Iftar Party

তোমার করে তোমাকে ভাবিনি

এই যে রমজান চলছে, ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই অনেক বাঙালিই স্কুলে, কলেজে, অফিসে, কাছারিতে বন্ধুদের কাছে ইফতারের খাবার খাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

Advertisement
হাসনুহেনা
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫৪

বিরিয়ানি, কাবাব, সিমুই, লাচ্চা, হালিম, এ সব মনে পড়লেই পাশের পাড়ার মুসলমান প্রতিবেশী বা বন্ধু বা সহকর্মীদের কথা মনে পড়ে। কথায় বলে, হিন্দুর বাড়ি আর মুসলমানের হাঁড়ি। মুসলমানের বিভিন্ন উৎসব, আচার, রীতি জুড়ে থাকে বিভিন্ন রকম স্বাদু খাবারের আয়োজন। এই যে রমজান চলছে, ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই অনেক বাঙালিই স্কুলে, কলেজে, অফিসে, কাছারিতে বন্ধুদের কাছে ইফতারের খাবার খাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

Advertisement

‘আপ রুচি খানা’, এই বাক্য এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। মানুষ কী খাবে, তা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে, সামাজিক স্তরে, সাংস্কৃতিক স্তরে রাষ্ট্রের প্রলম্বিত বাহু আর ক্রোধান্বিত আঁখির উপস্থিতি এখন কেবল পরোক্ষ ভাবে নয়, প্রত্যক্ষ টের পাওয়া যায়। তাই ইফতারের খাবারের প্রতি অ-মুসলিম বন্ধুদের আকর্ষণ বিশেষ করে আনন্দিত করে।

অন্য দিকে, যেন একটু সঙ্কোচও হয়। ইফতার তো শুধু সমাজমাধ্যমের ছবিতে ভেসে আসা সুখাদ্য ও সুপানীয়ের সারি মাত্র নয়। মাগরিবের আজানের সুর যখন গোধূলির রঙের সঙ্গে মিশে থমথমে শুনশান পাড়া বেয়ে গৃহস্থের কাছে গিয়ে পৌঁছয়, তখন ধার্মিক মুসলমান সাধ্যমতো খাবারের থালা নিয়ে, একটু ঠান্ডা শরবত নিয়ে অপেক্ষারত। সে ইফতার ঠিক ‘ইফতার পার্টি’ নয়। উপবাস থাকাকালীন ইফতারের সেই খাবার তৈরির সময় এক বা একাধিক উপবাসে থাকা মানুষের শ্রম, এবং খুব সম্ভবত, নারীশ্রম, ক্ষুধা এবং সংযম মিশে যায় সেই খাবারে। ইফতার যতটা না হইহই করে আনন্দ-উদ্‌যাপনের খাওয়া, তার চেয়ে বেশি উপবাস প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাকে খাদ্যোৎসবে পরিণত করতে ক্ষতি নেই, তা হতেই পারে সমস্ত ধর্মাবলম্বীর মিলনসূত্র, কিন্তু সেই ইফতারের আয়োজন ব্যক্তিগত স্তরে না হয়ে সাংগঠনিক ভাবে, সমষ্টিগত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যেমন প্রতি বছরই বিভিন্ন মসজিদে, দরগায় ইফতারের আয়োজন হয়।

মনে হয়, রোজা, ইফতার যত না সমষ্টিপালিত একটি উৎসব, তার থেকেও অনেক বেশি ব্যক্তির ‘আমি’কে আবিষ্কার করার পথ। এই পথ একলার, ভিতরের। নিজের চরিত্রের নানা ধরনকে নানা সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাকে আয়নার মতো করে নিজের কাছে দেখে নেওয়ার সময়। প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতা, সহমর্মিতা, দয়া-দাক্ষিণ্য অনুশীলনেরও সময়, কেননা এর পরই আসবে ইদ-উল-ফিতর: আনন্দের, সৌহার্দের ইদ।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে গৈরিক শিবিরের আস্ফালন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর। ঢুকে পড়ছেন আরও বেশি মুসলমান হওয়ার প্রতিযোগিতায়। এর মাঝে অনেকেই আছেন, যাঁরা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনসেতু গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দুর্গাপুজো বাঙালির ‘সর্বজনীন’ উৎসব হলে ইদও কেন সমস্ত বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হয়ে উঠবে না, এমন দাবির পাশে শ্বেতপুষ্প রাখতে ইচ্ছে করে!

