গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ যখন তাঁকে ফোনে ধরলাম, টুকরো-টুকরো কথা ওপাশ থেকে ভেসে ভেসে আসছিল, ‘‘ও দিদি! ও দিদি! আমাকে এটা প্লাস্টিকে ভরে দাও ভাল করে। টাকা দিয়েছি তো তোমায়’’ অথবা, ‘‘বাবা তো ভাল আছে।... বাবা তো বার হয়েছে। অফিসে গিয়েছে।... আসছি কাকা?’’
চারদিকের ওই গুঞ্জন এবং চ্যাঁ-ভ্যাঁর মধ্যে পাছে ঠিকঠাক শোনা না যায়, তাই বললাম, আপনি কি বাজারে? তা হলে একটু পরে ফোন করি?
যেমন খানিক আগে খুব সহজ, নির্লিপ্ত এবং খরখরে গলায় পরিচিতা দোকানি দিদির সঙ্গে বা হঠাৎ-দেখা এলাকাতুতো কাকার সঙ্গে কথা বলছিলেন, হুবহু তেমন ভাবে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘না-না! বলুন না কী বলতে চান।’’
বললাম, ব্রিগেড সমাবেশে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা বলতে গিয়ে মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে তাঁর ‘ভুলে গিয়েছি’টা রাজনীতিতে বিরল। বিরল বলেই ওটা ভুলব না। মনে থেকে যাবে।
ভান এবং ভণিতাহীন জবাব ভেসে এল, ‘‘ওই কবিতাটা আমার খুব ভাল লাগে। তাই বলছিলাম। কিন্তু ভুল তো ভুলই! সে আপনি স্বীকার করুন বা না-করুন। তবে ভুল স্বীকার করাটা খুব বড় ব্যাপারও নয়। আমরা কালেক্টিভ লিডারশিপে কাজ করি। কালেক্টিভ এফর্টে কাজ করি। কোথাও কোনও ভুলভ্রান্তি করলে নিজেরা বসে সেগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি। সেটাই আমাদের স্কুলিং। সকলেই তো মানুষ। অতিমানব তো কেউ নন। ভুল তো হতেই পারে। সেই ভুল স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়?’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এটাই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারিণীর ‘ইউএসপি’। মধ্যদিনের সূর্যের গনগনে ভাব। খরখরে গলা। নির্ভান বক্তব্য। নেতাসুলভ আম্বা-হীনতা। আটপৌরে, নন এলিট এবং অনভিজাত সোজাসাপ্টা ভাষা। মাটির সঙ্গে নাড়ির যোগ।
ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া শিল্পাঞ্চল কুলটির বাসিন্দা তিনি। নির্ঘাত সেই কারণেই তাঁর বাংলায় খানিক অবাঙালি টান। ভাষণে বাংলার সঙ্গে হিন্দির স্বচ্ছন্দ এবং অনবরত মিশেল (তবে এ নিয়ে তাঁকে কটাক্ষেরও শিকার হতে হয়েছে। কিছু সবজান্তা বলেছেন, উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান মিনাক্ষীর নাকি ওটা স্বাভাবিক উচ্চারণ হতে পারে না। তিনি নাকি অভিনয় করেন। কী কাণ্ড! কী মস্তিষ্ক)। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পরে কিছু দিন ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি করেছিলেন। তার পরে সর্বক্ষণের রাজনীতি (কেন বাম রাজনীতিতে এলেন, সে প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমার বাড়ি ওই কালচারে আছে। আমার বাড়ির সকলেই আছেন’)। ২০০৮ সালে অন্য অনেকের মতোই ২ টাকা দিয়ে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের স্থানীয় স্তরের সদস্য হয়েছিলেন (এখনও নিজেকে ‘সংগঠনের সদস্য’ হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন)। রাজ্য সভানেত্রী হন তারও দশ বছর পর। ২০১৮ সালে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে হন সংগঠনের প্রথম মহিলা রাজ্য সম্পাদক। আপাতত ২৫ সদস্যের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নেত্রী তিনি। তাঁর অধীনে ৪,০০০ ইউনিট। প্রায় ৩০ লক্ষ সদস্য। যাঁদের পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে কিছুটা স্মার্টফোন। বাকিটা বামপন্থী আদর্শ।
সিপিএমের যুব সংগঠনের সর্বময় নেত্রী হওয়ার আগেই অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ মিনাক্ষীকে চিনেছে। ওই ২০২১ সালেই। বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম নামক একটি বাঘের গুহায় তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল সিপিএম। সম্ভবত আগুনের নদী সাঁতরানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কারণে। মিনাক্ষী লড়তে নেমেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে। মিনাক্ষী জিতবেন কেউ ভাবেননি। তিনি নিজেও কি ভেবেছিলেন? নিশ্চয়ই না। ঠিকই ভেবেছিলেন। ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৬,২৬৭টি। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর। কিন্তু দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার বীজটা পুঁতে আসতে পেরেছিলেন। ভোটের প্রচারে নেমে সিপিএমের ‘ওয়াটার্লু’ নন্দীগ্রামের এমন এমন কোনাখামচিতে পৌঁছেছিলেন, যেখানে ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের দশ বছরে সিপিএম ঢুকতে পারেনি!
