আজকের ‘আমি’ আর ভবিষ্যতের ‘আমি’ কি এক লোক
Time Management

আচ্ছা, কাল করব

যে কোনও কাজেরই একটা কস্ট আছে, তার বেনিফিটও আছে। সমস্যাটা হয় সেখানে, যেখানে মূল্যটা এখনই ধরে দিতে হয়, কিন্তু ফল পাওয়া যায় পরে।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩২
A Photograph of of Clocks

আপনি যেটা করছেন, দেবভাষায় তাকে বলে ‘প্রোক্র্যাস্টিনেশন’। কাজ ফেলে রাখছেন। প্রতীকী ছবি।

মেলা থেকে সোজা এলেন?” বিধ্বস্ত শিবুদাকে গোপালের দোকানে ঢুকতে দেখেই জিজ্ঞাসা করে শিশির। ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন শিবুদা। তার পর বললেন, “উরিত্তারা, চারটে গঙ্গাসাগর মেলার সমান ভিড়। নিজের ইচ্ছায় কোনও দিকে যাওয়া বা দাঁড়ানোর ব্যাপারই নেই, বুঝলি। ভিড় যে দিকে ঠেলে নিয়ে গেল, সে দিকেই গেলাম। অবিশ্যি, এই ভিড়ের চোটে একটা সুবিধা হয়েছে— চেনাজানা যাদের বই বেরিয়েছে, তারা কেউ আমায় পাকড়াও করতে পারেনি!”

“আপনার বইটার কী হল? বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স নিয়ে যেটা লেখার কথা হচ্ছে চার বছর ধরে?” বলা বাহুল্য, প্রশ্নটা তপেশের। শিবুদা যেন জানতেন, প্রশ্নটা উঠবেই। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, “এত লোক লিখছে, তাতেও তোর মন ভরছে না? সবাই যদি লেখে, তবে পড়ে কে? বইটই কিনছে লোকজন, জানিস না কি?”

Advertisement

“কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই স্যর,” শিবুদাকে কোণঠাসা করার সুযোগ ছাড়তে তপেশ নারাজ। “আপনি যেটা করছেন, দেবভাষায় তাকে বলে প্রোক্র্যাস্টিনেশন। কাজ ফেলে রাখছেন।”

গোপাল চা দিল। চুমুক দিতে গিয়েও থমকালেন শিবুদা। বললেন, “শব্দটা কোত্থেকে এল, জানিস? ল্যাটিন ভার্ব প্রোক্র্যাস্টিনেয়ার থেকে— প্রো মানে ফর, ক্র্যাস্ট মানে টুমরো— অর্থাৎ, কালকের জন্য। কাজটা যে করব না, তা নয়— শুধু আজ করব না, কাল। যে কারণে রাবণ শেষ অবধি স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে উঠতে পারল না।” কথা শেষ করে চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিলেন শিবুদা।

“সবই বোঝেন, তবু আলস্য ঝেড়ে ফেলে কাজটা করবেন না!” হতাশ ভঙ্গিতে বলল তপেশ। শিবুদাকে দিয়ে বইটা লেখানোর জন্য ও অন্তত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছে।

“অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে আমি সব বুঝি বলে দাবি করব না। সময় পেলে গুগল স্কলারে একটু সার্চ করে দেখিস— কেন লোকে কাল করব বলে কাজ ফেলে রাখে, তার কারণ বিষয়ে বাঘা বাঘা পণ্ডিতরাও একমত নন।” চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। “তবে, একটা বিষয়ে সবাই একমত— যারা কাজ ফেলে রাখে, তারাও জানে যে, সেটা উচিত হচ্ছে না। শুধু বই লেখা নয়, আমি যে ‘কাল ছাড়ব, পরশু ছাড়ব’ করে কিছুতেই সিগারেট ছাড়ছি না, এটা আমার আয়ু কমাচ্ছে, সেটা কি আমি জানি না? এই যে সূর্য, ছ’বছর ধরে পিএইচ ডি থিসিসটা লিখে উঠতে পারল না, ও কি নিজে জানে না যে, এটা ভয়ঙ্কর অন্যায় করছে? তুই প্রত্যেক মাসে বলিস সামনের মাস থেকে টাকা জমাতে আরম্ভ করব, কিন্তু কোনও মাসেই করিস না— তুই জানিস না যে, আজ যে টাকাটা না জমিয়ে বাজে খরচ করে ফেললি, রিটায়ার করার পর সেই টাকাটার জন্য আফসোস করতে হবে? জানিস, তার পরও করিস। অর্থাৎ, জ্ঞানপাপী আমি একা নই, আমরা সবাই। কেন, সেটাই হল প্রশ্ন।”

