মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের সবচেয়ে সহজ ভোটটা সবচেয়ে কঠিন করে লড়লেন ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
ভোট তখনও দিন কুড়ি দূরে। প্রাক্-আগমনী সকালে নাতিদীর্ঘ টেক্সট মেসেজ ঢুকল তাঁর আইফোনে। বার্তার নির্যাস— শারদ শুভেচ্ছার পাশাপাশি ভবানীপুরে রেকর্ড ব্যবধানে জয়ের আশা। মিনিটদুয়েক বার্তাটি নিরীক্ষণ করে বর্ষীয়ান আঙুল ইংরেজি হরফে বাংলা ভাষায় সংক্ষিপ্ত অথচ অমোঘ লাইনটি লিখল, ‘বাই ইলেকশনে কম হয়’।
অর্থাৎ, উপনির্বাচনে জয় (বা পরাজয়ের) ব্যবধান কম হয়।
লোকাচার ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে এক লাইনে নো-ননসেন্স জবাব, ‘বাই ইলেকশনে কম হয়’। এতটাই একমুখী তিনি। এতটাই যে, ভবানীপুরের জয়ের ব্যবধান ছাড়া আর কিছু ভাবছেন না। পুজোর শুভেচ্ছা-টুভেচ্ছার মতো মামুলি পাল্টা ঔপচারিকতা চুলোয় যাক! ওসব পরে দেখে নেওয়া যাবে। আপাতত একটাই পাখির চোখ— ভবানীপুরের মার্জিন।
এটা ঠিকই যে, উপনির্বাচনে জিত বা হারের ব্যবধান সাধারণ ভোটের তুলনায় কম হয়ে থাকে। কারণ, ইতিহাস বলে, উপনির্বাচনে সাধারণত ভোট কমই পড়ে। শহরের ভোট হলে আরও কম। কারণ, উপনির্বাচনে সরকার গড়া হয় না। অথবা সরকার পড়েও যায় না। ফলে উপনির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ঐতিহাসিক অনীহা রয়েছে ভোটারদের। ফলে ওজনদার প্রার্থীদের চিন্তা থাকে জয়ের ব্যবধান নিয়ে। তাই ওই এক লাইনের জবাব গেল, ‘বাই ইলেকশনে কম হয়’।
ওই এক লাইনের মধ্যে কি খানিক তিরতিরে উদ্বেগও ছিল? হবে হয়ত। কিন্তু সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চোয়াল-চাপা জেদ। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের তুঙ্গতম সাফল্যের মুহূর্তে ছোট (নাকি, বড়ই বলা উচিত হবে) কাঁটা হয়ে ফুটেছিল পাঁচ মাস আগের নন্দীগ্রামের পরাজয়। রথারূঢ় সারথি হিসেবে রাজ্য জুড়ে অশ্বমেধের যে ঘোড়া তিনি ছুটিয়েছিলেন, তার মুকুট থেকে একটি পালক আলগোছে খসে পড়েছিল গত ২ মে। ফলে ভবানীপুর তাঁর কাছে একটি নিছক উপনির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। মামুলি ভোটের লড়াই নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার লড়াই। তিনি জানতেন, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জিতেছিলেন ২৮ হাজারের বেশি ভোটে। তাঁকে সেই সংখ্যা পেরিয়ে যেতে হবে দূর। বহুদূর!
সেই জন্যই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের সবচেয়ে সহজ ভোটটা সবচেয়ে কঠিন করে লড়লেন? সবচেয়ে বেশি দাঁতে দাঁত চেপে? পরিভাষায়, ‘ডগ বাইটিং টেনাসিটি’ নিয়ে?
কী ছিল না সেই দৃঢ়সংবদ্ধ চোয়ালে! আলিপুর হাওয়া অফিসে নিজে ফোন করেছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবহাওয়া অধিকর্তার কাছে সরাসরি খোঁজ নিয়েছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর ভোটের দিন শহরের (আসলে আরও মাইক্রো লেভেল গিয়ে দক্ষিণ কলকাতার) আবহাওয়া কেমন থাকবে। বৃষ্টি হবে কি? যদি হয়, বৃষ্টির পরিমাণ কত হতে পারে? যে পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তাতে জল জমার সম্ভাবনা আছে কি না। কলকাতার পুর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমকে নির্দেশ দিয়েছেন, কোনও ভাবে যেন জমা জলে আটকে না পড়েন কোনও এলাকার ভোটার। বিশদে খোঁজ নিয়েছেন, রাজ্যে বিভিন্ন উপনির্বাচনে গড়ে কত শতাংশ ভোট পড়ে। শুনেছেন, মোটামুটি ভাবে ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশ। তার পর আতশকাচ ফেলেছেন ছ’মাস আগে ভোটপ্রবাহের উপর। শোভনদেবের সময়ে ভবানীপুরে কত ভোট পড়েছিল, সেই অঙ্ক জোগাড় করেছেন। তার পর ঠিক করেছেন, অন্তত ৬২ শতাংশ ভোট দেওয়াতেই হবে!
