Durga Puja 2023

পুজো এলেই যাঁদের খুঁজে বেড়াই

আমি যখন আনন্দবাজারে পুজোর লেখা শুরু করি তখন ঢাকুরিয়ার বাবুবাগান ক্লাবের পুজো তাদের উৎকর্ষের শীর্ষে। পুজো মণ্ডপ তৈরির খুঁটিনাটি জানতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিয়ে বসে থাকতাম সেখানে। কাজ দেখতাম।

Advertisement
দেবদূত ঘোষঠাকুর
দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩ ১১:২৭
কলকাতার একটি পুজোর দুর্গাপ্রতিমা।

কলকাতার একটি পুজোর দুর্গাপ্রতিমা। ছবি: পিটিআই।

পুজো এগিয়ে এলে সেই ডাকটা কানে বাজে, ‘‘দেবদূতদা চলে এলাম।’’ তিনি আমার থেকে বয়সে বেশ খানিকটা বড়। কিন্তু ওঁর মুখে ‘দেবদূতদা’ ডাকটার মধ্যে একটা জাদু ছিল। তাই আমিও আপত্তি করিনি।

Advertisement

পুজোর অন্তত দু’মাস আগে থেকে প্রতি শনি আর রবিবার সকালে বাড়ি ছেড়ে আমার কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। দোতলার ড্রয়িং রুমে সোফা, ডিভানে কুলাত না। ডাইনিং টেবলের পাশে আরও বেশ কয়েকটি চেয়ার আনতে হত। অতিথিরা কলকাতার বিভিন্ন পুজো কমিটির কর্তা। থিম নিয়ে জোরদার আলোচনা হত। এটাই ছিল একমাত্র ‘মঞ্চ’ যেখানে এক পুজো কমিটি অন্য কমিটির সঙ্গে নিজেদের থিম নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করত। সেখানে নতুন এক জন সদস্যের সংযোজন হল।

বছরটা সঠিক মনে পড়ছে না। ২০০৩ বা ’০৪ হবে। অগস্টের এক শনিবার সকালে বাড়ির সামনে বড় একটা গাড়ি এসে থামল। এক দম্পতি কলিং বেল বাজালেন। পুজো উদ্যোক্তা, শিল্পীরা আগে থেকে খবর দিয়ে আসেন। ওই দম্পতিকে চিনতে পারছিলাম না। আর পুজো কমিটির কেউ প্রথম পরিচয়ে স্ত্রী নিয়েও তো আসেন না! দোতলায় উঠেই কপালে দু’টি হাত ঠেকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘দেবদূতদা আমার নাম পিকে বিশ্বাস। ঠাকুরপুকুরে থাকি। ছোট একটা কারখানা আছে। ঠাকুরপুকুরে নতুন একটা থিম পুজো শুরু করেছি আমরা। সেটা জানাতেই আসা।’’ এর পর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

ঠাকুরপুকুরের পুজো শুনে উৎসাহিত হলাম। এর অর্থ বেহালা ছাড়িয়ে থিমের পুজো ছড়াল আরও দক্ষিণে। সেই সময়টায় বেহালা নিত্যনতুন থিমে মণ্ডপ তৈরি করছে। বড়িশা-শীলপাড়ার দক্ষিণের এলাকা তখনও কলকাতার পুজো মানচিত্রে ঢোকেনি। ঠাকুরপুকুরের পুজো শুনে লেখার নতুন বিষয় পেয়ে গেলাম। সে বার পুজো পরিক্রমায় প্রথম বারের জন্য বেহালা পেরিয়ে আনন্দবাজার ঠাকুরপুকুরে গেল। উদয়নপল্লি নামের পুজোটি সে বার পুজোয় সুপার-ডুপার হিট। যার মেরুদণ্ড ওই বিশ্বাসদা অর্থাৎ পিকে বিশ্বাস।