“আলস্য দিয়ে কিন্তু ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না, শিবুদা। থিসিস শেষ না করে আমি যে ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছি, তা তো নয়— এমনই ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে যে, কাজটা করেই উঠতে পারছি না। রোজ ভাবি, কাল থেকে করব।” আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল সূর্য।

“শিব্রাম চক্রবর্তীর গল্পটা জানিস তো? তিনি নাকি এক জনকে তাঁর দৈনিক রুটিন শুনিয়েছিলেন— মূলত ঘুমে ঠাসা সেই রুটিনে লেখালিখির কোনও উল্লেখ নেই দেখে সে লোক জানতে চাইল, তা হলে লেখেন কখন? শিব্রাম উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন, পরের দিন!’ তোর অবস্থা দেখছি সে রকম।” আগেও অন্তত দশ বার এই গল্পটা বলেছেন শিবুদা। তবুও পুরনো হয় না। তার পর বললেন, “আসলে, আমরা সবাই নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও কিছু কাজ করছি, অথবা করছি না। কেন, তার উত্তরে গত চল্লিশ বছর ধরে একটা কথা বারে বারে উঠে এসেছে— প্রেজ়েন্ট-বায়াসড প্রেফারেন্স। মানে, দীর্ঘমেয়াদের চেয়ে তাৎক্ষণিককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। ভবিষ্যতের বড় লাভের স্বার্থে এখনকার ছোট লাভকে ছাড়তে না পারা। আজ মাল্টিপ্লেক্সে একটা সিনেমা দেখে রেস্তরাঁয় খেয়ে বাড়ি ফেরার সাময়িক সুখ ত্যাগ করে যদি সেই টাকাটা জমিয়ে ফেলতে পারি, তা হলে ভবিষ্যতে তা সুদে-আসলে বেড়ে চিকিৎসার খরচের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগবে, এটা জেনেও সিনেমা দেখতে চলে যাই আমরা— কারণ এই মুহূর্তে এই মুহূর্তটাই সত্যি,” কথা শেষ করে চায়ে চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত করলেন শিবুদা। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। হাঁক পাড়লেন, “গোপাল, আর এক কাপ চা দে বাবা।”

“আমি কিন্তু সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করছি না শিবুদা,” সূর্য বলল। “সত্যিই রোজ কোনও না কোনও কাজ পড়ে যায়।”

“কাজ পড়ে যায়, সেটা হয়তো সত্যি, কিন্তু ভেবে দেখিস তো, আজ থেকে কুড়ি বছর পরে কোনও এক দিন হিসাব কষলে সেই কাজগুলোর গুরুত্ব বেশি হবে, না তোর পিএইচ ডি-র,” চায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই উত্তর দিলেন শিবুদা। “সাইকোলজির রিসার্চ বলছে, প্রত্যেকটা দীর্ঘসূত্রতার পিছনে কোনও না কোনও নেগেটিভ ইমোশন আছে। কোনও কাজ ভয়ানক বোরিং, কোনওটা মাপে এতই বড় যে হাত দিতে ভয় হয়, কোথাও অনিশ্চয়তা, কোথাও হতাশা। ভেবে দেখ, লোকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারে না কেন। নেশা, মগজে কেমিক্যালের কারসাজি তো আছেই, পাশাপাশি রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা— সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলে আমার শরীরে-মনে যেটা হবে, সেটা সামলাতে পারব তো? সূর্য পিএইচ ডি-র কাজটা ফেলে রেখেছে, কারণ কাজটা মাপে বড়— তার শেষ দেখা যাচ্ছে না, অতএব এগোনোর মতো মনের জোরও হচ্ছে না। বাজে খরচ বন্ধ করে লোকে টাকা জমাতে পারছে না, কারণ খরচ বন্ধ করা ব্যাপারটা এসেনশিয়ালি বোরিং— খরচ বন্ধ করা মানে জীবনের অনেক আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা।

