আমাদের ছোটবেলায় ছিল একই মূর্তি, তবু নতুন করে আনন্দ প্রতি বছর।
এই সময়ে একটা অদ্ভুত বদল হয় চারপাশে। বর্ষার পাট চুকিয়ে ধীরে ধীরে ধূসর বর্ণ থেকে ঝলমলে নীল হয়ে ওঠে আকাশ। তাতে পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। এই পরিবর্তনটা এলেই বুঝি, পুজো কড়া নাড়ছে। আমার কাছে পুজো মানে তাই ছাইরঙা আকাশের নীল রঙে সেজে ওঠা। প্রতি বছর তার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকি। এ বছর খাতায় কলমে শরৎ আসার পরেও আকাশ ছিল মেঘলা। আশ্বিনের শারদপ্রাতেও ছিল ঘূর্ণাবর্তের আশঙ্কা। তাই প্রায় রোজই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতাম নীল আকাশের আশায়। যে দিন রোদ উঠল, সে দিন যে কী আনন্দ! ব়ড় হয়ে গেলাম, পরিচিতি হল, মা হলাম— তবু এই এক আনন্দ এখনও আদি-অকৃত্রিম।
আমার বড় হওয়া সল্ট লেকে। আমাদের ব্লকের পুজোয় ছোট থেকেই দেখেছি টানা টানা চোখের সাবেক মাতৃমূর্তি, ডাকের সাজ, একচালার প্রতিমা। থিমের এতটা বাড়াবাড়ি আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়ে ছিল না। একই মূর্তি, তবু নতুন করে আনন্দ প্রতি বছর। গান শেখার সুবাদে প্রতি বার সপ্তমীতে পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার গান ছিল বাঁধা। পুজোর আগে তাই বেশ খেয়াল রেখে গলার যত্ন নেওয়া— গান যেন খারাপ না হয়! অনুষ্ঠানের মহড়া হত আমাদের বাড়িতেই। তাই পুজোর বেশ কিছু দিন আগে থেকে দলবেঁধে প্রস্তুতি, মজা, হই-হুল্লোড়! পুজোর চার দিন তাই কলকাতাতেই থেকেছি বরাবর। এই সময়টা নিজের শহর ছাড়া এখনও ভাবতেই পারি না। সবচেয়ে ভাল লাগে আগমনীর এই সময়টা। রাস্তা মুড়ে যায় পুজোর হোর্ডিংয়ে, চার দিকে বেশ কিছু দিন আগে থেকে সাজ সাজ রব— এ কি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও মিলবে? পুজো যে এ শহরের প্রাণ!
ভিড় অবশ্য আমায় টানেনি কখনও। আর সত্যি বলতে পাড়ার পুজোয় সকলে একাত্ম হওয়ার যে আনন্দ আমি ছোট থেকে পেয়েছি, তাতে অন্য কোথাও গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঠাকুর দেখার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। অষ্টমীর অঞ্জলি থেকে সন্ধিপুজো— আমার পুজো মানে ব্লকের পুজো। সকাল থেকে চার দিনই পড়ে থাকতাম মণ্ডপে। রাতটুকু কেবল যে যার বাড়িতে ঘুম, ক্ষণিকের বিরতি। বাড়ির পুজোর মতোই হয়ে গিয়েছিল ব্লকের এই পুজো। মণ্ডপের সামনে চেয়ারে সবাই মিলে বসে আড্ডা, নতুন জামা (পারলে এ বেলা, ও বেলা), ঠাকুরের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা, তাকিয়েই থাকা... এ বিস্ময় ফুরানোর নয়!
ইদানীং যেখানেই যাই, আমার পরিচিতি যায় সঙ্গে। পুজোয় নির্বিঘ্নে ঘোরাঘুরি হয়ে ওঠে না আর। ২০১৯-এর কথা। তখন আমি ‘ফাগুন বউ’ ধারাবাহিকে। সে বছর হঠাৎ ইচ্ছে হল ঠাকুর দেখার। এ দিকে, ভিড়ে গেলে সকলে তাকিয়ে থাকে, বড্ড অস্বস্তি হয়। হঠাৎই রাজা (আমার বর) এসে বলল, এক ফুটবল দল আয়োজিত শারদ সম্মানে আমাদের দু’জনেরই ডাক পড়েছে বিচারক হিসেবে। ওরাই ৩৫টা প্রতিমা দেখাবে চতুর্থীর রাতে। ব্যস! মেঘ না চাইতেই জল! মাকে মনে মনে বললাম, তবে তুমি আমার কথা শুনেছ! সন্ধে ৭টায় বেরিয়ে সে বার ফিরেছিলাম ভোর ৪-টেয়। সারা জীবনেও এত ঠাকুর আমি দেখিনি!
আর পুজোর উত্তেজনার মধ্যেই ছিল আমাদের প্রেম। দারুণ রোমাঞ্চ তাতে! আমি আর রাজা দু’জনেই খেতে খুব ভালবাসি। আমাদের এক বাঁধাধরা চিনে রেস্তোঁরা আছে। সেখানেই আমরা খেতে যাই। সারা বছর খাওয়াদাওয়ায় হাজার কড়াকড়ি। পুজোর ক’দিন সব মাফ! যা প্রাণে চায়, খাই।
এ বছর অবশ্য খানিক আলাদা। এ বছর যে আমি মা। অতিমারির মধ্যেই ছেলে কেশবের প্রথম পুজো। ও এখনও স্তন্যপান করে। তাই অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় আমাকে। সব সময় মাথায় থাকে, কেশবের যেন কোনও সমস্যা না হয়। বাড়িতেই অনেকটা সময় কাটবে বলে অনেক পূজাবার্ষিকী কিনেছি এ বছর। সেগুলো পড়ব। কেশবের জন্যই প্রচুর ছড়া মুখস্থ করেছি। সেগুলো রোজ ওকে শোনাব। এ বার পুজো কাটবে ওকে ঘিরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy