চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সঠিক ব্যক্তিত্বের উন্মোচনেই শিল্পীর সফলতা

গ্যালারি গোল্ড-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সুজাতা চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।কিংবদন্তি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুচিত্রা সেন প্রয়াত হয়েছেন গত বছর ১৭ জানুয়ারি। প্রয়াণের প্রথম বর্ষপূর্তিকে মনে রেখে এই মহাশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলেন বাংলার এক চিত্রশিল্পী সুজাতা চক্রবর্তী। গ্যালারি গোল্ডে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর চতুর্দশতম একক প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘তুলির টানে সুচিত্রা সেন’। ক্যানভাসের উপর সাদা-কালো অ্যাক্রিলিক রঙে সুজাতা এঁকেছেন ১৫টি ছবি। সবগুলিই সুচিত্রা সেনের মুখাবয়ব ও প্রতিকৃতি-চিত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুচিত্রা সেন প্রয়াত হয়েছেন গত বছর ১৭ জানুয়ারি। প্রয়াণের প্রথম বর্ষপূর্তিকে মনে রেখে এই মহাশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলেন বাংলার এক চিত্রশিল্পী সুজাতা চক্রবর্তী। গ্যালারি গোল্ডে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর চতুর্দশতম একক প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘তুলির টানে সুচিত্রা সেন’। ক্যানভাসের উপর সাদা-কালো অ্যাক্রিলিক রঙে সুজাতা এঁকেছেন ১৫টি ছবি। সবগুলিই সুচিত্রা সেনের মুখাবয়ব ও প্রতিকৃতি-চিত্র। সুচিত্রা অভিনীত বিভিন্ন সিনেমার কোনও একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তকে চিত্রপটে রূপবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী।

আঙ্গিকের দিক থেকে আলোকচিত্রসুলভ স্বাভাবিকতাবাদই হয়ে উঠেছে শিল্পীর প্রধান অবলম্বন। আলোছায়ার দ্বান্দ্বিক দ্যোতনা নিয়ে তিনি নানা ভাবে খেলেছেন। আর তার ভিতর থেকেই বের করে আনতে চেষ্টা করেছেন নায়িকার বিভিন্ন অভিব্যক্তি ও ‘মুড’।

Advertisement

চিত্রশিল্পে স্বাভাবিকতাবাদ বা ন্যাচারালিজম যথেষ্ট জটিল একটি প্রকল্প। মনে করা হয় এই আঙ্গিকে বিষয়ের বা রূপাবয়বের কোনও বিকৃতিকরণ, আদর্শায়ন বা বিমূর্তায়ন করা হবে না। এই নিরিখে এই আঙ্গিকের স্বর্ণযুগ বলে ভাবা হয় ধ্রপদী গ্রিক, রেনেঁসাস ও সপ্তদশ শতকের ওলন্দাজ শিল্পের কিছু প্রবণতাকে। পাশ্চাত্যে ১৯৭০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল যে ‘নিও-ক্লাসিসিজম’-এর আন্দোলন, তাতেও ধ্রুপদী স্বাভাবিকতাবাদী অতীতের দিকে তাকানোর প্রয়াস ছিল। আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ সব সময়ই চেষ্টা করেছে বাস্তবতাকে বিশ্লিষ্ট করে তার ভিতর থেকে দৃশ্যতার কালোপযোগী স্বতন্ত্র দর্শন নিষ্কাশিত করতে। স্বাভাবিকতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এর ভিতর সন্তর্পণে কাজ করেছে।

সুজাতা সুচিত্রা সেনের যে চিত্র-রূপায়ণ করেছেন, তাতে স্বাভাবিকতাবাদকে তিনি গ্রহণ করেছেন প্রকৃষ্ট প্রস্থানবিন্দু হিসেবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতায় স্থিত থাকেননি। সাদা-কালোর দ্বান্দ্বিকতায় তিনি যে ছায়াতপ তৈরি করেছেন, সেখানে কাজ করেছে ধূসরের অজস্র স্তরবিন্যাস। তাঁর সফল ছবিগুলিতে ধূসরের মাত্রাভেদের স্পন্দন অনেক সময়ই অভিব্যক্তিবাদী রহস্যময়তার সঞ্চার করেছে। সুচিত্রার ‘দেবদাস’ ছবির চরিত্রাভিনয়ের অনুষঙ্গে যে মুখাবয়বটি তিনি করেছেন, তাতে এই বৈশিষ্ট্যটি খুবই সফল ভাবে ধরা পড়েছে। নায়িকার মুখটিকে শুধু তিনি রূপায়িত করেছেন। সেই মুখের উপর এসে পড়েছে এক ঝলক আলো। কিন্তু সে আলো শুধুই নিষ্কলুষ আলোকময়তা নয়। তার ভিতর রয়েছে নানা মাত্রার স্বল্পালোকিত প্রচ্ছায়া। মুখাবয়বের সম্মুখভাগ বাদ দিয়ে বাকি যে অংশ সেখানে গভীরতর এক আঁধার পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। মাথার উপর থেকে কেশরাশি বেয়ে সেই অন্ধকার স্রোতের মতো নেমে এসেছে গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত। চিত্রক্ষেত্রের বাম-পার্শ্বের এই তমসাস্রোতের পর একটি স্তরে তিনি তৈরি করেছেন ধূসরের প্রচ্ছায়া, যাতে স্তিমিত কিছু আলোর প্রক্ষেপ আছে। তার পরে আবার একটি অন্ধকারের স্তর। অন্য প্রান্তে অর্থাত্‌ ডান দিকে শুধুই রয়েছে নিপাট অন্ধকার। কেবল চুলের প্রান্তভাগে খুব সামান্য কিছু আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটছে। মধ্যভাগের আলোর উদ্ভাস থেকে দুই প্রান্তে ধূসর ও তমসার যে সংঘাত, তা মুখাবয়বে গহন এক অভিব্যক্তিময় ব্যক্তিত্বের সঞ্চার ঘটাচ্ছে। এই ব্যক্তিত্বের উন্মোচনেই শিল্পী প্রকাশের সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছেন। ‘হাসতে তাঁদের মানা’ শিরোনামে একটি ছবি (১৪ নং) রয়েছে, যেখানে শিল্পী নায়িকার হাসিটিকে ধরতে চেয়েছেন। মুখের উপর অত্যধিক আলোর আবিলতা অভিব্যক্তির গহনতাকে ভারাক্রান্ত করেছেন এখানে। ‘আপন খেয়ালে’ শীর্ষক ছবিতে নায়িকার পূর্ণ অবয়বের রূপায়ণে শিল্পী স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছেন।

তিন বছর আগে তাঁর দ্বাদশ এককে সুজাতা কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীরা’কে নিয়ে চিত্রমালা করেছিলেন। নীরা যেহেতু নির্দিষ্ট কোনও মানবী নয়, বরং বহু মানবী চরিত্রের সমন্বিত সারাত্‌সার, সেখানে শিল্পীর সুযোগ ছিল রূপাবয়বকে বিশ্লিষ্ট করে চরিত্রের নানা মাত্রাকে পরিস্ফুট করার। সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রে শিল্পী সেই সুযোগ পাননি। ফলে তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকের নানা দিক নিয়ে। সেটা তিনি করেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement