জনসমক্ষে অবলীলায় এমন সমস্ত বচন তিনি দীর্ঘকাল ধরে দিয়েছেন, যা তাঁর মাপ এবং পদমর্যাদার কোনও রাজনীতিক তাঁর সুদূরতম দুঃস্বপ্নেও ভাববেন না। ফাইল চিত্র।
লজেন্স আছে?
এমনিতে হাজির-জবাব রাজনীতিক কি সামান্য ভড়কালেন? নাহ্। ঈষৎ অপ্রতিভ হলেন সম্ভবত। তবে চকিতে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘‘এখন তো নেই। সকলকে দিতে দিতে ফুরিয়ে গিয়েছে। কাল ঝাড়গ্রাম চলে যাচ্ছি প্রচারে। ওখানে আসুন। অনেক লজেন্স খাওয়াব।’’
দিলীপ ঘোষের কি সেই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের কথা মনে আছে? সম্ভবত নেই। থাকার কথাও নয়। অকিঞ্চিৎকর এক সাংবাদিককে তিনি খামোখা মনে রাখতেই বা যাবেন কেন! প্লাস তখন ভোট-পূর্ব কাল। তখন তাঁর ঠমক-গমক আলাদা। বিজেপি মনে করছে, তারা রাজ্যের ক্ষমতায় প্রায় এসেই গিয়েছে! বাতাসে বদলের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। সেই বাতাসেই ইতিউতি ভাসতে শুরু করেছে যে, দিলীপই বসবেন নবান্নের ১৪ তলায়। অতএব তখন তাঁর কাছে অর্থিপ্রার্থী এবং উমেদারদের ভিড় জলস্রোতের মতো খলবল করছে। সেই বিপুল তরঙ্গে মোচার খোলার মতো ভাসমান সাংবাদিক তো নেহাতই তুশ্চু!
রাজ্যের দশদিশ তখন উপচে পড়ছে কড়া ইস্ত্রির চুড়িদার-কুর্তা, মচমচে নাগরাই, কপালে গেরুয়া সিঁদুরের উপর চালের গুঁড়োর লম্বা তিলকে। ঘন ঘন বাংলায় আসছেন জয়ের গন্ধ শুঁকতে মশগুল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গাঁতিয়ে প্রচার করছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। তেমনই এক প্রচার-শেষ সন্ধ্যায় অমিত শাহ শহরে। কলকাতার উপকণ্ঠে এক হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের ঘরোয়া আলাপচারিতা। ভোটের আগে যেমন জনসংযোগ অনুশীলন করে থাকেন তাবড় নেতারা। কিছু অফ দ্য রেকর্ড আলোচনা। কিছু গালগল্প। কিছু নির্দোষ ‘নোট এক্সচেঞ্জ’। দেখানো যে, নির্মোক ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তার ফাঁকেই পরস্পরকে একটু মেপে নেওয়া।
রাজ্য বিজেপি-র তরফে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় সব সম্পাদকই পৌঁছে গিয়েছেন। অমিত শাহ বলে কথা! রাজ্যের পদ্মশিবিরের নেতাদের অনেকে হাজির। তখনও অমিত শাহ এসে পৌঁছোননি। ফলে চারদিকে একটা হাল্কা এবং ঢিলেঢালা ভাব। অ্যাকোরিয়ামে সতত সঞ্চরমান মাছের মতো বিভিন্ন সাইজের নেতা এদিক-ওদিক ঘুরছেন। হলঘরের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সাইজের জটলা তৈরি হয়েছে। নেতারা সে সব জটলায় গিয়ে আলতো করে লেজের ঘাই মারছেন। আবার এগিয়ে যাচ্ছেন পরের জটলার দিকে। সেই আবহে ব্যাঙ্কোয়েটে ঢুকলেন দিলীপ। পরনে কুর্তা-পাজামা। গলায় অঙ্গবস্ত্র। নিখুঁত কামানো গাল। কেয়ারি করা সরু গোঁফ। ব্যাকব্রাশ চুল। চোখে রিমলেস চশমা। দিলীপের আগমনে (নাকি আবির্ভাবে?) নিস্তরঙ্গ আবহে একটা হিল্লোল উঠল। সব নজর ঘুরে গেল তাঁর দিকে। ব্যাঙ্কোয়েটের উজ্জ্বল আলোর ছটা খানিক বেড়েই গেল বুঝি বা।
ঘটনাচক্রে, দিলীপ যেখানে এসে থিতু হলেন, তার মাত্র কয়েক পা দূরেই আমি দাঁড়িয়ে। গুটিগুটি এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম। তার আগে অবশ্য হোয়াট্সঅ্যাপে দু’টি বাক্যবিনিময় হয়েছিল। ইংরেজি শুভ নববর্ষ জনিত। ফোনে একবার কথা। কুশল বিনিময়। ওই প্রথম এবং তদবধি ওই শেষ। তা দেখা গেল, দিলীপ এই অর্বাচীনকে চিনতে পারলেন। পকেটে লজেন্স আছে কি না (এটা জানা ছিল যে, সবসময় পকেটে লজেন্স রাখেন আর কারও সঙ্গে দেখা হলেই হাতে গুঁজে দেন) প্রশ্ন করায় ওই একটা বিড়ম্বনার হাসি হেসে বললেন, সকলকে বিলোতে বিলোতে লজেন্স ফুরিয়ে গিয়েছে। ওই সামান্য কথোপকথনের