চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সভ্যতার ভিত ক্রমশই ভাঙছে মানুষের লোভ ও হিংসায়

গান্ধার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তিন তরুণীর সম্মেলক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী এ রকম লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কি কোনও যৌক্তিকতা আছে? নারী বা পুরুষের সৃজনের ক্ষেত্রে নান্দনিক কোনও পার্থক্যও কি চিহ্নিত করা যায়? ১৯৭১ সালে আমেরিকার ‘আর্ট নিউজ’ পত্রিকায় লিন্ডা নক্লিনস একটি বড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ‘হোয়াই হ্যাভ দেয়ার বিন নো গ্রেট উওম্যান আর্টিস্ট?’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০

শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী এ রকম লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কি কোনও যৌক্তিকতা আছে? নারী বা পুরুষের সৃজনের ক্ষেত্রে নান্দনিক কোনও পার্থক্যও কি চিহ্নিত করা যায়? ১৯৭১ সালে আমেরিকার ‘আর্ট নিউজ’ পত্রিকায় লিন্ডা নক্লিনস একটি বড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ‘হোয়াই হ্যাভ দেয়ার বিন নো গ্রেট উওম্যান আর্টিস্ট?’ এর উত্তরও তিনি দিয়েছিলেন একভাবে। আদি কাল থেকে পুরুষ প্রাধান্যের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর নিজস্বতা প্রতিষ্ঠায় সময় লেগেছে অনেক। সমস্যাটা তত জটিল থাকে না যদি আমরা গ্রামীণ লৌকিক ও আদিবাসী শিল্পের দিকে তাকাই। সেখানে পুরুষ ও নারী সমান আত্মনিবেদনে শিল্পসৃষ্টি করেন, কোনও রকম আত্মপ্রচারের অভিপ্রায় ছাড়াই। আসলে পুরুষ-প্রাধান্যের সমস্যাটা নগর-কেন্দ্রিক উন্নত সভ্যতার সমস্যা। এবং আধুনিকতারও। কিন্তু আজ সমস্যাটা খুবই বাস্তব।

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক শিল্পকলায় নারীর অবস্থান নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের জন্য কাজ করেছেন ফিল্ম ও দৃশ্যকলা বিষয়ে গবেষক ও লেখক শর্মিষ্ঠা মাইতি। প্রকল্পটির নাম দিয়েছেন ‘শি ক্রিয়েটস টু কংকার’। এরই একটি পর্যায় হিসেবে সম্প্রতি গান্ধার আর্ট গ্যালারিতে তাঁর পরিকল্পনায় আয়োজিত হয়েছিল তিন জন বিশিষ্ট তরুণী শিল্পীর একটি প্রদর্শনী। শিল্পীরা হলেন অমৃতা সেন, নবীনা গুপ্তা ও ফাল্গুনী ভাট। তাঁরা তিন জনই কাজ করেছেন আধুনিকোত্তর দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজভাবনা থেকে, যেখানে এই প্রযুক্তি অধ্যুষিত উন্নত সভ্যতা ও জীবনের ভিত ক্রমশই ভেঙে যাচ্ছে মানুষের লোভ, হিংসা ও ক্ষমতার আস্ফালনে।

Advertisement

অমৃতার কাজের প্রধান মাধ্যম কাগজ, কালি ও জলরং। কিন্তু প্রথাগত জলরঙের ছবি তিনি আঁকেন না। কাগজকে তিনি ত্রিমাত্রিক ভাবে ব্যবহার করেন। অনেকগুলি তল সৃষ্টি করেন কাগজকে বাঁকিয়ে বা ভাঁজ করে। কিন্তু কোনও পরিচিত প্রতিমাকল্পের আদল আনেন না তাতে। বিমূর্ত ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিকতার ভিতর জলরঙে আঁকেন আপাত-কৌতুকদীপ্ত অবয়ব। কিন্তু সে কৌতুক কালিমারই রূপান্তর মাত্র। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্যালিগ্রাফিক পদ্ধতিতে শব্দের বুনন। প্রতিমাকল্প ও শব্দমালার সমন্বয়ে পরিস্ফুট হয় মানব অস্তিত্বের বা সাম্প্রতিক সামাজিক পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কালিমার আবহ। এই প্রদর্শনীতে তাঁর একটি কাজের শিরোনাম ‘বুক অব ফিয়ার’। ভাঁজ করা কাগজের পরতে পরতে কিছু অবয়ব আঁকা থাকে। পাশে পাশে সন্নিবিষ্ট হয় এ রকম শব্দমালা ‘ব্ল্যাক মাউথ’, ‘ব্ল্যাক হ্যন্ডস ইন ডিফারেন্ট ডিরেকশনস’, ‘ব্ল্যাক হার্টস’, ‘ব্ল্যাক আইডিয়াজ’, ‘ব্ল্যাক মাস্‌ল’ ইত্যাদি। সংকেতের মধ্য দিয়ে তিনি এ ভাবেই বিশ্বব্যাপ্ত তমসাকে অভিব্যক্ত করতে চেয়েছেন তাঁর অন্যান্য রচনাতেও।

নবীনা গুপ্তা আপাত ভাবে নিসর্গ এঁকেছেন। দীর্ঘ অনুশীলনে দূর-প্রাচ্যের আঙ্গিক ও প্রকরণ পদ্ধতি সমন্বিত করেছেন তার ভিতর। কিন্তু সেই নিসর্গ শুধুই দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির রূপায়ণ নয়। এখানে চিত্র-সমন্বিত একটি ইনস্টলেশনের শিরোনাম ‘ডিসঅ্যাপিয়ারিং ডায়লগস’। প্রকৃতির ভিতর যে ঐশ্বর্য ছিল মানুষের হিংসা ও লোভের পরিণামে তা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সেই শূন্যকেই তিনি আপাত সুষমার ভিতর থেকে নিষ্কাশিত করেছেন। ‘গ্ল্যাসিয়ার ওয়াটার’ রচনায় হিমালয় সংলগ্ন পর্বতাঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া বহু সামগ্রীর যেটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে তারই পেপার পাল্প প্রতিমূর্তি তৈরি করে ইনস্টলেশনের মতো সাজিয়ে সভ্যতার অন্তর্নিহিত লোভের প্রতীক করে তুলেছেন।

ফাল্গুনী ভাট কাজ করেছেন সিরামিকস-এ। উপস্থিতির ভিতর প্রসুপ্ত থাকে যে অনুপস্থিতি, সেই শূন্যতার স্বরূপ সন্ধানই হয়ে উঠেছে তাঁর অভিনিবেশের বিষয়। ‘অ্যাবসেন্স অ্যান্ড প্রেজেন্স’ রচনায় সিরামিকসের রচনার সঙ্গে সোনার তবকে মোড়া খেলার তাস ব্যবহার করেছেন। এই সাংকেতিকতা প্রসারিত হয়েছে অন্যান্য কাজেও। ‘ফরগিভেন ড্রিমস’ একটি ত্রিতল অট্টালিকার নির্মাণ। খোলা দরোজার অন্তরালে শূন্য পরিসরের পুঞ্জিভূত অন্ধকারকে একটি বিশেষ চরিত্র করে তুলতে পেরেছেন। ‘কাম কাম কাম’ শীর্ষক রচনায় উপরে উঠে যাওয়া শূন্য একটি সিঁড়ির উপস্থাপনা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে অজস্র মানুষ। কোন শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে তারা? যেন সম্পূর্ণ গন্তব্যহীন এক অভিযাত্রা।

আরও পড়ুন
Advertisement