এই মরসুমে এখনও পর্যন্ত সবক’টা ম্যাচ খেলেছে এই ছেলে। ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
সোমবার দুপুরে অনুজ সহকর্মী জাগৃক এসে খুব নিস্তরঙ্গ গলায় (সহকর্মীরা অবশ্য বলে, জাগৃকের কণ্ঠ সবসময়েই তরঙ্গ-রহিত। সবসময় ফ্ল্যাট স্কেলে। চোখের সামনে টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়লেও ওই স্কেলই থাকবে। আবার ঘোর বৃষ্টিতে বাড়ির একতলায় জল ঢুকে গেলেও) বলল, একবার ইস্টবেঙ্গল মাঠে যেতে চায়। কেন? এক ফুটবলারের বাবা মারা গিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে মাঠে এসেছে ম্যাচ খেলতে।
তাই?! কোন ক্লাবে খেলে? কী নাম?
—পিয়ারলেস স্পোর্টস ক্লাব। নাম আকাশ (ফ্ল্যাট স্কেলে)।
সেই প্রথম নামটা শুনলাম। আকাশ। আকাশ মুখোপাধ্যায়। একখানা ছবিও দেখলাম তার। একহারা চেহারা। খুবই সাধারণ। গালে এলোমেলো দাড়ি। ভাঙা গাল। লম্বাটে মুখে উঁচু হয়ে আছে হনুর হাড়। পোক্ত কাঠামোয় স্পষ্ট চোখে পড়ে কাঁধের কলারবোন। তামাটে গায়ের রং। রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে এমন চেহারার ছেলে আকছার চোখে পড়ে। কিন্তু ঠাহর হয় না। সামান্য ভুল হল। ঠাহর হয় না, যদি না তার চোখজোড়ার দিকে নজর যায়। সেই দু’চোখে কিছু বা সংশয়। কিছু বা প্রত্যয়। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্যাশন আর স্বপ্ন। অনেক বেশি জেদ আর ইচ্ছাশক্তি ঝকমক করছে।
এই ছেলে বাবার মৃত্যুর পর কলকাতা ময়দানে ম্যাচ খেলতে এসেছে। ম্যাচ জিতেছে। ডিফেন্স করতে গিয়ে বিপক্ষের ফরওয়ার্ডের সঙ্গে সংঘর্ষে মাথা ফাটিয়েছে। ফলে পুরো সময় খেলতে পারেনি। মাথায় ছ’টা সেলাই পড়েছে। এই ছেলে সেই ম্যাচের ‘ইমার্জিং প্লেয়ার’ মনোনীত হয়েছে। তার পর ব্যান্ডেজ-বাঁধা মাথা নিয়ে গিয়েছে বাবার শেষকৃত্য করতে বাড়ির কাছাকাছির শ্মশানে। সেখানে দাঁড়িয়ে এই ছেলে বলেছে, ‘‘বাবা আমাকে মাঠে দেখতে চেয়েছিলেন। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই মাঠে নেমেছিলাম। বাড়ির সকলে আমার পাশে ছিলেন। জানি না, বাবা দেখতে পেলেন কি না। তবে দেখতে পেলে তিনি খুশি হবেন।’’
ইস্টবেঙ্গল অ্যাকাডেমির প্রাক্তন সদস্য। অধুনা পিয়ারলেসের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। এই মরসুমে এখনও পর্যন্ত সবক’টা ম্যাচ খেলেছে এই ছেলে। দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে গড়িয়ার বোড়ালে বাড়ি। মা গৃহবধূ। দাদার তেমন কোনও স্থায়ী রোজগার নেই। বাবা অলোক মুখোপাধ্যায় সামান্য কাজ করে দিন গুজরান করতেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ডায়ালিসিস চলছিল। শেষ ডায়ালিসিসটা নিতে পারেননি। সোমবার সকাল থেকেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে তাঁর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ডেকেছিল ফুটবলার ছেলে। সে অবকাশ মেলেনি। বিছানা থেকে তুলতে গিয়েই ছেলে বুঝতে পারে, নাড়ির স্পন্দন থেমে গিয়েছে বাবার। ছেলের চোখের সামনে, প্রায় তার হাতের উপরেই মারা যান অসুস্থ অলোক। যিনি সকালে ঘুম ভাঙার পর ছেলেকে প্রথম বাক্যটাই বলেছিলেন, ‘‘আজ ভাল করে খেলিস।’’
এই পরিস্থিতিতে সদ্য পিতৃহারা পুত্র কী করতে পারে? আকাশপাতাল ভাবার দরকার হয়নি। সাড়ে চার মাস আগের একটা সকাল রিওয়াইন্ড করতে আর কত সময়ই বা লাগে! প্রথমে পরিজনদের খবর দেওয়া। তার পর অফিসের সহকর্মীদের অনুরোধ করা যে, সেদিনটা আর কাজে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার পর শববাহী গাড়ি যোগাড় করা, শ্মশানে দাহ-সংস্কারের ব্যবস্থা করা। অবিমিশ্র শোকতাপ, কান্নাকাটি, স্মৃতিচারণ— দিনটা কোথা দিয়ে যে ঝড়ের মতো কেটে যায়!