অবকাশেই তাঁকে ঘিরে সেই সন্ধ্যার বৃহত্তম জটলাটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। সকলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই পরিস্থিতিতে আর বার্তালাপ (এটা ‘বিজেপি-র বর্ণপরিচয়’ থেকে নেওয়া) বা খেজুর (এটা বিশুদ্ধ বাংলা) কিছুই হয় না। যেমন ওই সামান্য এবং খুচখাচ আলাপ ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ারও দাবি রাখে না। ফলে দিলীপের সঙ্গে তার পরে আর কখনও দেখা হয়নি। কথাও হয়নি। গত ১ অগস্ট তাঁর জন্মদিনে একটা ঔপচারিক শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। জবাব আসেনি। ধরে নেওয়া যেতে পারে, প্রথম সাক্ষাতের সময় দিলীপকে ঘিরে যে জ্যোতির্বলয় ছিল, ভোট-উত্তর পরিস্থিতিতে তার ছটা অনেকটাই কমে যাওয়ায় তিনি নিজেও মূহ্যমান ছিলেন। নইলে যিনি মিস্ড কল দেখে কল ব্যাক করেছিলেন, তিনি কেন শুভেচ্ছার জবাবে নিরুত্তর থাকবেন!
ফলে দেখাসাক্ষাৎ বা কথা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রাজনীতির ছাত্র হিসেবে বারবার মনে হয়েছে (সোমবার রাতে তাঁকে বিনা ভূমিকায় পদচ্যুত করার পর যেটা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে), দিলীপ ঘোষ রাজনীতির গবেষণাগারে উৎকৃষ্টতম বিষয় হতে পারেন।
পারেন, কারণ, তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক ভিন্ন এবং অশ্রুতপূর্ব ভাষার প্রচলন করেছিলেন। প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে অবলীলায় এমন সমস্ত বচন তিনি দীর্ঘকাল ধরে দিয়েছেন, যা তাঁর মাপ এবং পদমর্যাদার কোনও রাজনীতিক তাঁর সুদূরতম দুঃস্বপ্নেও ভাববেন না। সে কথাঞ্জলি (বুদ্ধিজীবীরা নিমকহারাম আর পরজীবীর মতো। শিল্পীদের রগড়ে দেব। গরুর দুধে সোনা আছে। শাড়ি ছেড়ে বারমুডা পরুন দিদি ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি) হয়তো তাঁর দলের লোকজনকে তাতিয়েছে। ইটের বদলে পাটকেলের নীতি কিছু সমর্থনকে পুষ্ট করেছে। কিন্তু পাশাপাশিই সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে তাঁকে ব্রাত্যও করেছে। দিলীপ অবশ্য পাত্তা দেননি। বরং তাঁর সামান্য টান-ধরা বাংলায় নিজস্ব নিদান দেওয়া জারি রেখেছেন। দিলীপ গবেষণার বিষয় হতে পারেন, কারণ, তিনি একগুঁয়ে এবং একবগ্গা ভাবে নিজের রাস্তায় চলেছেন। দলের ভিতরে বা বাইরে— কোনও বিরোধিতারই তোয়াক্কা করেননি। দিলীপ গবেষণার বিষয় হতে পারেন, কারণ, তাঁর সভাপতিত্বেই বিজেপি বাংলায় ভোটের নিরিখে সবচেয়ে ভাল ফল করেছে। সে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ১৮টা আসনে জেতাই হোক বা ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ৭৭টা আসনে জয় (বিজেপি ক্ষমতায় আসবে ধরে নিয়ে যাঁরা দিলীপের রিপোর্টকার্ড বানাতে বসে তাঁকে গোল্লা দিয়েছেন, তাঁরা অবশ্য এ সত্য স্বীকার করবেন না)। আবার তাঁরই প্রক্সি অধিনায়কত্বে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের অনেক আগে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দিলীপ গবেষণার বিষয় হতে পারেন, কারণ, সঙ্ঘের সামান্য আন্দামাননিবাসী প্রচারক থেকে তিনি বাংলার বিজেপি-র অন্যতম ক্যারিশম্যাটিক নেতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। গত কয়েক বছরে যতবার তাঁর গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, এই রাজ্যে আর কোনও নেতা বা নেত্রীর গাড়িতে ততবার হামলা হয়নি। শাসকদলের একাংশ তাঁকে ‘নেতা’ বানিয়েছে। আর দিলীপ শুষে নিয়েছেন প্রচারের সমস্ত আলো। প্রাতঃভ্রমণ থেকে শারীরিক কসরত বা গল্ফের ময়দান— সর্বত্র তাঁকে ধাওয়া করেছে ক্যামেরা। এমনই তাঁর টিআরপি!