অনেকে যখন কুর্তা-পাজামায় আরও কত কড়া করে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করাবেন, সেটা ঠিক করছেন বা শাড়ির প্লিটগুলো ঠিকঠাক পড়ল কি না, তা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন দরজায়-দরজায় ঘুরেছেন। ফেসবুকে আপাতত তাঁর ফলোয়ার ৪ কোটি ৪৩ লক্ষ ৩ হাজার ৩১৪ জন। টুইটারে ৬২ লক্ষ। ইনস্টাগ্রামে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। কিন্তু তিনি ও সব সোশ্যাল মিডিয়া-টিডিয়ার তোয়াক্কা করেননি। নির্ভরও করেননি। তিনি বিশ্বাস করেছেন তাঁর নিজস্ব নেটওয়ার্কে। তাঁর ট্রেডমার্ক সনাতনী এবং শাশ্বত প্রক্রিয়ায়— প্রার্থীকে ভোটারের ঘরের হাতায় পৌঁছে যেতে হবে। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও! তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেও!
তৃণমূলের সর্বময় এবং অবিসংবাদিত নেত্রী ভবানীপুরের ভোটটা কি দলের উপর ছেড়ে দিতে পারতেন না? পারতেন তো! হাজার হোক, তিনি পরপর তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী। প্রণিধানযোগ্য যে, প্রতিবারেই আগের বারের চেয়ে ফল ভাল করে। আগের বারের চেয়ে বেশি আসন নিয়ে। ফলিত স্তরে তৃতীয়বার যা দেখা গেল পাঁচ মাস আগে। যখন বিভিন্ন পর্যায়ের বাড়াভাতে ছাই দিয়ে ২০২১ সালের সবচেয়ে কঠিন ভোটে সবচেয়ে ভাল ফল করলেন তিনি। সেই আবহে ভবানীপুরে তাঁর জয় নিয়ে কোনও স্তরে কোনও ধরনের সংশয় ছিল না। থাকার কথাও ছিল না। তিনিও গোটা তিনেক নিয়মরক্ষার বড় জনসভা করে বাকিটা দিব্যি নবান্নে বসে সরকার চালাতে পারতেন। আরও কিছু ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’ বা ‘সরস্বতীর ঝাঁপি’ ধরনের প্রকল্প শুরু করাতে পারতেন। করেননি। সটান রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন ভোট চাইতে। আর সেই সফরে কোথায় যাননি! মন্দিরে। মসজিদে। গুরুদ্বারে। পথসভায়। দুয়ারে-দুয়ারে।
বাণিজ্যের পরিভাষায় একে বলে ‘রেনড্রপ কালেকশন’। যা সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের মডেল। অর্থাৎ, দু’হাত যতদূর সম্ভব প্রসারিত করে সেই হাতের আঁজলায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জল ধরে রাখা। যার উৎস অসীম। নিঃসীম। আকাশের মতো। বলা হয়, ‘রেনড্রপ মডেল’-এর ব্যবসা কোনওদিন ডোবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য তাঁর আঁচল যতদূর সম্ভব বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন ভবানীপুরের অলি-গলি-ইমারতে।
হিতৈষীদের বলেছেন, তাঁদের ঘনিষ্ঠ বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ ভবানীপুরের ভোটার থাকলে যেন তাঁদের বলেন বাড়ি বসে না থেকে ভোটটা দিয়ে আসতে। ভবানীপুরে যে ২০ শতাংশের মতো অবাঙালি ভোটার রয়েছেন, তাঁদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। শুধু লক্ষ্ণীনারায়ণ মন্দিরেই গিয়েছেন একাধিক বার। অবাঙালি হিন্দু ভোট তাঁর চাই। যেমন একাধিক বার গিয়েছেন গুরুদ্বারেও। শিখ ভোটটাও দরকার। ওজনদার মন্ত্রী ফিরহাদ এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নামিয়ে দিয়েছেন নিত্য প্রচারে। বর্ষীয়ান সুব্রতকে দিয়েছেন ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব। ডাকাবুকো ফিরহাদের দায়িত্বে সর্বাধিক তিনটি ওয়ার্ড— তাঁর নিজের ওয়ার্ড ৮২ নম্বরের পাশাপাশি ৭৪ এবং ৭৭ নম্বর (যেখানে আগে খানিক টনটনে ব্যথা ছিল)। ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাসবিহারীর বিধায়ক দেবাশিস কুমারকে। ৭১ এবং ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন তৃণমূল মহাসচিব এবং মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ওয়ার্ড ৭৩ নম্বরে দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মদন মিত্রের মতো ‘কালারফুল বয়’-ও বাদ যাননি। তিনি ময়দানে নেমেছিলেন তাঁর ঝিং-চ্যাক ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’ নিয়ে। সে রংদার দেওয়াল লিখনই হোক বা ডান্ডিয়া নাচের সঙ্গে ‘ধিনা ধিন ধা, ও মদন-দা’।