এর পর আমাদের সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে গেল। আমি বরাবরই এই সমস্ত সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই উদাসীন। কিন্তু বিশ্বাসদা-বৌদি ছাড়ার পাত্রপাত্রী নন। বিশ্বাসবাড়ির যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকতই। সারা বছর দেখা না হলেও, পুজোর আগে এক দিন স্বামী-স্ত্রী আমাদের বাড়িতে আসবেনই। মূলত আমার উন্নাসিকতার জন্যই নিয়মিত যোগাযোগটা ক্ষীণ হয়ে গেল। এক বার পুজোর আগে বিশ্বাসদা এলেন না। মনটা খচখচ করছিল। স্টেট ব্যাঙ্ক পার্ক পুজো কমিটির সঞ্জয় মজুমদারকে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম বিশ্বাসদার কথা। শুনলাম বিশ্বাসদা মারা গিয়েছেন।

উদয়নপল্লির পুজো এখনও হয়। তবে বিশ্বাসদাকে সেখানে আর পাওয়া যায় না।

আমি যখন আনন্দবাজারে পুজোর লেখা শুরু করি তখন ঢাকুরিয়ার বাবুবাগান ক্লাবের পুজো তাদের উৎকর্ষের শীর্ষে। পুজোমণ্ডপ তৈরির খুঁটিনাটি জানতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিয়ে বসে থাকতাম সেখানে। কাজ দেখতাম। অসিতদা (অসিত মণ্ডল) তো ছিলেনই, সঙ্গে ভটচাযদা (তৃষিত ভট্টাচার্য), দেশাই, বুড়োদা (জাদুকর পিসি সরকারের বন্ধু), প্রত্যুষদা, বাবু (সুমন চট্টোপাধ্যায়), কিটু সবাই ঘিরে থাকত। মনে হত একটা যৌথ পরিবারে এসে পড়েছি। তখন বাবুবাগানের একটা শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক দল ছিল। অসিতদার স্ত্রী ছিলেন তার মাথা।‌ বুড়োদার বৌ (পাতাবৌদি) সহকারী। প্রত্যুষদার বৌ, দেশাইয়ের বৌ, সুমনের বৌ— সকলেই ওই দলের সদস্য। ওই যৌথ পরিবারের অটুট বন্ধন কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রথমে চলে গেলেন প্রত্যুষদা। তার বছর চারেক পরে চলে গেলেন অসিতদার ডান হাত বুড়োদাও। তখন অসিতদাকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অসিতদা সেই ধাক্কা সামলাতে পারলেও, অনেকে বলতেন, প্রিয় বন্ধুর অপমান সম্ভবত (পারিবারিক সমস্যাও কিছু ছিল) সইতে পারলেন না বাবুদা। বাবুবাগানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা খারাপ হয়ে যেত।

এলাকা বড় হোক বা ছোট, তিনি যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিন। শুধু বলতে হত, ‘‘এটা চাই।’’ পুকুরের মধ্যে কাঠের সেতু বানিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবেন এক আশ্চর্য নগরীতে। কিংবা রাস্তার দু’দিকের বহুতলের মধ্যে তিনি গড়ে তুলতে পারেন কপালকুণ্ডলার সেই জঙ্গল, যেখানে নবকুমার পথ হারিয়েছিলেন। আবার সরকারি নিষেধাজ্ঞায় মণ্ডপের আয়তন একেবারে ছেঁটে অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুজো কমিটির মাথায় হাত। কিন্তু শিল্পী এতটুকু ঘাবড়াননি। সেখানে গড়ে তুলেছিলেন এক শৈলশহর। কর্মসূত্রে থাকতেন হায়দরাবাদে। কাজ করতেন ফিল্মসিটিতে। সিনেমার দৃশ্যপট তৈরি করাই ছিল তাঁর পেশা। সারা বছরের ছুটি জমিয়ে পুজোর আগে দু’মাস থাকতেন কলকাতায়। মণ্ডপ বানাতেন। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ওই ‘জিন’ সঞ্জিৎ ঘোষকে কলকাতার পুজো কিন্তু আর খুঁজলেও পাবে না।

