ছবি: সংগৃহীত।
প্রভু রামচন্দ্রকে আমি অবতার-পুরুষ তথা প্রমাণ-পুরুষ বলে মানি। কিন্তু অবতার মানে এখানে ভগবান বিষ্ণুর মনুষ্য অবতার। আর ঈশ্বর যদি মনুষ্য ভাবে লীলায়িত হন, তা হলে যে ভাবে যে দেশে যে বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই ভাব দেশ এবং বংশের আচার-ব্যবহারেই তাঁর লীলা চালিত হতে থাকে। ভগবান কৃষ্ণ যেমন ক্ষত্রিয়কুমার হওয়া সত্ত্বেও ব্রজভূমিতে নন্দগোপের ঘরে পালিত হওয়ার কালে ক্ষীর-সর-ছানা-ননী দিয়েই পেট ভরিয়েছেন। কিন্তু দ্বারকার ক্ষত্রিয়ভূমিতে তাঁর মদ্য-মাংসের বারণ ছিল না, তার প্রমাণ মহাভারতে আছে। আর রামচন্দ্র তো একেবারেই ক্ষত্রিয় বংশের লোক। মাছ, মাংস কিংবা মদ্য তাঁর বাদ থাকবে কেন?
মুশকিলটা হয় রামভক্ত কিংবা কৃষ্ণভক্তদের নিয়ে। তাঁরা রাম কিংবা কৃষ্ণকে প্রীত করার জন্য উপাসকের বিধি মেনে ত্যাগ-বৈরাগ্যের মাধ্যমে নিরামিষ আহার করে শরীর শুদ্ধ করবেন— এটাই ভক্তভাব। কিন্তু আমার ভক্তভাব অনুসারে আমার ঠাকুরও একাদশী বা রামনবমী করবেন, তিনিও উপাসকের ভূমিকায় নিরামিষ খেতেন, এমনটা নয়।
প্রথম কথা, আমাদের দেশজ রামায়ণগুলির আদি থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত পড়লে মনে হবে, রাম যেন চিরকালই খুব নির্বিকার, ভাল-মন্দে সমযোগী। ফলমূল খাওয়া, ঝুঁটিবাঁধা এক তপস্বী যেন আমাদের রাম-কল্পনা জুড়ে বসে আছেন। বাল্মীকির বাস্তবে কিন্তু রামের জীবনটি এত নিরামিষ ছিল না। রাজধানীতে থাকাকালীন রামচন্দ্রের ভোগবিলাসের কথা রাজা দশরথ তো বার বার বিলাপ করে বলেছেন। রাজবেশ, হাতি-ঘোড়া— এ সব তো ছিলই, খাওয়ার ব্যাপারেও রাম ছিলেন রীতিমতো সুরসিক। ভাল ভাল রাঁধিয়েরা রামের কাছে রান্নার তারিফ শোনার জন্য ‘আমি রাঁধব, আমি রাঁধব’ বলে সুস্বাদু পান-ভোজন প্রস্তুত করতেন— অহংপূর্বাঃ পচস্তি স্ম প্রশস্তং পান-ভোজনম্।
রামের পানীয়ের মধ্যে যে শুধু দুধ আর ঘোলই ছিল— এমন ধারণা যেন পাঠক মনেও না আনেন। একে রাজপুত্র বলে কথা! তা ছাড়া অযোধ্যার পথেঘাটে ছিল সুরা-মদের ছড়াছড়ি। রামকে ফিরিয়ে আনতে না পেরে ভরত দুঃখ করে বলেছেন— রামবিহীন অযোধ্যায় থাকবই না! যে অযোধ্যায় রাম থাকতে কত রমরমা ছিল, অযোধ্যার রাস্তাঘাট যেখানে বারুণী মদ আর ফুল-মালা-চন্দনের গন্ধে ম-ম করত, সে গন্ধ তো পাচ্ছি না— বারুণী মদ গন্ধশ্চ…ন প্রবাতি সমন্ততঃ।