দক্ষিণ কলকাতার যাবতীয় দলীয় বিধায়ক, কাউন্সিলার উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন ভবানীপুরের জন্য। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হা-ক্লান্ত দিনের শেষে মৃদু অনুযোগও করেছেন, ‘‘দিদি তো জিতবে! এত খাটাচ্ছে কেন! নিজেই বা এত দৌড়ে বেড়াচ্ছে কেন!’’ তাঁদের বলা যেত, সেইজন্যই আপনি অমুক এবং আপনি তমুক বা আপনি তুশুক। আর সেইজন্যই উনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপার পারফর্মার। অমিতাভ বচ্চনের মতো। যিনি মনে করেন, ৭৮ বছরে পৌঁছেও প্রতিদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময় নিজেকে নিজে বলতে হবে, এটাই আমার শেষ শট। ফলে সবটা উজাড় করে দিতে হবে। নিংড়ে দিতে হবে। বড় পারফর্মাররা যেমন মনে করে থাকেন— এটাই অন্তিম কাজ। এটাই অন্তিম সুযোগ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। যেন এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে মহাকাব্যিক লড়াই!
এবং এটা তিনি করলেন রাজনীতিতে তুমুল ধীশক্তি আর বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর। করলেন, কেন না তাঁকে নিশ্ছিদ্র লৌহবাসর তৈরি করতে হত। যাতে কোথাও কোনও ফাঁক না থাকে। যে ফোকর গলে ঢুকে পড়ে পারে আত্মসন্তুষ্টির কালনাগিনী।
এবং করলেন, মনে রাখুন, ৪০-৪৫ বছর টানা রাজনীতি করার পর। যে রাজনীতিতে মাত্র দু’বার ভোটে হার হয়েছে তাঁর। ১৯৮৪ সাল থেকে ভোট লড়ছেন। আটবার জিতেছেন লোকসভায়। মাত্র একবার হার মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে। বিধানসভায় আরও চারবার লড়াই। হার একমাত্র গত ভোটে। দাঁড়িপাল্লার তুল্যমূল্য বিচারে ঈর্ষণীয় তাঁর ভোটজয়ের রেকর্ড। ভবানীপুরের এই উপনির্বাচন ছিল তাঁর জীবনের দ্বাদশতম ভোট। কিন্তু সেই ভোটটাও তিনি লড়লেন মাটি কামড়ে।
এবং কোনও ভানভণিতা না করে এই লেখায় এটাও বলা থাকুক যে, ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, সারা দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ভোট এবং ভোটারের নাড়ির গতি আর ছন্দ বোঝার লোক আর নেই। একটিও নেই!
গত রবিবার কালীঘাটের টালির চালের বাড়ির চত্বরে যখন ঢেউয়ের মতো এসে পড়ছিল অতলান্ত উচ্ছ্বাস, ততক্ষণে লেখা হয়ে গিয়েছে, অতীতের সমস্ত পরিসংখ্যান ধুয়েমুছে ভবানীপুরে রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আকাঙ্ক্ষা মতো ৬২ শতাংশ ভোট পড়েনি ঠিকই। পড়েছিল ৫৭ শতাংশের কিছু বেশি। তাতেই শোভনদেবের মার্জিন ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে পিছনে পড়ে রয়েছে। অনতি-অতীতের সমস্ত ইতিহাস মুছে ভবানীপুরের আটটা ওয়ার্ডের আটটাতেই জিতেছেন তিনি।
রবিবেলার ঝকমকে রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছিল বর্ষীয়ান রোখা চোয়াল। বর্ষীয়ান তিনটি আঙুল দিচ্ছিল জয়ের নির্ভুল সঙ্কেতের সঙ্গেই তিনে তিনের বার্তা। বর্ষীয়ান যে আঙুল মোবাইলের স্ক্রিনে লিখেছিল, ‘বাই ইলেকশনে কম হয়’। বর্ষীয়ান যে আঙুলে লেখা হল সবচেয়ে সহজ ভোটটা সবচেয়ে কঠিন করে লড়ার সনাতনী, শাশ্বত এবং একান্ত ম্যানুয়্যাল।