ন্যাশভিলের দুর্গা প্রতিমা।— ছবি: রূপায়ণ পাল।
পুজো চলে এল। এক বছর বাদে আবার আমাদের বাক্সবন্দিনী দুর্গা প্রতি বারের মতো এ বারও তিন দিনের জন্য মণ্ডপবাসিনী হবেন, সপরিবার। আমাদের শহরের গণেশ মন্দিরে কুমোরটুলিতে নির্মিত এই দেবী দুর্গার আরাধনা হয়। তার প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। বৃহত্তর ন্যাশভিলে বাঙালি সঙ্ঘ (বিএজিএন)-এর সভাপতি অশোক সাহার নেতৃত্বে আমরা পুজোর কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছি। পুজোর জিনিসপত্র আর সাজসজ্জার উপকরণের বাজারহাট শুরু হয়ে গেছে।
পুজো মানেই প্রকাশিত হবে আমাদের বিএজিএন-এর বার্ষিক মুখপত্র ‘আগমনী’। সব লেখা ও ছবি জমা পড়ে গেছে। শেষ মুহূর্তের সম্পাদনা চলছে। বিজ্ঞাপনও তৈরি। ছাপাখানায় গেল বলে। এত দিন গোপন ছিল, এ বার চুপি চুপি জানাই, এ বার কলকাতা থেকে ঢাক কিনে আনা হয়েছে। এ সব ব্যবস্থা করে প্রতি বছর একটা করে নতুন চমক দেয় আরতি বউদি। তারই নিখুঁত পরিকল্পনায় ন্যাশভিলের পুজোয় আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিষ্টি আসে ডাকযোগে। সঙ্গে আসে তাজা ১০৮টি নীলপদ্ম। এবং জানিয়ে রাখি, ওই সোনাবউদির শাড়ির আঁচল থেকেই বিভিন্ন রোমান্টিক মুহূর্তে বেরিয়ে আসে মিঠাপাতা পান, চুন, সুপারি, ১২০ জর্দা আর চ্যবনবাহার! বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ন্যাশভিলের সব মহিলার এ বার পুজোয় কমপক্ষে তিনটি করে শাড়ি হয়েছে, তার বেশির ভাগই কলকাতা ও বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা।
কে না জানে যে, পুজোয় বঙ্গজীবনের দুই অঙ্গ হল খাওয়াদাওয়া আর সংস্কৃতি। রান্নাঘরের পরিকল্পনা এখন অন্তিম পর্যায়ে। আহা, এই কথা উঠলেই নাকে ভেসে আসে খিচুড়ি, পায়েস, বেগুনি, মেশানো তরকারি, বাঁধাকপি বা ফুলকপির তরকারি, মুগডাল, আলু ভাজা আর সাদা বাসমতী ভাতের গন্ধ। আর পুজোর ভোগে লুচি ও সুজি তো আছেই। আর মায়ের প্রসাদ বলতে সেই সুস্বাদু চালমাখা আর ফলাহার। জানিয়ে রাখি, ন্যাশভিলে পুজোর ক’দিন কিন্তু রান্নাঘরে পুরো স্ত্রীভূমিকা বর্জিত আয়োজন। রান্নাবান্না থেকে পরিবেশন, সব কঠোর ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের দখলে। রসের কথা আর জিভে জল আনা রান্না চলে একসঙ্গে। আকর্ষণ আরও বাড়ানোর জন্য রান্নাঘরের ফ্রন্ট ডেস্কে অবশ্য অনেকটা মডেলের স্টাইলে সুন্দরী মহিলাদের আপ্যায়নের কাজে নিয়োগ করা হয়।
আরও পড়ুন: ধুনুচি নাচ, ঢাক, আরতি, সবই আছে টিনটিনের দেশে
আরও পড়ুন: পুজোয় ম্যাডক্স, বাগবাজারের আমেজ বোর্নমাউথে
আর সংস্কৃতি! দফতরের মন্ত্রী সুস্মিতার এখন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। ছোট-বড় সকলে নাচ গান বাজনা কবিতার সম্ভার নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। এই তো সে দিন দেখলাম, জোরকদমে মহড়া দিয়ে বেরোচ্ছে সোনিয়া, সুমিতা, পরমা, সুদক্ষিণা, মহাশ্বেতা, শাশ্বতী, দেবশ্রীরা। পিছু পিছু লগ্নজিতা, সুতপা, শুভজিত, শুভম, রূপায়ণকেও দেখলাম। দুই দিনব্যাপী কালচারাল ধামাকা। ন্যাশভিলে পুজো এ বার ১২ থেকে ১৪ অক্টোবর, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার বিকেল পর্যন্ত। আর বৃহস্পতিবারকেও পুজোর মধ্যে ধরা উচিত, কারণ ওই দিন সন্ধ্যায় মণ্ডপসজ্জার কাজ হয় নৈশভোজ সহযোগে। আবহে বীরেন ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর মহিলা মহলে পুজোর মালা গাঁথা! এ বার আমাদের শুক্রবারের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার বিশেষ আকর্ষণ, নানা রকম গানের ডালা নিয়ে হাজির হচ্ছেন ‘সা রে গা মা পা’ খ্যাত সৌমেন নন্দী। আর শনিবারের রাতের সেরা চমক স্থানীয় শিল্পী সমন্বয়ে নাটক। এই নাটককে ঘিরে শহর জুড়ে এখন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা চলছে। কী নাটক, কারা তার অংশগ্রহণকারী, এ ব্যাপারে সব্বাই স্পিকটি নট! পুজো কমিটি শুধু বলছে, সবুর করুন, মেওয়া পাবেন!
পরিশেষে জানাই, শুধু পুজো কেন, বাঙালির কোনও উৎসব অনুষ্ঠানই সম্পূর্ণ হয় না আড্ডার মোড়ক ছাড়া। আমাদের পুজোর সব চেয়ে হিট ইভেন্টও হল সেটাই, অষ্টপ্রহর টানা আড্ডা। গভীর রাতটুকু ছাড়া পুজোর ক’দিন মণ্ডপ থেকে নট নড়নচড়ন। কাজ তো কাজ। আড্ডা তো আড্ডা। রবিবার দুপুরে শোভাযাত্রা সহকারে বিসর্জন, আমরা বলি বাক্সরজন! কারণ, আবার এক বছরের জন্য বাক্সে ঢুকে পড়বেন মা দুর্গা। ঠিক তার আগে দোলযাত্রার ঘরানায় সিