Aparajita Bill 2024

মৃত্যুদণ্ড চাই, কিন্তু…

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা ভাল মানুষ থাকে। আর থাকে একটা খারাপ মানুষ। খারাপ কিছু দেখে আমাদের মধ্যের ভালমানুষি ছাপিয়ে ওই হিংস্রতাটা বেরিয়ে আসে।

Advertisement
কৌশিক গুপ্ত
কৌশিক গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:০০
Lawyer Kaushik Gupta shares his views over aparajita bill passed in West Bengal Assembly

আরজি কর-কাণ্ডে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স।

ধর্ষণ রুখতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধানসভায় একটি বিল পাশ করিয়েছে সম্প্রতি। সর্বসম্মতিতেই ‘দ্য অপরাজিতা ওয়েস্ট বেঙ্গল উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড’ (ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল’জ়) সংশোধনী বিলটি পাশ হয়েছে। এ বার নিয়ম মেনে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলেই সেটি আইনে পরিণত হবে।

Advertisement

তবে আমার মনে হয়, এই যে বিল পাশ করানো হল বিধানসভায় সেটি আদতে ‘নি জার্ক রিঅ্যাকশন’। অর্থাৎ, ঘটনার তাৎক্ষণিক অভিঘাতে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা করে ফেলা। আমার আরও মনে হয় যে, এটা একেবারেই ‘আইওয়াশ’। অবাক লাগছে এটা ভেবে যে, বিরোধীরাও বা কী করে এই বিলে সম্মতি দিলেন!

একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তা রুখতে বিল আনা হচ্ছে। আইনের কথা ভাবা হচ্ছে। ঠিক যেমনটা করা হয়েছিল ২০১২ সালে দিল্লির ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর। ওই ঘটনার পরের বছর ‘দ্য ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০১৩’ এনেছিল মনমোহন সিংহের সরকার।

দু’টি ক্ষেত্রেই দূরদর্শিতার অভাব স্পষ্ট।

এ বার প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যের আইনসভায় ‘অপরাজিতা’ বিল পাশ হলেও রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কি তাতে অনুমোদন দেবেন? আমি নিশ্চিত, দেবেন না। কেন দেবেন না? অনেকে বলতে পারেন, কেন্দ্রে অন্য দলের সরকার। তাই রাষ্ট্রপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিলে অনুমোদন দেবেন না। আবার কেউ বলতে পারেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হয়তো রাষ্ট্রপতিকে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরামর্শ দেবে। কিন্তু আমি সেই সব যুক্তি-তর্কে যেতে চাই না। আমার যুক্তি একেবারেই আইনি এবং সংবিধানসম্মত। যা মেনেই রাষ্ট্রপতি এই বিলে অনুমোদন দিতে পারবেন না।

সেটা কী, তা বলতেই এই লেখা।

১৯৮৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা ওঠে— ‘মিঠু বনাম স্টেট অফ পঞ্জাব’। এই মামলায় শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, আইনে কোনও শাস্তির সাজা হিসাবে যদি একমাত্র মৃত্যুর সংস্থান থাকে, তবে সেই আইন ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৩ ধারায় লেখা ছিল, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোনও আসামী যদি খুন করে, তবে তার সাজা একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই হবে। উপরোক্ত মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ওই ধারা সংবিধান-বিরোধী। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, সর্ব ক্ষেত্রেই অপরাধের সাজার ‘বিকল্প সংস্থান’ থাকতে হবে। সেই বিকল্প থেকেই আদালত যে কোনও একটিকে বেছে নেবে। অর্থাৎ, কোনও অপরাধের সাজা ‘শুধুমাত্র’ মৃত্যুদণ্ড হতে পারবে না।