কিন্তু দিলীপকে নিয়ে গবেষণা হবে না। হবে না, কারণ তিনি নেতৃত্বের অন্যতম শর্তটাই মানেননি। নেতাকে নরমে-গরমে চলতে হয়। টানে-ঢিলে রাখতে হয় পরিপার্শ্বকে। শত্রুকে নিজের কাছে-কাছে, নজরে-নজরে রাখতে হয়। নেতাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সৎ হতে হয়। ঠিকই। কিন্তু সেই সততার অহং রাখলে চলে না। ‘আমি সৎ। তাই আমি কারও ধার ধারি না’— এই অহমিকাও এক ধরনের বিচ্যুতি। দিলীপ নেতাসুলভ কূটনীতির কোনও ধার ধারেননি। তাঁর কথাবার্তা থেকে বরং ছিটকে ছিটকে বেরিয়েছে আত্ম-অহং। তিনি বুলফাইটের রিংয়ে মাতাদোরের হাতে লাল কাপড় লক্ষ্য করে গাঁক গাঁক করে শিং বাগিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই। ভারত নামক জনঅরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ বলে, নেতাকে নদীর মতো হতে হয়। তার মধ্যে এসে-পড়া বিভিন্ন জঞ্জালকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হয় আপন স্রোতে। দিলীপ তার ধার ধারেননি। তিনি ঘূর্ণি উইকেটের ব্যাকরণ—‘আগে প্যাড-পরে ব্যাট’ নীতি না মেনে সোজা ব্যাটে খেলতে গিয়েছেন। নেতাকে কঠিন সময়ে বেতসবৃত্তিও করতে হয়। অর্থাৎ, ঝড় যখন প্রবল, বাতাস যখন এলোমেলো, তখন বেতসগাছের মতো নিজেকে নুইয়ে দিতে হয়। যাতে প্রকৃতি শান্ত হলে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো যায়। দিলীপ তা তো করেনইনি। উল্টে ভোটের আগের ঢক্কানিনাদ এবং বহ্বাস্ফোট ভোটে বিপর্যয়ের পরেও বজায় রেখেছেন। বড় নেতাদের হার স্বীকার করতেও জানতে হয়। প্রতিপক্ষের প্রতি বিষোদ্গারের অভ্যাস ত্যাগ করে অভিনন্দন জানাতে হয়।
দিলীপ সে পথে হাঁটেননি। তাই তাঁকে নিয়ে গবেষণা হবে না।
দিলীপকে নিয়ে ভাবীকাল কোনও গবেষণা করবে না। কারণ, তিনি সঙ্ঘের প্রচারকের জোব্বাটা গা থেকে টেনে খুলে ‘রাজনীতিক’ হয়ে উঠতে পারেননি। দলের নেতাদের একাংশ সম্পর্কে (যাঁদের অনেকে তৃণমূল থেকে এসেছিলেন। অনেকে তাঁর দলেও ছিলেন) তাঁর বীতরাগ প্রকাশে কোনও কুণ্ঠা দেখাননি। ঘরের নোংরা কাপড় দিনের পর দিন প্রকাশ্যে কেচেছেন। খরখরে গলায়, অতিপ্রাকৃত উচ্চারণে তিনি কিছু জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন ঠিকই। কিন্তু দিনের শেষে ‘বিজেপি-র নেতা’ হয়েই থেকে গিয়েছেন। ‘বাঙালির নেতা’ হয়ে উঠতে পারেননি। তাই কোথাও পরোক্ষে, কোথাও প্রত্যক্ষে ভোট-বিপর্যয়ের দায় এবং দায়িত্ব তাঁর উপরেই এসে পড়েছে। ব্যর্থতার সেই পথে তাঁকে একলা হাঁটতে হয়েছে। সেই আঁধারে তাঁর সতীর্থদের কেউ আলো হাতে এসে তাঁর পাশে পাশে হাঁটেননি।
সোমবার রাতে সংক্ষিপ্ত বিবৃতিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-র ইতিহাসে সফলতম সভাপতিকে এত অনাড়ম্বর ভাবে, মাত্র দু’লাইনের নির্দেশে সরিয়ে দেওয়া যায়! সেই নির্দেশ, যেখানে নতুন নিযুক্তের নামটাই শুধু রয়েছে। বিদায়ীর নামের কোনও উল্লেখ নেই। হয়তো এটাই বিজেপি-র দলীয় রীতি। হয়তো এ ভাবেই কোনও একদিন নিযুক্ত হয়েছিলেন দিলীপও। তবু, তবু বিবৃতিটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, কয়েকটা লজেন্স যদি নিজের মুখেও রাখতেন!