গড়িয়ার লাগোয়া বোড়ালের আপাত দীন-হীন পরিবারের ছেলেটির দিনটিও সেই খাতেই বয়ে যেতে পারত। কিন্তু গেল না। সে ছেলের সময় থেমে রইল শুধুমাত্র একটা ফ্রেমে। যে ফ্রেমে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে তার অসুস্থ, মুমূর্ষু বাবা বলেছিলেন, ‘‘আজ ভাল করে খেলিস।’’ আর সে ছেলে মনে মনে সংকল্প করে, ‘‘আজ আমাকে ভাল খেলতেই হবে।’’ বাবার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে কোচকে ফোন করে জানায় পরিবারে আকস্মিক অঘটনের কথা। এবং প্রায় একনিঃশ্বাসে বলে, সেদিনের ম্যাচটা সে খেলতে চায়। কোচ হতবাক হন। কিন্তু বলেন, তাঁর কোনও আপত্তি নেই। ছেলে যেন কিট্স নিয়ে মাঠে চলে আসে। ম্যাচ শুরু আগে সাজঘরে ছেলেটাকে গোটা টিমের সামনে দাঁড় করিয়ে কোচ বলেন, ম্যাচটা তাদের জিততে হবে। ওই ছেলেটার জন্য। সতীর্থরা গোলের জন্য ঝাঁপায়। ছেলেটা জান কবুল করে সামলায় বিদেশি ফুটবলারহীন রক্ষণ। ছেলেটার টিম ছ’গোল মারে বিপক্ষকে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে আকাশে বল দখলের লড়াইয়ে ছেলেটার মাথা ফাটে। কোচ তাকে তুলে নেন মাঠ থেকে। সেই ফোকর দিয়ে ছেলেটার দল দুটো গোল খায়। কিন্তু দিনের শেষে ৬-২ গোলে জিতে মাঠ ছাড়ে ছেলেটার দল। টিমের ফরওয়ার্ড গোলগুলো উৎসর্গ করে ছেলেটার বাবাকে।
ম্যাচের ‘ইমার্জিং প্লেয়ার’ মনোনীত হয় ছেলেটা। মাথায় জড়ানো গজ ব্যান্ডেজ। হাতে পুরস্কার আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের দেওয়া এককালীন ১০ হাজার টাকা সাহায্য। একুশ বছুরে মাঠ থেকে ফিরে যায় বাড়িতে। যেখানে তখনও রাখা আছে তার বাবার মরদেহ। সেই দেহ দাহ করতে ছেলে যায় শ্মশানে।
এমনও হয়? হতে পারে? এখনও? এই দুনিয়ায়? এই পৃথিবীতে? এই সমাজে? সোমবারের বর্ষণস্নাত দুপুরে তা হলে কে জিতল? ফুটবল? সংকল্প? সদ্যমৃত পিতার ইচ্ছাপূরণের তাগিদ? প্রান্তিক পরিবারের এক ছেলের জেদ? তার মানসিক কাঠিন্য? এ তো ঘরের পাশে রূপকথার জন্ম! দৈনন্দিনতার মধ্যেও আলাদা হয়ে-থাকা এক আশ্চর্য আলোর বিচ্ছুরণ! সোম-সন্ধ্যায় শ্মশানের অগ্নিগহ্বর যখন গিলে নিচ্ছিল তার বাবার নিথর শরীর, তখন কী ভাবছিল এলোমেলো দাড়ি আর বড় বড় চোখের একুশ বছর? অনতি-অতীত? বহমান বর্তমান? অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?
কে জানে! ভাঙা গাল। লম্বাটে মুখে উঁচু হয়ে আছে হনুর হাড়। পোক্ত চেহারায় জেগে আছে কাঁধের কলারবোন। তামাটে গায়ের রং। মাথায় ব্যান্ডেজ। একুশ বছরের আপাত-সাধারণ মুখটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল— এত আলো, এত আকাশ, আগে দেখিনি।
(ঋণস্বীকার: মান্না দে)