শেষ কথা কার, লড়াই এটাই
Suvendu Adhikari

রাজ্যের অধীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেন্দ্র নাক গলাবে কেন

কংগ্রেস ২০১৪-র নির্বাচনের আগে সমবায় ক্ষেত্রকে নিজের মুঠোয় পোরার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:০৪
নিয়ন্ত্রক: নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সমবায় সম্মেলনে অমিত শাহ। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

নিয়ন্ত্রক: নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সমবায় সম্মেলনে অমিত শাহ। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১। পিটিআই।

নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের মাস তিনেক পরের ঘটনা। শুভেন্দু অধিকারী ঝাড়গ্রামে একটি সমবায় সমিতির সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠানে গিয়ে নোট বাতিলের সমালোচনা করে বলেছিলেন, এতে সমবায় সংস্থাগুলির লোকসান হচ্ছে। নানা অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। শুভেন্দুবাবু সে দিন প্রশ্ন তুলেছিলেন, মোদী সরকার কেন সমবায় ব্যাঙ্ক ও গ্রামের কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলির জন্য আলাদা আলাদা নীতি আনছে?

বলা বাহুল্য, ১৯৯৯ থেকে কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান পদে থাকা শুভেন্দু অধিকারী তখনও ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দলে যোগ দেননি। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ‘দোষে’ তাঁকে অগস্টে কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরানো হয়েছিল। দিন পনেরো আগে বিদ্যাসাগর সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের গদিও গিয়েছে।

Advertisement

শাসক দল থেকে বিরোধী দলে যাওয়ায় শুভেন্দুবাবুকে সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের গদি থেকে সরানো হচ্ছে কেন? এর সঙ্গে রাজনীতির যোগ কোথায়? কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্ক নিজেকে ‘পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শহরাঞ্চলীয় সমবায় ব্যাঙ্ক’ বলে দাবি করে। পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে শুভেন্দুর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার উৎস হল জেলায় এই রকম সমবায় ব্যাঙ্কে তাঁর আধিপত্য। এ বার তাঁর ডানা ছাঁটতেই শাসক দল সমবায় ব্যাঙ্কের গদি থেকে সরানোর কাজ শুরু করেছে।

শুভেন্দু অধিকারী একা নন। দেশ জুড়ে এ রকম বহু রাজনৈতিক নেতাই এখন যে ক্ষমতার অধিকারী, তার মূলে রয়েছে সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে গ্রামের কৃষি সমবায় সংস্থায় তাঁদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। বিশেষ করে গ্রামে ও মফস্সলে। কারণ কৃষক, ছোট ব্যবসায়ীরা সমবায় ব্যাঙ্ক, সমবায় সংস্থার উপরে নির্ভরশীল। তা সে ঋণ পেতেই হোক বা চাষের সার, কীটনাশক জোগাড় করতে। বা ফসল, দুধ বেচার তাগিদে। এই সব সমবায়ের চাবিকাঠি রয়েছে কোনও না কোনও নেতার হাতে। তাঁর সমর্থক (পড়ুন ভোটার) হলে ঋণ বা সুযোগ-সুবিধা মেলে। নচেৎ নয়। সমবায় ব্যাঙ্ক থেকেই তৈরি হয় নেতাদের ভোটব্যাঙ্ক। মহারাষ্ট্রে সমবায় চিনিকলগুলির লাগাম শরদ পওয়ারের হাতে, কেরলের সমবায়ে সিপিএম নেতারাই শেষ কথা। গুজরাতের সিংহভাগ সমবায় চলে বিজেপি নেতাদের ইশারায়।

সাত বছর ক্ষমতায় থাকার পরে নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ কেন্দ্রে নতুন সমবায় মন্ত্রক তৈরির পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি কি গোটা দেশেই সমবায় সংস্থাগুলির রাশ নিজের হাতে নিতে চাইছে? না কি সমবায় সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীকরণ করে সেখানে স্থানীয় নেতাদের ছড়ি ঘোরানোয় ইতি টানতে চাইছে? এত দিন কৃষি মন্ত্রকের অধীনে থাকা সমবায় বিভাগের জন্য আলাদা মন্ত্রক তৈরির ঘোষিত লক্ষ্য হল সমবায় আন্দোলনে গতি আনা। স্রেফ তার জন্য নিশ্চয়ই খোদ অমিত শাহকে এই মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়ার দরকার পড়ত না!

গুজরাতের প্রাচীন প্রবাদ, রাজ্যের সমবায়গুলির রাশ কংগ্রেসের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে অমিত শাহই ছিলেন নরেন্দ্র মোদীর সেনাপতি। ২০০১-এ নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিজেপির সমবায় সংস্থা দখল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিজেপি নেতারা সমবায় সংস্থার পরিচালন বোর্ডের ভোটে লড়তে শুরু করেন। সমবায় ক্ষেত্রে সেরা সাফল্য আমুল-এর জন্মভূমি গুজরাতের সমবায় ক্ষেত্রে গত বিশ বছরে বিজেপি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। কংগ্রেস আজও হৃত জমি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। গাঁধীনগরের গদিও তাই অধরাই থেকেছে। বিজেপি কি এ বার সমবায় ক্ষেত্রেও গোটা দেশে ‘গুজরাত মডেল’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে?

