রবীন্দ্রনাথের গানই ঘর-বাড়ি-আশ্রয়। পুজোর সময়ও কেটে যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে।
সময় বোধ হয় আলোর চেয়েও দ্রুত। চোখের সামনে খোলনলচে পাল্টে ফেলা শহরে আবার একটি অপেক্ষার আবর্তন শেষ, আবার একটা পুজো। আর পুজো মানেই যে একরাশ স্মৃতির ভিড়। ফেলে আসা রঙিন অতীত এই সময় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে বর্তমানের নির্জনতায়, টোকা দিয়ে যায় সেই সব আলো-হাসির দিন, গানের সুর। সে ছিল এক দিন আমাদের যৌবনে কলকাতা...
আমাদের আবাসনের পুজোই ছিল সমস্ত আনন্দের উৎস। মনে আছে, পুজোর চার দিন আবাসনের মূল ফটক বন্ধ থাকত, তাই এই ক’টা দিন আমাদের ছোটদের ছাড়। এই চির-আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সারা রাত জেগে চলত আমাদের আড্ডা, এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাওয়াদাওয়া। ঠান্ডা পানীয় থেকে রোল, বাদ থাকত না কিছুই। খাওয়ানোর ভারও এক এক দিন ন্যস্ত থাকত এক এক জনের ওপর। তা ছাড়া দলবল বেঁধে সবাই মিলে গান-নাটক তো ছিলই। ৩৫ বছর আগে এই আবাসনের মঞ্চেই আমার প্রথম গান গাওয়া মাইকের সামনে। এক বছর আমি পুজোর সম্পাদক হলাম। সে বার আমরা ঠিক করলাম, আবাসনে সব চেয়ে বড় ঠাকুর হবে। পরিকল্পনা মাফিক তা হলও। প্রতি বার একচালার ঠাকুর হয়, কিন্তু সে বার কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী— সবাই আলাদা। আমরা বন্ধুরাই ছিলাম দায়িত্বে। কী যে মজা হয়েছিল সেই বছর! এখনকার ব্যস্ত রুটিনের পাশে সে সব অনাড়ম্বর আনন্দের দিন বড় বেমানান।
গানে আমার তখনও বিশেষ আগ্রহ জন্মায়নি, রীতিমতো ধরে বেঁধে আমায় গান করাতে হত। এমএসসি পাশ করলাম যখন, তার পরে আমার আর কিছু করার ছিল না। মা বললেন, ‘‘হয় গান করো, না হলে বিয়ে।’’ সেই যে আমি গানে আক্ষরিক অর্থেই আশ্রয় নিলাম, এখনও সেই ছায়াতেই জীবনযাপন। পরে অবশ্য আরও এক বার মা এই প্রশ্নের মুখে আমায় ঠেলে দিয়েছিলেন। এক সময় আমি একটি পত্রিকায় কাজ করতাম। তার পর সেটি উঠে গেল। মানে এমন চাকরি করলাম যে, পত্রিকাই উঠে গেল! তখন দ্বিতীয় বার মা আমাকে বললেন, ‘‘হয় গান করো, না হলে বিয়ে।’’ উত্তরটা আমার কাছে খুব সহজ ছিল। তার পর থেকে তো রবীন্দ্রনাথের গানই ঘর-বাড়ি-আশ্রয়। পুজোর সময়ও তো কেটে যায় এখন বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে। ছোট থেকেই অবশ্য তাই। শুধু তফাৎ হল, তখন অনুষ্ঠান ছিল মায়ের, এখন আমার।
গানের জন্য হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াতে হত বটে, তবে মা আমার একেবারে আটপৌরে মা। পুজোর সময়ে অনুষ্ঠান করতে মায়ের ডাক পড়ত কখনও দিল্লি তো কখনও মুম্বই। সঙ্গে যেতেন মায়া সেন, অশোকতরু বন্দ্যেপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধ শিল্পীরা। আর লেজুড় হিসেবে আমরা তো ছিলামই। সবাই মিলে হইহই করে যাওয়ার আনন্দে ছিল এক আশ্চর্য পূর্ণতা। তখন সদ্য সদ্য রাজধানী এক্সপ্রেস চালু হয়েছে। প্রথম দিকককার সেই রাজধানী এক্সপ্রেসে স্লিপার কামরা ছিল না, তখন ছিল এসি চেয়ার কার। দিল্লি পৌঁছে সদলবলে উঠতাম একটি গেস্ট হাউসে। রাতে শোয়া হত ক্যাম্প খাটে। তবে মা কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও অন্যান্য ধারার গানের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের সঙ্গেও মায়ের এক অপূর্ব হৃদ্যতা ছিল। বনশ্রী সেনগুপ্ত, নির্মলা মিশ্র নিয়মিত আসতেন আমাদের বাড়ি, গানের আসর হত। যা আমায় ভীষণ নাড়া দিত, তা হল সকলের জন্য সকলের এক অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। কোনও অনুষ্ঠানে মায়ের সঙ্গে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গান থাকলে দেখেছি নিজের গান হয়ে গেলেও মায়ের গান শুনে তবেই মানবকাকা উঠতেন।
তখন দিল্লিতে গুটিকয় পুজো হত, এখনকার মতো এত পুজোর চল ছিল না। কালীবাড়ির পুজো ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত, সেখানে অনেক খ্যাতনামা শিল্পী গাইতেন। মনে পড়ে, এক বার দিল্লি থেকে মুসৌরি বেড়াতে গেলাম সবাই। তখন আমি বেশ ছোট— চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণি হবে। আর এক বছর ছিল দিদির বিয়ে। সেটা ছিল ১৯৭০-এর দশক। সে বার আমরা রীতিমতো বাজার-হাট করে ফিরলাম। একই সঙ্গে সেই বছর দুই উৎসবের আনন্দ, তাই উৎসাহও দ্বিগুণ!
গান শেখা বা পেশা হিসেবে বাছার কৃতিত্বের পুরোভাগে যদি মা থাকেন, তবে অন্য দিকে গান শোনানোর কৃতিত্ব পুরোটাই বাবার। নিজে গান না শিখলেও, সব ধরনের গান শোনার ব্যাপারে বাবা ছিলেন দারুণ উৎসাহী। বলা যায়, আমাদের সকলের গানের উৎসই ছিলেন বাবা। এই নিয়ে এক মজার স্মৃতিও আছে। আমাদের মেয়েবেলায় পুজোর বিরাট আকর্ষণ ছিল নতুন রেকর্ড। মনে আছে, বাবা প্রতি বার ভাইফোঁটায় পুজোর যাবতীয় বাংলা গানের পশরা নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। কিন্তু সেই উপহার ছিল শর্তসাপেক্ষ— শর্ত হল, পরের দিন সেই গানগুলি দিদিকে তুলে শোনাতে হবে। বাবা শুনবেন। দিদিও লক্ষ্মীটির মতো বছর বছর সেই শর্ত মেনে পরের দিনই শুনিয়ে দিতেন পুজোর নতুন গান।
এখন আর কোথায় সে সব! হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেলাম। আমি বরাবর খুব একা। অবশ্য পৃথিবীতে সব শিল্পীই একা। শিল্পী মাত্রেই যে একা! যাদের সঙ্গে রাত জেগে কাটাতাম পুজোর দিনগুলো, তারা আজ এত বড় পৃথিবীর এ দিক সে দিক ছড়িয়ে আছে। তবু, এই আজব দুনিয়ার সাংঘাতিক দ্রুততার যাপনে আমাদের সেই বাঁধনছাড়া পাগলপারা দিনের মৃদু ঢেউ এখনও এসে পড়ে পুজো এলেই। মন খারাপ হয়। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়, রইল না, রইল না...