“এ বার ব্যাপারটাকে একটু অর্থনীতির জায়গা থেকে দেখ। যে কোনও কাজেরই একটা কস্ট আছে, তার বেনিফিটও আছে। সমস্যাটা হয় সেখানে, যেখানে মূল্যটা এখনই ধরে দিতে হয়, কিন্তু ফল পাওয়া যায় পরে। আজ ক্রেডিট কার্ডের পুরো টাকা শোধ করে দিলে দু’বছর পরে ধারের পাহাড়ে চাপা পড়তে হবে না বটে, কিন্তু সে ফল তো দু’বছর পরের কথা। আজ পকেটের টাকাটা ধার শোধের কাজে ব্যবহার না করে সেটা দিয়ে নতুন কিছু কিনলে আনন্দ হাতেগরম। আজ সিগারেট খাওয়া বন্ধ না করলে আজ নিকোটিন তোর মগজের প্লেজার সেন্টারগুলোকে স্টিমুলেট করবে, কিন্তু আজ সেই আনন্দ ত্যাগের মূল্য ধরে দিলে হয়তো কুড়ি বছর পরে সিওপিডি হওয়া থেকে বাঁচবি। আজ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না মেরে ট্যাক্স রিটার্ন জমা করার কাজটা সেরে রাখলে তিন মাস পরের এক দিনের ঝামেলা কমবে, আজকের নয়। আজ শুধু লড়াই। দোকানে গিয়ে দাম দিয়ে এলাম, কিন্তু জিনিসটা ডেলিভারি পাব তিন বছর পরে— এটা যাদের সহ্য হয় না, তারা সহজেই দীর্ঘসূত্রতার খপ্পরে পড়ে।” কথা শেষ করে গোপালের দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শিবুদা। শিশিরের সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাতটা বাড়িয়েও থেমে গেলেন।

“ঝামেলা চুকিয়ে দিলেই হয়। মেনে নিই যে, টাকা জমানো হবে না, বই লেখা হবে না। শেষ পর্যন্ত যে হবে না, তা তো দেখাই যাচ্ছে,” বলল শিশির।

“না হে, অতটা সহজ নয়,” বললেন শিবুদা। “প্রথমত, হাল ছেড়ে দেওয়া মানে হার স্বীকার করে নেওয়া। নিজের কাছে পরাজয় স্বীকার করার চেয়ে কঠিন কাজ খুব কম আছে। তা ছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে হাল ছাড়ার তো উপায় নেই। যে ছাত্র গোটা সিমেস্টার প্রোজেক্ট লেখার কাজটাকে ‘কাল করব’ বলে কাটিয়ে গেল, সিমেস্টার শেষ হওয়ার আগে তাকে লিখতে তো হবেই। একেবারে শেষ দিনে এসে হলেও ট্যাক্স রিটার্ন জমা না করে তো উপায় নেই। যে ক্ষেত্রে এমন বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে ব্যাপারটা একটু কঠিন— এই ধর, আমি যদি বইটা শেষ অবধি না লিখি, আমায় কেউ আটকাবে না। আটকাচ্ছি আমি নিজেই, কারণ আমি জানি, বইটা লেখা আমার জন্যই ভাল। অতএব, সহজতর পথ হল নিজেকেই বলা যে, কাজটা আমি কাল করব। তাতে অন্তত নিজেকে এই ভরসাটুকু দেওয়া যায় যে, আমি নিজের ভালর কথা ভুলে যাইনি। একটু সময় নিচ্ছি মাত্র।

“ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস-এর অধ্যাপক হ্যাল হার্শফিল্ড এখানেই একটা মোক্ষম স্পিন দিয়েছেন। তাঁর রিসার্চ বলছে, কাজটা যার ভরসায় ফেলে রাখি, সেই ভবিষ্যতের ‘আমি’কে আজকের ‘আমি’ এক জন অন্য লোক বলে মনে করে। এ যেন নিজের কাজের বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা। এমন লোক, যাকে আমি ভরসা করি যে, সে লোকটা যাবতীয় অপ্রীতিকর কাজ নির্দ্বিধায় করে দেবে আমার জন্য।”

“সে সব না হয় হল, কিন্তু এই দীর্ঘসূত্রতার খপ্পর থেকে নিস্তার পাব কী করে? আমার যে কাজটা শেষ না করলেই নয়!” কাতর প্রশ্ন করে সূর্য।

“কী ভাবে নিস্তার পাবি না, সেটা বলে দিই বরং। বাজারচলতি যা যা টোটকা আছে, ইন্টারনেটে, সেল্‌ফ হেল্প বইয়ে যা বলা আছে, তার বেশির ভাগেই কাজ হবে না।” চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন শিবুদা, “কিসে কাজ হবে, আমি বলে দেব। কিন্তু আজ আর ইচ্ছা করছে না। পরের দিন বলব।”

আরও পড়ুন
Advertisement