কেন ঠিক এখনই সমবায় মন্ত্রক গঠনের দরকার পড়ল, তা-ও ভাবা জরুরি। প্রথমে নোট বাতিল, তার পরে আচমকা লকডাউন, শেষে তিন কৃষি আইনের জেরে গ্রামীণ ভারতের একটা বড় অংশে যে ক্ষোভ রয়েছে, তা বিজেপি নেতারাও জানেন। নোট বাতিল, লকডাউনের ধাক্কায় দু’বার পরিযায়ী শ্রমিকদের রুটিরুজি হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। গত দশ মাস ধরে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলনকে মোদী সরকার গুরুত্ব দিতে না চাইলেও, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানার বিজেপি নেতারা স্বস্তিতে নেই। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে গ্রামীণ ভারতের লাগাম হাতে তুলে নেওয়াটা বিজেপির কাছে জরুরি। তার সহজ পন্থা হিসাবে সমবায়কে বেছে নেওয়া হয়েছে। গ্রামে যে পরিমাণ ঋণ বিলি হয়, গত দু’দশকে তাতে সমবায় সংস্থাগুলির ভাগ কমেছে। সমবায় সংস্থার সংখ্যা বাড়িয়ে, তাদের মাধ্যমে আরও ঋণ বিলি করে কৃষকদের মন জয় করাটা খুবই সহজ।

মুশকিল হল, সংবিধান অনুযায়ী সমবায় রাজ্যের বিষয়। কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের মতো যে সব সংস্থা শুধুমাত্র একটি রাজ্যের সীমানার মধ্যেই কাজ করে, সেখানে কেন্দ্রের নাক গলানোর এক্তিয়ার নেই। সেগুলি রাজ্য সরকারের সমবায় রেজিস্ট্রারের অধীন। একমাত্র যে সব সমবায় একাধিক রাজ্যে কাজ করে, তাদের জন্য কেন্দ্রের বহুরাজ্যিক সমবায় আইন রয়েছে। বাজপেয়ী সরকারের আমলেই এই আইন তৈরি হয়েছিল। গত শনিবার অমিত শাহ জাতীয় সমবায় সম্মেলনে গিয়ে ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই বহুরাজ্যিক সমবায় আইনে সংশোধন করতে চলেছে। যাতে তারা ফুলেফেঁপে উঠতে পারে, আরও ডানা মেলতে পারে। কিন্তু একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা সমবায়ের সংস্থা মাত্র কয়েকশো। নিছক তার জন্য যে আলাদা মন্ত্রক তৈরি হয়নি, তা বলা বাহুল্য।

গ্রাম ও মফস্সলের অর্থনীতিতে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ঠিক কতখানি প্রভাব রয়েছে? নাবার্ডের ২০১৯-২০’র রিপোর্ট বলছে, রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে মোট অর্থ জমার পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। জেলা সমবায় ব্যাঙ্কগুলি ৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিলি করেছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবে, শহরের সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ঋণ বিলির পরিমাণও ৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সমবায় ব্যাঙ্ক রোজ খবরে আসে না। কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির মূলস্রোতে তারাই বিরাজমান। সংবিধান মেনে চলতে হলে সেখানে নাক গলানোর কোনও এক্তিয়ার কেন্দ্রের নেই। সব ক্ষমতাই রাজ্য সরকারের কাছে। বকলমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। দেশের বহু সমবায়ে কোটি কোটি কালো টাকা জমা রাখা ও আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে নোট বাতিলের পরে সমবায় ব্যাঙ্কে জমা হওয়া পুরনো নোট বহু দিন পর্যন্ত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে জমা হওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

প্রশ্ন হল, রাজ্যের অধীনে থাকা সমবায়গুলিতে ছড়ি ঘোরাতে মোদী সরকার কি সংবিধান সংশোধন বা অন্য কোনও পথ নেবে? এমনিতেই গত বছর ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধন করে শহরাঞ্চলের সমবায় ব্যাঙ্কগুলি সরাসরি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এ বার সমবায় মন্ত্রক তৈরি করে মোদী সরকার রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের নালিশ করছেন বিরোধীরা। সত্যিই তা করতে হলে কেন্দ্রকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। অমিত শাহের দাবি, তিনি রাজ্যের সঙ্গে বিবাদে যেতে চান না।

সমবায় সংস্থায় কেন্দ্রের ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা আগেও হয়েছে। মনমোহন সরকারের জমানাতেই। ২০১২-তে সংবিধানে ৯৭-তম সংশোধন করে রাজ্য স্তরে সমবায় তৈরির নিয়মকানুন ঠিক করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়ে বলেছে, একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা সমবায়ে কেন্দ্র নাক গলাতে পারে। রাজ্যের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ সমবায়ে রাজ্যই শেষ কথা বলবে। কংগ্রেস ২০১৪-র নির্বাচনের আগে সমবায় ক্ষেত্রকে নিজের মুঠোয় পোরার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের বছর আড়াই আগে বিজেপি সেই একই চেষ্টা করছে। সফল হবে কি?

Advertisement
আরও পড়ুন