চাকুরিজীবী পরিবারের সন্তান। সাদামাঠা পোশাক পরেন। সোজা কথা সোজা ভাষায় বলেন। অন্যায় এবং আক্রমণের বিরুদ্ধে ‘রে-রে’ করে রুখে দাঁড়ান। এই ঝাঁঝালো অনুপান বাংলার রাজনীতি দেখেছিল সেই আশির দশকে। প্রায় তিন দশক ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে লড়তে যিনি মিনাক্ষীর দলকেই ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সিপিএম প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে প্রচারে কোনও শব্দ খরচ করেছিলেন বলে মনে পড়ছে না। তার পরেও কখনও মিনাক্ষীকে নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু তাঁর দলের একাধিক নেতা (যাঁরা স্মার্টফোনে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উপর নিয়মিত নজর রাখেন) একান্ত আলোচনায় এখনও বলেন, ‘‘মিনাক্ষী দারুণ বক্তা! আমার তো বেশ ভাল লাগে ওর কথা শুনতে।’’ অথবা, ‘‘মেয়েটা সব সময় রাস্তায় থাকে। আন্দোলনে থাকে।’’
ঠিকই। ভোটে লড়ার আগে ‘নবান্ন অভিযান’। ভোটে হারের পরে আমতার ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনায় জঙ্গি আন্দোলন। ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন মিনাক্ষী এবং তাঁর সতীর্থেরা। অন্যদের সঙ্গেই জেলে যেতে হয়েছিল মিনাক্ষীকে। শোনা যায়, হেফাজতে তাঁর উপর বিবিধ অত্যাচারও হয়েছিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রিজ়ন ভ্যানে তাঁকে উঠতে দেখেছিলেন বঙ্গবাসী। কিন্তু কুলটির কন্যাকে দমানো যায়নি। ঘটনাচক্রে, তাঁর সঙ্গে বিধানসভা ভোটের ময়দানে লড়তে নেমেছিলেন আরও দুই কন্যা দীপ্সিতা ধর এবং ঐশী ঘোষ। ভোটে হারের পর বাংলার দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে কার্যত উবে গিয়েছেন তাঁরা। যেমন শুধুমাত্র টিভি স্টুডিয়োর নান্দনিক মুখ রয়ে গিয়েছেন এক প্রাক্তন ছাত্রনেতা। কিন্তু ৩৯ বছরের মিনাক্ষী কচ্ছপের কামড়ের মতো ধরে রেখেছেন আন্দোলনমুখিতা। প্রমাণ করেছেন, তিনি লিফ্টে করে উপরে উঠতে চান না। তাঁর চাই সিঁড়িভাঙা পরিশ্রম।
পরিশ্রম বলে পরিশ্রম! আড়াইশো সঙ্গীর সঙ্গে ‘ইনসাফ যাত্রা’য় টানা ৫০ দিন ধরে ২,৯১০ কিলোমিটার হেঁটেছেন। আটপৌরে সালোয়ার-কামিজ, ধুসো শাল, কানে বেলকুঁড়ির মতো নেহাতই ঔপচারিক অলঙ্কার। স্কুলছাত্রীর মতো পিছনে টেনে বাঁধা মাথার চুলের মেয়েটির হাতে কেউ কষ্টে উপার্জিত ৫০ টাকার নোট গুঁজে দিয়েছেন মিষ্টি খাওয়ার জন্য। কেউ রাস্তায় স্কুটার থামিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেল্ফি তুলতে। জায়গায় জায়গায় তাঁর কাট-আউট দেখা গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত ধারাবিবরণী পাওয়া গিয়েছে। যাত্রা চলাকালীন প্রায় ৩০০ সভায় বক্তৃতা করেছেন। যার অন্তিমটি হল ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। যেখানে একটি যুব সংগঠনের ডাকে কাতারে কাতারে যুবক-যুবতী জড়ো হয়েছিলেন। যেখানে মঞ্চের উপর বসেছিলেন যুব সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা। আর মঞ্চের নীচে দলের প্রবীণ এবং বৃদ্ধেরা।
যেখানে জনতার গর্জনে বক্তৃতা শুরু করার আগে প্রায় এক মিনিট মাইক্রোফোনের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। থাকতে হল। কারণ, তাঁকে ঘিরে তখন রচিত হচ্ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের কোলাজ। আসন্নপ্রসবার মতো চেহারার ব্রিগেড থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল তাঁর নাম ধরে।