কিন্তু এই দাবি অবধি পৌঁছনোর আগে একটি দীর্ঘ অপরিচয়ের, অজানার পথও আছে বলে মনে হয়— যে পথ না-শেষ হলে ইদ সমগ্র বাঙালির উৎসবে পরিণত হওয়া কঠিন। সত্যিই তো, হিন্দু-মুসলমানের দীর্ঘ দিনের বিভেদ, ছোঁয়াছুঁয়ি, শুচিবায়ু বাধা তৈরি করে রেখেছে পরস্পরের আচার-আচরণ, পরিস্থিতি, সংস্কৃতির মাঝে। আলাদা করে দুটো ইদের নাম আর তাৎপর্যও জানাও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মুসলমান সমাজের আচার-আচরণ, রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে সম্যক জানার ইচ্ছে না-থাকলে বাহ্যিক আড়ম্বরে খানিক ঢক্কানিনাদই হবে, অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুচবে কি? বরং দীর্ঘ দিনের দারিদ্র, অশিক্ষায় ডুবে থাকা সাংস্কৃতিক পুঁজি-শূন্য একটি জাতিকে বুঝতে হলে বাঁধাধরা স্টিরিয়োটাইপ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ইদের ছুটি, ইদের বোনাস, ইদ সংখ্যা আরও কী ভাবে ‘সর্বজনীন’ হয়ে উঠতে পারে, সে দিকে নজর দিতে হবে।

একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায় মুসলমান মানুষদেরও। সঙ্কোচের, বিহ্বলতার, অপমানের ক্ষুদ্র গণ্ডি কেটে বেরিয়ে ইদের আনন্দকে, ইদের মানবিক দিকগুলিকে প্রসারিত করতে হবে।‘জাকাত’ ‘ফেতরা’র অর্থ কি শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেই রেখে দেওয়ার? প্রতিবেশী অন্যান্য দীন-দুঃখীর মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াও কি থাকতে পারে না সেখানে? শুধু ইদের খাবার নয়, ইদের ফেতরাও হোক সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জন্য।

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি উঠছে, ক্রিসমাস বা দুর্গাপুজোয় যে ভাবে সমস্ত বাঙালি উদ্‌যাপনে মেতে ওঠে, ইদেও কেন তা হবে না? তবে কি ধর্ম যার যার উৎসব সবার, এ কথা ইদের বেলায় খাটে না? নিশ্চয়ই খাটে। ইদও সমস্ত বাঙালির উৎসব হোক। কিন্তু তাতে উৎসবের চেনা ছক হয়তো কার্যকর নয়। বৃহত্তর যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী গ্রামের অধিবাসী, অর্থে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে যাঁরা পিছিয়ে, ইদের এই সময়টায় ফেতরা জাকাতের অর্থে তাঁদের গায়ে নতুন শাড়ি, লুঙ্গি ওঠে। আশঙ্কা হয়, ইদকে ‘সর্বজনীন’ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়ে তাকে যদি শুধুই শহরকেন্দ্রিক ঝলমলে আড়ম্বরে মুড়ে হাজির করা হয়, তাঁদের সেই হাসিটুকুও মিলিয়ে যাবে না তো! ইদের মধ্যে যে ত্যাগের আনন্দ, সংযমের প্রশান্তি, স্থৈর্যের তিতিক্ষা মিশে থাকে, যাকে শুধু ভোগের আনন্দে, ব্যক্তিগতের সীমায় গ্রহণ করা যায় না, মাইকের আওয়াজে, আলোর ঝলকানিতে তা নষ্ট হয়ে যাবে না তো?

ইদকে ‘সমস্ত বাঙালির উৎসব’ হওয়ার আগে সমস্ত বাঙালি মুসলমানকে ‘বাঙালি’ বলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করা জরুরি। বাংলা ভাষায় আব্বা, চাচা, খালা, ফুফুরও সমান অধিকার মেনে নেওয়া জরুরি। ‘বাঙালির সংস্কৃতি’ শুধু ‘হিন্দু বাঙালি’র সংস্কৃতি নয়। বাঙালিত্বর উপর মুসলমান বাঙালিরও ঠিক ততটাই অধিকার— যতটা হিন্দু বাঙালির। এই কথা যত দিন না প্রতিষ্ঠিত হবে, তত দিন ইদও শুধু মুসলমানের উৎসব হয়েই থাকবে।

তা ছাড়া ক্রিসমাস যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ে কেক-পেস্ট্রিতে, ক্রিসমাস ট্রিতে, পুজোমণ্ডপের আলোকসজ্জা যে ভাবে ছড়ায় কাছে দূরে, ইদ কী ভাবে সেই মাপকাঠিতে সর্বজনীন হয়ে উঠবে, তা এখনও অস্পষ্ট। শেষে সংখ্যাগুরুর উদ্‌যাপনের মাপকাঠিতেই ইদের ছবি তৈরি হবে না তো? আধিপত্য এসে নিয়ে যাবে না তো মিলন প্রয়াসকে?

বাংলা বিভাগ, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়।

Advertisement
আরও পড়ুন