—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আমেরিকার সঙ্গীত-যুগল পল সাইমন আর আর্ট গারফাঙ্কলের ১৯৭০-এর অতি জনপ্রিয় অ্যালবাম ব্রিজ ওভার ট্রাবল্ড ওয়াটার-এর একটি গানে ছিল আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চলের এক জনজাতি লোককথাভিত্তিক লোকসঙ্গীত— ‘এল কনডর পাসা’। সেই গান বিপুল ‘হিট’ করল। কিন্তু অভিযোগ উঠল, যাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বেচে অর্থোপার্জন করলেন সাইমন-গারফাঙ্কল, তাঁরা একটি পয়সাও পেলেন না। সেই বিতর্কের জল গড়াল টানা সাড়ে তিন দশক। শেষ অবধি ২০০৮ সালে শুরু হল ইউনেস্কোর ইনট্যান্জিবল কালচারাল হেরিটেজ-এর তালিকা তৈরি। গত দেড় দশকে দুনিয়ার ১৪০টা দেশের প্রায় পৌনে সাতশো ঐতিহ্য ঠাঁই পেয়েছে সেই তালিকায়। ২০২১ সালে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কলকাতার দুর্গাপুজোও।
২০১৬ সালের এক গবেষণাপত্রে বুখারেস্ট ইউনিভার্সিটি অব ইকনমিক স্টাডিজ়-এর তুদরাখ পেত্রোনেলা বলছেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর রক্ষণাবেক্ষণ অর্থনীতির এক মূল্যবান উৎস হিসাবে কাজ করে। ২০২১-এর শেষলগ্নে কলকাতার দুর্গাপুজো যখন ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে ঋদ্ধ হল, ইউনেস্কোর নয়াদিল্লির পরিচালক বললেন, এই স্বীকৃতি উৎসাহিত করবে সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যবাহী কারিগর, ডিজ়াইনার, শিল্পী, বড়সড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংগঠক, পর্যটক, দর্শনার্থী, সবাইকে। আমরা জানি, বাস্তবে অনেক আগে থেকেই দুর্গাপুজো বহু শিল্পী, কারিগর, ঢাকি, বিক্রেতা-সহ অনেকেরই প্রায় সম্বৎসরের জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম। কোটি কোটি মানুষ দুর্গাপুজোতে খরচ করেন প্রাণ খুলে। কেনাকাটায়, খাওয়া-দাওয়ায়, বেড়ানোয়। তাই ইউনেস্কোর তালিকাভুক্তির ফলে এ সব ক্ষেত্রের অর্থনীতিতে নতুন কোনও জোয়ার আসা সত্যিই বেশ কঠিন।
‘অর্থনীতিতে কলকাতার দুর্গাপুজো’র যথাযথ প্রভাবের হিসাব কষা বেশ কঠিন। সে চেষ্টা যদিও হয়েছে বার বার। ‘অ্যাসোচ্যাম’-এর ২০১৩ সালের সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, সে বছর দুর্গাপুজোর অর্থনীতি ছিল আনুমানিক ২৫,০০০ কোটি টাকার। বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৫%। দুনিয়া কিন্তু সে সময়ে মন্দার নাগপাশ থেকে মুক্তির মরিয়া চেষ্টায় অস্থির। আবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণা-রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালের পুজোয় পশ্চিমবঙ্গে নাকি তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩২,০০০ কোটি টাকার ‘সৃজনশীল অর্থনীতি’। ২০২২-এ সেটা বেড়ে হয়েছে ৫০,০০০ কোটি, চোখে পড়েছে এমন অনুমান। অঙ্কটা নাকি এ বছর আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে ইউনেস্কোর ট্যাগ হয়তো বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে বাড়তি উদ্দীপনাও জাগিয়ে তুলবে।
কলকাতার পুজোয় সত্যিকারের অভাব যদি কিছু থাকে, তা বিদেশি কিংবা ভিন রাজ্যের পর্যটকের। সার্বিক ভাবে এমন চমকদার উৎসবের জুড়ি মেলা ভার হলেও। যথাযথ বিপণন করলে এবং উপযুক্ত পর্যটক-বান্ধব পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলে প্রতি শরতেই বাংলার অর্থনীতি আরও অনেকখানি শিউলি-স্নিগ্ধ হয়ে উঠতেই পারে। কালচারাল হেরিটেজ-এর তকমাকে কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কিংবা সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের ভাল-থাকার মাধ্যম হিসাবে খানিকটা ব্যবহার করা সম্ভব। দুনিয়ার অনেক অংশে তো সংস্কৃতির অধরা অংশটুকুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় পর্যটন বিকাশের কৌশল। পর্যটকরা নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চান। প্রকাশ্য অনুষ্ঠেয় শিল্পমাধ্যম, হস্তশিল্প, আচার-অনুষ্ঠান এবং রান্নায় বৈশ্বিক পার্থক্য অনুভব করতে চান। দুনিয়া-জোড়া পর্যটকদের এই মানসিকতাকে সযত্নে লালন করেই শ্রীবৃদ্ধি ঘটে পর্যটনের।
লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ২০১৯-এর এক গবেষণা সন্দর্ভে স্টেফানিয়া কার্ডিনালে ২০১০-এ ‘ইনট্যান্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তকমা পাওয়া পুরুলিয়ার ‘ছৌ নাচ’ প্রসঙ্গে স্পর্শাতীত ঐতিহ্য এবং জীবিকার সম্পর্কের তত্ত্বতালাশ করেছেন। কার্ডিনালে বলছেন, পর্যটকদের জন্য স্পর্শাতীত ঐতিহ্য এবং উৎসবের অভিজ্ঞতা শিল্প-বিক্রয়ের মাধ্যমে শিল্পী এবং দর্শকের মধ্যে একটি নতুন ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, যা এক প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বিনিময় দ্বারা চিহ্নিত।
তবে, ঐতিহ্য হিসাবে ছৌ নাচ আর দুর্গাপুজো তো সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এদের প্রকৃতিতে, প্রকাশে, ব্যাপ্তিতে, সংশ্লিষ্ট জনগণের যোগদানের পরিধির নিরিখে। রিয়ো কার্নিভ্যালে প্রতি বছর জড়ো হন ১৫ লক্ষেরও বেশি পর্যটক, যার অর্ধেকই বিদেশি। দুনিয়ার অন্য নামজাদা বচ্ছরকার উৎসবগুলিতেও পর্যটকরাই জীবনীশক্তি। মিউনিখের অক্টোবরফেস্টে প্রতি বছর হাজির হন ৭০ লাখের বেশি পর্যটক। আনুমানিক প্রায় সাড়ে ছ’কোটি লোক প্রতি বছর হানামির সময় চেরি ফুলের বাসন্তিকার রংমিলান্তি দেখতে হাজির হন জাপানে। পর্যটকরা তাঁদের ভ্রমণকালে বিপুল খরচ করে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিতে প্রাণ-সঞ্চার করেন আমেরিকার নিউ অর্ল্যান্ডের ‘মারডি গ্র্যাস’-এ কিংবা স্পেনের পাম্পলোনার ষাঁড়ের দৌড়ের ‘সান ফারমিন’ উৎসবেও। কলকাতার পুজো প্যান্ডেলে কিন্তু বিদেশি কিংবা ভিন রাজ্যের টুরিস্ট হাতেগোনা।
তাঁর গবেষণাপত্রে পেত্রোনেলা বলছেন, অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারিত হতে পারে পর্যটকদের ভ্রমণ এবং তাঁদের করা খরচের মাধ্যমে, যা অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করতে পারে। এমনকি তা হয়তো কাজ করতে পারে ‘গুণিতক’ হিসাবেও। ‘যোগ’ হোক বা ‘গুণ’, তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত টুরিস্ট-বান্ধব পরিকাঠামোর নির্মাণ, এবং দুর্গাপুজোর অবাক-জৌলুস সম্পর্কে সম্ভাব্য পর্যটকদের অবহিত করানো।
ইউনেস্কোর সম্মান অর্জনের পরে দ্বিতীয় পুজো এটা। প্রাক্-কোভিড ২০১৯-এর তুলনায় এ বারের পুজোয় পর্যটকের সংখ্যা কি কিছু বাড়ল? ঐতিহ্যগত ভাবেই পুজোয় শোভা, ঔজ্জ্বল্য আর প্রাণের যে মহিমার প্রকাশ ঘটে, তাতে রয়েছে অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ততা। নির্দ্বিধায় যাকে বলা চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাৎসরিক পথ-উৎসব বা ‘স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল’। কলকাতার এই অনন্য উৎসবের অমিত সম্ভাবনাকে মন্থন করে অর্থনৈতিক লাভের কথা ভাবা সম্ভব। উচিতও।