ওই ৬০ সেকেন্ডেই কি বাংলায় সিপিএমের চলনের গতিপথ বদলে গেল? না কি তার পরের ২২ মিনিটের বক্তৃতায়? যেখানে এক বার থমকালেন তিনি। ওই ‘ভুলে গিয়েছি’র স্টেশনে। চ্যুতি, যদি ভাবতেই হয়, ওটুকুই। বাকি ২১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে সম্ভবত সিপিএম আরও বুঝতে পারল, ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বনির্ভর রাজনীতির যুগে ‘মুখ’ কতটা প্রয়োজন। বুঝতে পারল, তরুণদের টানতে দরকার তরুণ মুখ। যে তরুণ মুখ হবে রুখুসুখু। যে স্মার্টফোনে ততটাও সড়গড় হবে না। মেঠো ভাষায় কথা বলবে। যার জীবন হবে কষ্টসহিষ্ণু, খাটিয়ে-পিটিয়ে। পারিবারিক পটভূমি হবে শ্রমজীবীর। মোদ্দা কথায়, যার জীবনে কৃচ্ছ্রসাধন থাকবে। ২২ লাখের গাড়ি চড়া বা জেএনইউ থেকে ‘ডক্টরেট’ করে গবেষণা করা যার মোক্ষ হবে না। যে শখের বামপন্থী হবে না। কাজের বামপন্থী হবে। বামপন্থার ‘মুখোশ’ নয়। বামপন্থার ‘মুখ’ প্রয়োজন ছিল সিপিএমের।
ক্ষমতায় থাকার সময় সিপিএম তরুণ প্রজন্মের কোনও ‘নেতা’ তৈরি করেনি। কারণ, তারা ভেবেছিল, ওটা লর্ড কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। যেমন চলছে তেমনই চলবে। তাই ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে নেতৃত্বের অনিরাময়যোগ্য সঙ্কটে ভুগেছে তারা। স্বাভাবিক। কারণ, তারা নতুনদের উঠতে দেয়নি। বৃদ্ধদের মৌরসিপাট্টা রেখে দিয়েছে বছরের পর বছর। যে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অন্দরে একদা নিজের স্নেহাস্পদ, পছন্দসই এবং সম্ভাবনাময় তরুণ নেতাকে রাজ্যসভায় পাঠাতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও দলের কতিপয় ঘুঘুর সঙ্গে লড়তে হয়েছিল (পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলেন এমন এক প্রবীণ, যিনি বামজমানা অবসানের পর পঞ্চায়েত ছাড়া সর্বত্র ভোটে দাঁড়িয়েছেন এবং হেরেছেন), সেই আলিমুদ্দিনের এখনকার ‘বস্’ মহম্মদ সেলিম আনন্দবাজার অনলাইনের অনুজ সহকর্মীর সরাসরি প্রশ্নের জবাবে মেনে নিয়েছেন, মিনাক্ষীই ‘মুখ’।
‘মুখ’ তো বটেই। নইলে কি সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের প্রথম পাতায় পর পর দু’দিন তাঁর ইয়াব্বড় ছবি ছাপা হয়? প্রথম: রবিবার ব্রিগেড সমাবেশের দিন। শনিবার ব্রিগেডের প্রস্তুতির তদারক করছেন। দ্বিতীয়: সোমবার সমাবেশের পরের দিন। রবিবার ব্রিগেডে বক্তৃতা করছেন। কোনও এক জন যুবনেত্রী এবং ‘জুনিয়র’কে নিয়ে উপর্যুপরি এ জিনিস সাম্প্রতিক কালে সিপিএমে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন?
মিনাক্ষী বদলে দিয়েছেন বাংলায় বাম রাজনীতির ভরকেন্দ্র। প্রজন্মান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন বঙ্গ সিপিএমের অন্দরে। সাধে কি আর তাঁকে ঘিরে ‘ক্যাপ্টেন-ক্যাপ্টেন’ রব উঠেছে?
আবার সেই খরখরে গলা ভেসে এল, ‘‘আমি ক্যাপ্টেন নই। ক্যাপ্টেন হল আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো। আমাদের আদর্শ। আমাদের নীতি। আমাদের নৈতিকতা।’’
কিন্তু আপনাকে তো সকলে ‘ক্যাপ্টেন’ই বলছেন?
‘‘ওটা আমাদের সংগঠনের বাইরের কথা। লোকে তো অনেক কিছুই বলতে পারে। কিন্তু আপনি নিজে ওটা মনে করে নিলে আপনিই বিপদে পড়তে পারেন!’’ শুনতে শুনতে আবার মনে হল, এটাই তাঁর ‘ইউএসপি’। খরখরে গলা। নির্ভান বক্তব্য। নেতাসুলভ ‘আমাকে দেখুন’ নেই। আটপৌরে, নন এলিট এবং অনভিজাত ভাষা।
মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ‘ভুলে গিয়েছি’র মতো আপনার এই বাক্যটাও মনে থাকবে।