তা হলে ২০২৪ সালে এসে একটি রাজ্যের আইনসভা এমন বিল আনল কী করে, যেখানে একটি অপরাধের সাজা হিসাবে একমাত্র মৃত্যুদণ্ডকেই চাওয়া হচ্ছে! অথচ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, ধর্ষণের পর কারও মৃত্যু হলে বা সেই মহিলার অবস্থা জীবন্মৃত হলে অপরাধীর সাজা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড হবে। রাজ্য সরকার যে বিল এনেছে, সেখানে এই ৬৬ ধারাকে সংশোধন করে সাজা হিসাবে শুধু মৃত্যুদণ্ডকেই নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। এই বিধানসভায় অনেক বিধায়কই আছেন, যাঁরা পেশাগত ভাবে আইনজীবী। তাঁরা কি এটা জানেন না যে, এই বিল সংবিধান-বিরোধী? আমি সামান্য আইনজীবী হিসাবে যেটা জানি, যাঁরা বিলটি বানালেন, তাঁরা সেটা জানেন না এটা ভাবতে পারছি না!

আর্মস অ্যাক্টের ২৭(৩) ধারাতেও একটি অপরাধের সাজা কেবলমাত্র মৃত্যুদণ্ডই ছিল। কিন্তু ‘স্টেট অফ পঞ্জাব বনাম দলবীর সিংহ’ মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ‘মিঠু বনাম স্টেট অফ পঞ্জাব’ মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে আর্মস অ্যাক্টের সেই ধারাও বাতিল করেছে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত নির্দেশ ১৪১ এবং ১৪২ ধারা অনুযায়ী সকলে মানতে বাধ্য। যাঁরা ‘অপরাজিতা’ বিলটি প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা এটা জানেন না ভেবে অবাক হচ্ছি!

আসলে কড়া শাস্তি কখনও অপরাধ করা থেকে কাউকে বিরত করেনি। ছোটবেলার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। মা যদি বারণ করত, ‘‘ফ্রিজে মিষ্টি আছে, খাবি না।’’ আমরা কিন্তু শুনতাম না। লুকিয়ে খেয়ে নিতাম। জানতে পারলে মা বকবে জানতাম। সেই বকুনিটাই শাস্তি। কিন্তু শাস্তির ভয় ছিল না। ভয় ছিল ধরা পড়ার। মনে মনে প্রার্থনা করতাম, যাতে ধরা না পড়ি। আমার মনে হয়, কঠিন শাস্তির কথা না ভেবে অপরাধীকে চটজলদি ধরার পদ্ধতির দিকে রাষ্ট্রের নজর দেওয়া উচিত। শাস্তির ভয় দেখিয়ে কোনও দিন অপরাধ ঠেকানো যায়নি।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। কারণ? কারণ, এই শাস্তি একেবারেই অপরিবর্তনযোগ্য। ধরা যাক, আরজি কর-কাণ্ডে যে অভিযুক্তকে পুলিশ ধরেছে, সেই সিভিক ভলান্টিয়ারকে তড়িঘড়ি ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হল। বছর পাঁচেক পর জানা গেল, ওই ব্যক্তি আদতে অপরাধী ছিলেন না। অপরাধী অন্য কেউ। কিন্তু তত দিনে তো তাঁর ফাঁসি হয়ে গিয়েছে। আমরা তো তখন আর এই মানুষটিকে ফেরত আনতে পারব না। ভারতীয় দণ্ডবিধি তো ১৮৬০ সাল থেকে রয়েছে দেশে। এখন আছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী খুনের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় খুনের সাজার কথা শোনানো হয়েছে ১০৩ ধারায়। সেখানেও যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ১৮৬০ সাল থেকে ২০২৪— খুন হওয়া কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেশে? এটা থেকেই বোঝা যায়, মৃত্যুদণ্ডের মতো সাংঘাতিক শাস্তিও কিন্তু অপরাধ করা থেকে কাউকে বিরত করে না।

