যেখানে প্রতি বছর পুজো হয়, তার পাশেই একটি রেশনের দোকানের উপরে আমার ঠিকানা।
আমার কি পুজো-যোগ আজকের? সেই ১৯৭৩ সাল থেকে। আমি তখন একডালিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা। যেখানে প্রতি বছর পুজো হয়, তার পাশেই একটি রেশনের দোকানের উপরে আমার ঠিকানা। পরে যিনি আমার সচিব হন, তিনি তখন একডালিয়া পুজো কমিটির উদ্যোক্তা। সাল ১৯৭১। আমি প্রথম বিধায়ক। সাল ১৯৭২। সুব্রত মুখোপাধ্যায় মন্ত্রী। ১৯৭৩-এ পুজো কমিটির সভাপতি। পেশা আর পুজোয় এ ভাবেই আমার ধাপে ধাপে উন্নতি! একডালিয়া এভারগ্রিন পুজো কমিটির সক্রিয় সদস্যই উদ্যোক্তা গত ৫০ বছর ধরে। বহু বার মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। বিধায়ক থেকে সরে শুধুই দলের সক্রিয় কর্মী হয়ে থেকেছি। কিন্তু, পুজো কমিটির সভাপতির আসন টলেনি! নিন্দকেরা যথারীতি চোখ টাটিয়েছে, ‘পুজোয় মন্ত্রী-যোগ ঘটল’ বলে। আমি বলি, এতে আমার পুজো পাগলামি আরও বেড়েছে। পুজো করাও একটা বড় নেশা। তাকে সুষ্ঠু ভাবে পালন করা নির্বাচনে লড়ার থেকে কোনও অংশে কম নয়।
নিজে চাঁদার বিল কাটিনি, চাঁদা তোলার ধরন শিখিয়েছি...
অনেকেই হয়তো ভাবেন, কতটাই বা খাটতে হয় আমাকে! সবই হয়তো পুজো কমিটির সদস্যরাই করে-কম্মে দেন। ঠিক কথা। আমি কখনও বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদার বিল কাটিনি। কিন্তু চাঁদা তোলার ধরন শিখিয়েছি। সম্মান দিয়ে, জোর-জুলুম না করেও যে বেশি চাঁদা আদায় করা যায়, দেখিয়ে দিয়েছি। পরামর্শ দিয়েছি সব বিষয়েই। প্রতি বছর খুঁটিপুজোর দিন থেকে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় একটু একটু করে পুজো উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত হতে থাকেন। ওই দিন খুঁটিপুজো দেখতে আসেন বিধায়ক দেবাশিস কুমার, মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সহ বহুজন। আমাদের পুজো চণ্ডী মতে হয়। চণ্ডীপাঠের সময় নিয়ম করে উপস্থিত থাকি। প্রতি দিন পুজোর শুরুটা পুরোহিত মশাই আমাকে দিয়ে করান। আমার নামে পুজো সংকল্প হয়। এ ছাড়া ভোগ রান্না তো আছেই। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে আমিষ, নিরামিষ মিলিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। এখনও ভোগ রান্না করি তিন দিন। অঞ্চলবাসী খেয়ে বলেন, ভোগ নাকি আমি ভালই রাঁধি।
থিমে নেই... ঐতিহ্যেই বাজিমাত একডালিয়া এভারগ্রিনের
আমার মতোই রক্ষণশীল আর অভিজাত আমার পুজো। একডালিয়া তাই থিমে নেই। পুরস্কারের মোহেও নেই। আমাদের দেশে লাখো মন্দির ছড়িয়ে। প্রতি বছর তারই একটি রূপ আমরা আমাদের মণ্ডপে তুলে ধরি। এ বারে যেমন মন্দির মূর্ত হবে রুপোর কারুকাজে। মন্দিরের গায়ে অসংখ্য মূর্তি খোদাই করা থাকে। আমাদের মণ্ডপে এ বারে তেমনই মূর্তি দেখতে পাবেন দর্শক। সব মূর্তি রুপোয় তৈরি। এ ছাড়াও থাকবে রুপোর সূক্ষ্ম কারুকাজ। প্রতি বছরের মতো এ বছরেও জয়পুর থেকে আসবে ঝাড়বাতি।
আমাদের ঠিক পাশেই আরও একটি বিখ্যাত পুজো সিংহী পার্ক সর্বজনীন। অনেককেই রসিকতা করে বলতে শুনেছি, ‘জঙ্গি নেতা’র (পড়ুন সুব্রত মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে পড়শি পুজো কমিটির নাকি ঘোর রেষারেষি! বিশ্বাস করুন, কারওর সঙ্গে কোনও দ্বন্দ্ব-বিরোধ নেই। বরং এত বছর ধরে পুজো করে আসার পরেও চাপা দুশ্চিন্তা প্রতি বছরেই তাড়া করে ফেরে। আর প্রতি বছর দেবী মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা থাকে, ‘‘তোমার পুজো যেন ভাল ভাবে পালন করতে পারি।’’ নিজের পুজো সামলাতে সামলাতে আর অন্য ঠাকুর খুব একটা দেখা হয়ে ওঠে না। তবে কাছেপিঠের পুজোকর্তাদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেই হয়। আমার এই রক্ষণশীল মনোভাবের জন্যই বোধ হয় পুজোর ক’টা দিন ম্যাডক্স স্কোয়ার নিয়ে মাতামাতি তেমন ভাল লাগে না। বিকেল পর্যন্ত ওখানের পরিবেশ সুস্থ। সন্ধে নামলেই যেন বড্ড চোখে বেঁধে।
দর্শনার্থীরা যেতে যেতে ইশারায় দেখান, ওই দ্যাখ, মঞ্চে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়...
আমার পুজো মানেই মন খুলে ধুতির সঙ্গে নানা রকম কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পরার দিন। ভাল-মন্দ খাওয়া দাওয়ার দিন। যদিও বয়সের কারণে তাতে রাশ টেনেছি। পাশাপাশি, পুজো কমিটির মঞ্চে বসে দর্শকদের ঢল দেখে মন ভরে যাওয়ার দিন। জানেন, গত ৫০ বছরে আমার পুজোয় প্রশাসনের দৌরাত্ম্য নেই। ব্যারিকেড বা দড়ি ফেলা নেই। মহিলা-পুরুষের আলাদা প্রবেশপথও নেই। সবাই নিজের মতো আসেন। মন্দির, প্রতিমা দেখেন। চলে যান। অবাক কাণ্ড! লক্ষ লোকের ভিড়ে আজও পর্যন্ত একজন পকেটমারের সন্ধান পেলাম না!
আর কী ভাল লাগে জানেন? দর্শনার্থীরা যখন পুজো দেখতে ঢোকা বা বেরোনোর পথে মঞ্চের দিকে আঙুল তুলে ইশারায় বলেন, ‘‘ওই দ্যাখ, মঞ্চে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়! ওঁর পুজো।’’ শুনে কান জুড়িয়ে যায়। মনে হয়, সার্থক আমার পুজো-পাগলামি।