আর যেখানে সঞ্জিৎ ওই কপালকুণ্ডলার মণ্ডপ তৈরি করেছিলেন, লেক ভিউ রোডের সেই শিবমন্দিরের পুজোয় ম্যারাপ বাঁধা থেকে শুরু করে, বিসর্জনের পরে শেষ খুঁটিটি তোলা পর্যন্ত যদি কাউকে সেখানে পাওয়া যেত তিনি সুব্রত ঘোষ। এক বার রাত আড়াইটের সময় অফিস থেকে ফেরার পথে ঘুরতে ঘুরতে শিবমন্দিরের মণ্ডপে গিয়েছি। জানি কর্মকর্তাদের কাউকে পাব না। নিরাপত্তারক্ষীকে বলে নির্মীয়মাণ মণ্ডপের ভিতরে উঁকি মেরে চলে আসব। কী আশ্চর্য! মণ্ডপের সামনে গাড়ি পার্ক করতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক জন, ‘‘আরে আসুন, আসুন।’’ আমি ও আমার সঙ্গীরা (একই গাড়িতে দক্ষিণ শহরতলির চার জন বাড়ি ফিরছিলাম) অবাক! শুধু মণ্ডপ ঘুরিয়েই দেখালেন না, ওই রাতে হাতে হাতে তুলে দিলেন গরম চা। আবার বেলা ১০টায় গিয়ে দেখি, ওই মানুষটাই ইলেক্ট্রিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলছেন। কোনও পুজো কমিটিতে এমন এক জন করে সর্ব দক্ষ মানুষ থাকলে, সর্বাঙ্গসুন্দর হয় উৎসব। সেই মানুষটিও হারিয়ে গিয়েছেন হঠাৎ করে। সুব্রতদের বিকল্প পাওয়া মুশকিল। পায়ওনি শিবমন্দির।

থিতাইকে আমার এত দিন পরেও বেশ মনে আছে। বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা চেহারার ছেলেটা দারুণ সঙ্গত করত। ঢোল, খোল, নাল, তবলায় থিতাইয়ের হাত কথা বলত। ও একটা গ্রুপে সঙ্গত করত। এ দেশে-ও দেশে অনুষ্ঠান করতে যেত থিতাই। সে বার সখেরবাজারের ‘সৃষ্টি’ (তখনও সৃষ্টি ও সহযাত্রী মিলে বড়িশা ক্লাব হয়নি)-র মূল আকর্ষণ ছিল ভবতোষ (সুতার)-এর তৈরি করা ষষ্ঠী পুতুলের মণ্ডপ ও তার সঙ্গে মানানসই প্রতিমা। আমি কিছু কিছু পুজোর সঙ্গে বড্ড বেশি জড়িয়ে পড়তাম। আমার মনে হল, এই পুজোর সঠিক আবহ আনতে একটা পাঁচালি গোছের কিছু থাকা দরকার। আর সেটা আমি লিখব শুনে থিতাই লাফিয়ে উঠল, ‘‘লেখো দাদা। জমিয়ে বাজাব।’’ সেটাই সম্ভবত কলকাতার পুজোর প্রথম থিম সং। আর ওই গানটার সুর দেওয়া থেকে শুরু করে রেকর্ডিং করা, সঙ্গত— সব একা হাতে সামলেছে থিতাই। রাত ১২টা পর্যন্ত আমাকে সামনে বসিয়ে এডিটিং শেষ করেছিল। ‘সৃষ্টি’র পুজোর ওই অমূল্য সম্পদ এক দিন হঠাৎ করেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল। তোকে ভুলিনি রে থিতাই!

(মতামত নিজস্ব।)

আরও পড়ুন
Advertisement