ফলে শাস্তির বিধান ঠিক না-করে রাজ্য সরকারের উচিত অপরাধের যাতে সঠিক এবং দ্রুত তদন্ত হয়, সে দিকে খেয়াল রাখা। বহু ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, বড়সড় অপরাধের তদন্তে প্রচণ্ড গাফিলতি ছিল। কামদুনির ক্ষেত্রেও। ফলে বিচার পেতে সমস্যা হয়। কারণ, বিচারকের তো হাত বাঁধা। তদন্তের উপরে দাঁড়িয়েই তো বিচার হয়। সেখানেই আমার প্রশ্ন, তদন্তে যাতে গাফিলতি না হয়, সেটা নিয়ে আমরা কী করেছি? ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় বলা হয়েছে বিচারের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার কথা। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টও রয়েছে। কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে? ওই আদালতের যিনি বিচারক, তাঁকে একা হাতে পাঁচ জনের কাজ করতে হয়। কারণ, বহু বছর পর্যাপ্ত নিয়োগ হয়নি।

আরজি কর-কাণ্ডের আবহে রাজ্য সরকার যে বিল এনেছে, সেখানে শাস্তি (পানিশমেন্ট)-র কথা বলা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, আগাম প্রতিরোধ (প্রিভেনশন) নিয়ে কথা হচ্ছে না কেন? সরকার তো একটা আইন এনে বলতেই পারত, সঠিক বয়সের পর স্কুলে যৌনশিক্ষা চালু করা হবে এ বার। যাতে নারী, পুরুষ বা রূপান্তরকামী নির্বিশেষে যৌনতা বিষয়টি জানতে পারে। বুঝতে পারে। আসলে আমাদের দেশে যখন কোথাও একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন এ সব নিয়ে আলোচনা হয়। এই যে অহরহ ট্রেনে-বাসে মহিলাদের শরীরে হাত দেওয়ার ঘটনা ঘটে, এ সব কোন মানসিকতা থেকে আসে? আমাদের তো এখনও শিক্ষাই দেওয়া হয়নি যে, যৌনতা বিষয়টিতে সম্মতি (কনসেন্ট) প্রয়োজন। ফলে আমরা শাস্তির উপরে জোর না দিয়ে অপরাধকে আগাম প্রতিরোধ করার উপর যদি জোর দিই, তা হলে সেটা হবে কাজের কাজ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেটাই।

এ বার এই প্রতিরোধের কথা বললেই অনেকে চান, সবটা সিসি ক্যামেরা দিয়ে মুড়ে দিতে। এটা ‘প্রিভেনশন’ নয়। এটা সুরক্ষা (প্রোটেকশন)। সুরক্ষার কেন দরকার পড়বে! আমার মধ্যে যদি সচেতনতা থাকে, আমার মধ্যে যদি বোধ থাকে, তা হলে তো আমি সেই অপরাধ করবই না। সিসি ক্যামেরা বা পুলিশ পোস্টিং দিয়ে এ সব ঠেকানো যায় না। আর সিসি ক্যামেরা তো আমার গোপনীয়তার অধিকারকে লঙ্ঘন করে। রাতের বেলায় মহিলাদের একা বাইরে বেরোতে দেখে পুলিশের অনেকেই তাঁদের বলে থাকেন, ‘‘এত রাতে বাড়ির বাইরে একা বেরিয়েছেন! কিছু হলে তো তখন আমাদের দোষ হবে।’’ এটা তাঁরা বলতে পারেন না। এক জন মহিলা রাতে বাইরে বেরোবেন। একাই বেরোবেন। সেটা তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। ওই পুলিশকর্মীর দায়িত্ব তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া। তাঁকে সুরক্ষিত রাখা। সে জন্যই রাষ্ট্র তাঁকে নিয়োগ করেছে।

আসলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা ভাল মানুষ থাকে। আর থাকে একটা খারাপ মানুষ। খারাপ কিছু দেখে আমাদের মধ্যের ভালমানুষি ছাপিয়ে ভিতরের হিংস্রতাটা বেরিয়ে আসে। আমরা সে সব নিয়ে ভাবছি না। ভাবতে পারছি না। কিন্তু আমাদের তো সচেতন হতে হবে। হতেই হবে!

এত ক্ষণ ধরে যা যা লিখলাম, সে সব সমস্যার একটাই উৎস— পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। তাই আমি মৃত্যুদণ্ড চাই। তবে সেটা অপরাধীর নয়। সেটা এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার।

(লেখক পেশায় আইনজীবী। মতামত নিজস্ব)

আরও পড়ুন
Advertisement