অযোধ্যার রাস্তাঘাটেরই যখন এই নমুনা, তখন সেখানে ক্ষত্রিয়কুমার মদ্য স্পর্শ করতেন না, এটা বিশ্বাসের কথা নয়। আরও কথা, গুহকের রাজ্য ছেড়ে প্রথমে গঙ্গা এবং পরে যমুনা পার হওয়ার সময় সীতাদেবী এই দুই পুণ্যা নদীর কাছে মানত করেছেন— রাম যদি ভালয় ভালয় অযোধ্যায় ফিরে আসেন, তা হলে তোমার প্রীতির জন্য ব্রাহ্মণদের প্রচুর খাওয়াব আর তোমাকে পুজো দেব মা, হাজার কলসি মদ আর পোলাও দিয়ে— সুরা-ঘট সহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ। …সুরা-ঘট শতেন চ। গঙ্গা-যমুনার ভোগ্যা এই সুরার প্রসাদ কি রাজমহিষীরাও পেতেন না! বিশেষত সুরা বিষয়ে রাজমহিষীদের অন্তরঙ্গ জ্ঞান ভালই ছিল। ‘মণ্ড’ বলে একটা জিনিস ছিল। সেটাই ছিল মদের সার ভাগ। মদিরার মণ্ডভাগটি পান করার পর যেটা জলের মতো পড়ে থাকত, সেটার কোনও কদর ছিল না মদ্যপায়ীদের কাছে। কৌশল্যা বিলাপ করে দশরথকে বলেছিলেন— ভরত এ রাজ্যে রাজা হলে সার শুষে নেওয়া সুরার মতো এ রাজ্য আমার ছেলে নেবেই না— হৃতসারাং সুরামিব। আবার বনগমনের সময় দশরথ যখন নানা ধনরত্ন রামের সঙ্গে দিতে চাইলেন, তখন কৈকেয়ী রাজাকে বললেন— ‘মণ্ড’ শুষে নেওয়া মদিরার মতো এ রাজ্য ভরত নেবেই না— পীতমণ্ডাং সুরামিব। মদিরার মণ্ড ভাগটির প্রস্তুত-প্রণালী আমার জানা নেই। তবে এর সঙ্গে যে রাজমহিষীদেরও ব্যক্তিগত নিবিড় পরিচয় ছিল, সে কথা বোধ করি আর বলে দিতে হবে না।
ঠিক এই অবস্থায় আমরা কি এখনও বিশ্বাস করব যে, রাম মদ্যপানের সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন? যদিও রাম বসে বসে গেলাসের পর গেলাস মদ্যপান করছেন, এমন কোনও পরিষ্কার বর্ণনা বাল্মীকিতে নেই। তবে ইঙ্গিত আছে যথেষ্টই। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে যখন সীতার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ হয়েছে, তার বহু বছর আগে রামচন্দ্র স্বয়ং সীতাকে বাম বাহুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে টলটলে মৈরেয় মার্কা মদ্য তুলে দিয়েছেন তাঁর হাতে— ঠিক যেমন দেবরাজ স্বর্গীয় সুরা তুলে দেন ইন্দ্রাণীর হাতে— সীতামাদায় হস্তেন মধু মৈরেয়কং শুচি। পায়য়ামাস কাকুৎস্থঃ শচীমেব পুরন্দরঃ।
‘মৈরেয়’ কিন্তু বেশ কড়া মদ। কিন্তু এর পরেও কি আমরা বলব, রামচন্দ্র মদ ছুঁতেন না? স্বাধীন ভাবে রামচন্দ্রের মদ খাওয়ার ঘটনা পরিষ্কার করে বাল্মীকি না জানালেই বা কি? তাঁর মদ্যপানের পরিবেশ তো বাল্মীকিই তৈরি করেছেন। যে দিন রামচন্দ্র সীতার হাতে মৈরেয় মদের পাত্রখানি এগিয়ে দিয়েছিলেন, সে দিন তিনি অযোধ্যার নবনির্মিত ক্রীড়াকানন অশোকবনে ফুলের আসনে বসেছিলেন। মাংসের চাট এবং বহু মিষ্ট ফলও তাঁর অলস হাতের নাগালের মধ্যেই ছিল— মাংসানি চ সুমৃষ্টানি ফলানি বিবিধানি চ। সুন্দর অপ্সরা-কিন্নরীরা তাঁর সামনে নাচ দেখাচ্ছিল এবং তারা মদ্যপান করেই নাচছিল— দক্ষিণা রূপবত্যশ্চ স্ত্রিয়ঃ পানবশং গতাঃ। রাম সেই সুন্দরী ললনাদের সন্তুষ্টও করলেন। অবশ্য কী ভাবে করলেন, তা বাল্মীকি লেখেননি।
কিন্তু এমনই এক নাচের আসরে, যেখানে নাচিয়ে-বাজিয়ে এমনকি, সীতা পর্যন্ত মদ্যপানে মত্ত, সেখানে রামচন্দ্র বসে বসে আপন অঙ্গুলি-লেহন করছিলেন বলে মনে হয় না। বিশেষত বাল্মীকি লিখেছেন— দেবকন্যাদের সঙ্গে দেবতারা যে ভাবে কামক্রীড়া করে, রামচন্দ্র বৈদেহীর সঙ্গে সেই রকম ভাবেই প্রতি দিন ক্রীড়া করছিলেন— রময়ামাস বৈদদেহীম্ অহন্যহনি দেবষৎ। দেবতাদের তো অমৃতে অরুচি নেই বলেই জানি এবং এই রকম দেবভোগ্য ব্যবহারে বিলাসে-বিহারে রাম-সীতার দিন কেটেছে বহু বছর, যেটাকে বাল্মীকি বাড়িয়ে বলেছেন— দশবর্ষ-সহস্রানি গতানি সুমহাত্মনোঃ।
মদের ব্যাপারে সীতা যে একেবারেই বিমুখ ছিলেন না, তা যেমন তাঁর গঙ্গা-যমুনার কাছে মানত করা থেকে বোঝা যায়, তেমনই বোঝা যায় তাঁর সাধারণ সংলাপ থেকে। সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় রাবণ তপস্বী বনবাসী রামকে হেয় করে সীতাকে বলেন, রাবণকেই যেন তিনি সপ্রেমে বরণ করে নেন। প্রত্যুত্তরে রাম-রাবণের তুলনা করে সীতা এমন কতকগুলি উপমার কথা বলেন, যার মধ্যে একটিতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ভাল কিসিমের মদ স্বয়ং সীতাদেবী কী রকম চিনতেন! সীতা বললেন— সিংহে আর শেয়ালে যে তফাত, খাঁড়ি আর সমুদ্রে যে তফাত, উত্তম সুরা আর সুবীর দেশের ধেনো মদে যে তফাত— সুরাগ্র্য-সৌবীরকয়ো যর্দম্ভরং— রামে আর তোতে সেই তফাত। পাঠক নিশ্চয়ই জানুন, সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী— সবাই মদ্যপান করতেন আর লঙ্কার অশোকবনে সীতাকে রামের খবর দিয়ে হনুমান বলেছে— তিনি আপনার বিরহে মদ-মাংস সব ছেড়ে দিয়েছেন— ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্ক্তে ন চৈবং মধু সেবতে। তার মানে, সীতাবিরহ না থাকলে মদ এবং মাংস দুই-ই যে রামের চলত তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মদ্যপান ছাড়া খাবারের মধ্যে যে জিনিসটি রামের অতি প্রিয় ছিল, সেটি হল মাংস। বিশেষ করে হরিণের মাংস। দশরথ আর কৈকেয়ীর কাছে বনবাসের আদেশ পেয়ে রাম যখন কৌশল্যাকে সে কথা জানালেন, তখন তিনি বলেছিলেন— আমাকে এখন চোদ্দ বছর ফলমূল খেয়ে ঋষি-মুনির মতো বনেই কাটাতে হবে। আমিষ আমার চলবে না— কন্দমূলফলৈজীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।
আবার অশোকবনে হনুমানের ‘রিপোর্টে’ দেখছি, তিনি সীতাবিরহে মদ-মাংস দুই-ই ছেড়েছেন। ছেড়েছেন যখন, তখন মদ-মাংস ধরার প্রশ্নও তো থেকে যায়। আসলে অতিরিক্ত মনঃকষ্টে বনবাসের শেষের দিকটায় রামচন্দ্র হয়তো মদ-মাংস সবই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বনবাসের প্রথম দিকে অরণ্য-প্রকৃতির মাধুর্য তাঁকে রাজভোগ ভুলিয়ে দিলেও মাংস খাওয়া ভোলাতে পারেনি। বনবাসের প্রথম দু-তিন দিনের রাত্রি রামচন্দ্র শুধু জল খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন— সেটা অভিমানবশত, না অন্য কারণে— বাল্মীকি তা স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু বনবাসের তৃতীয় দিনে সুমন্ত্র সারথি আর গুহককে বিদায় দিয়ে যেই না রামচন্দ্র গঙ্গাপারের অরণ্যসঙ্কুল ভূমিখণ্ডে পৌঁছেছেন, তখনই খিদের চোটে আগে তিন রকমের হরিণ আর একটি শুয়োর মেরে নিলেন— তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষতং মহারুরুম্। আদায় মেধ্যং ত্বরিতং বুভুক্ষিতৌ। খিদে বেশি লাগলে খাবারের জোগাড় কম থাকলে ভাল লাগে না— এই মনস্তত্ত্ব থেকেই হয়তো তিন জনের জন্য চারটে গোটা পশু মেরে নিয়েছিলেন দুই ভাই। কিন্তু পুরোটা তাঁরা খেতে পেরেছিলেন কি না, সে খবর আমরা বাল্মীকির কাছে পাইনি। বনবাসের চতুর্থ দিনে এবং রাতে রামচন্দ্র ছিলেন ভরদ্বাজ মুনির অতিথি। কাজেই খাওয়াদাওয়া ভালই হয়েছিল। যদিও তাঁর ‘মেনু’তে আমিষ ছিল না।
কিন্তু ভরদ্বাজের নির্দেশে দু’ভাই সীতাকে নিয়ে যে দিন চিত্রকূটে বাল্মীকির আশ্রমে পৌঁছলেন, সে দিনটা ছিল বনবাসের পঞ্চম দিন। জায়গাটাও রামের ভারী পছন্দ হল এবং তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মণকে ডেকে তিনি বললেন কাঠ-পাতা দিয়ে একটি পর্ণকুটির তৈরি করতে। পর্ণকুটির তৈরি হলে সেই বনবাসের মধ্যেও রামের ইচ্ছে হল সামান্য একটি গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের প্রথম অঙ্গ হিসাবে রাম ছোট ভাইকে বললেন— একটা হরিণ মেরে আন্ আগে— মৃগং হত্বানয় শীঘ্রম্, কেন না হরিণের মাংস দিয়েই আজ আমাদের বাস্তুপূজা সারতে হবে— ঐণেয়ং মাংসমাহৃত্য শালাং যক্ষ্যামহে বয়ম্।
বাস্তবে আমরা দেখেছি যে, দেবভক্ত মানুষেরা নিজেরা যে জিনিসটি খেতে পছন্দ করেন, সেই জিনিসটি ইষ্টদেবতার পছন্দ বলে নিবেদন করেন। এখানে বাস্তুযোগের উদ্দেশ্যে হরিণ মারা হল, না হরিণের মাংস খাওয়ার জন্যই বাস্তুপূজা করা হল— সে তর্ক নিষ্প্রয়োজন, তবে রামচন্দ্র আপন গৃহিণীকে মাংস রান্না করতে বললেন না। ছেলেরা বোধ হয় মাংস ভাল রাঁধে। তাই লক্ষ্মণকেই তিনি বললেন— ধ্রুব নক্ষত্র পার হয়ে যাচ্ছে, ভাই লক্ষ্মণ, তাড়াতাড়ি মাংস রান্নার ব্যবস্থা কর— ঐণেয়ং স্রপয়স্বেতৎ… ত্বর সৌম্য। লক্ষ্মণ খাবারযোগ্য একটি কালো হরিণ মেরে আনলেন এবং তার বিশুদ্ধ পাক-প্রণালীটি হল এই রকম— প্রথমেই তিনি আগুন জ্বালিয়ে হরিণটাকে ঝলসে নিলেন— অথ চিক্ষেপ সৌমিত্রিঃ সমিদ্ধে জাতবেদসি। তার পর যখন দেখলেন সমস্ত মাংসটি একেবারে গরম হয়ে গিয়েছে, রক্তধারাগুলি গিয়েছে সম্পূর্ণ শুকিয়ে, তখন বুঝলেন হরিণের মাংস একেবারে সুসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে— তত্তু পক্কং সমাজ্ঞায় নিষ্টপ্তং ছিন্নশোণিতম্। রামকে গিয়ে বললেন— আমি একেবারে গোটা হরিণটাই ‘রোস্ট’ করে এনেছি— অয়ং সর্বঃ সমস্তাঙ্গঃ শৃতো কৃষ্ণমৃগো ময়া। এর পর সবাইকে দিয়ে-থুয়ে মাংস খেয়ে গৃহপ্রবেশ করার পর বাল্মীকি মন্তব্য করেছেন— রাম যেন অযোধ্যার বিয়োগব্যথাই ভুলে গিয়েছেন— জহৌ চ দুঃখং পুরবিপ্রবাসাৎ।
অর্থাৎ, হরিণের মাংস রামের কাছে এমনই জিনিস! আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু চিত্রকূটে রাম অনেক দিন ছিলেন এবং হরিণের মাংসের ‘রোস্ট’ মাঝেমাঝেই তাঁর প্রবাস-দুঃখ হরণ করেছে। এমনকি, যে দিন ভরত সদলবলে রামকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলেন, সে দিনও লক্ষ্মণ হরিণের মাংস ঝলসাচ্ছিলেন। কেন না সেই আগুনের ধোঁয়া দেখেই রামের বাসস্থানটি ভরত চিনতে পারেন— ভরতো যত্র ধূমাগ্রং তত্র দৃষ্টিং সমাদধৎ। ভরত আসার আগেই রান্না হয়ে গিয়েছে এবং লক্ষ্মণ তা দাদার হাতে তুলেও দিয়েছেন। চিত্রকূট পাহাড়ের এক জায়গায় বসে পাহাড়-ছোঁয়া মন্দাকিনীর তরঙ্গশোভা দেখাতে দেখাতে রামচন্দ্র যে বিষয়ে সীতাকে প্রলোভিত করে তুলতে চাইছিলেন, সেটা কিন্তু সেই হরিণের মাংস— সীতাং মাংসেন ছন্দয়ন্। সীতা বোধ হয় আর খেতে চাইছিলেন না। রাম বললেন— একটু খেয়েই দেখো না। খুব স্বাদ, ঘেন্না কিসের? খুব পরিষ্কার, খুব স্বাদের মাংস— ইদং মেধ্যম্, ইদং স্বাদু— আগুনে ঝলসে কী রকম তুকতুক করছে, দেখো না— নিষ্টপ্তমিদম্ অগ্নিনা। হরিণ-মাংসের স্বাদু গন্ধে সীয়াবর রামচন্দ্র অরণ্যের মধ্যে কালক্ষেপ করতে থাকলেন বটে, কিন্তু কৌশল্যার কাছে রামের যে নিরামিষ খাওয়ার প্রতিজ্ঞা ছিল, সে প্রতিজ্ঞার কথা বনবাসের আতুর অবস্থায় অতি সঙ্গত কারণেই বাল্মীকি মনে রাখেননি।
আমাদের প্রাদেশিক রামায়ণগুলি কিন্তু একান্ত ভ্রমবশত অথবা প্রভু রামের প্রতি অতি সম্ভ্রমবশত রামকে মদ্য-মাসের ধারে কাছে যেতে দেয়নি। কৃত্তিবাস, তুলসীদাস— এঁরা সকলে ব্রাহ্মণ্য এবং বৈষ্ণবী হাওয়ায় মানুষ; এঁরা কোনও অবস্থাতেই ক্ষত্রিয়কুমারের স্বাভাবিক খাদ্য রাম-লক্ষ্মণকে খেতে দেননি। তুলসীদাস তো চিত্রকূট পাহাড়ের আনাচেকানাচে লক্ষ্মণ আর সীতাকে দিয়ে প্রচুর তুলসীগাছ লাগিয়ে দিয়েছেন— তুলসী তরুবর বিবিধ সুহায়ে। কঁহু কঁহু সিয় কঁহু লষণ লগায়ে।। এই বৃন্দাবিপিনে রাম-সীতা হরিণের মাংস খাবেন কী? তাঁরা বটের ছায়ায় বেদি বাঁধিয়ে শুধু বেদ-পুরাণের কাহিনি শোনেন!
(লেখক পুরাণ বিশেষজ্ঞ। মতামত নিজস্ব।)