement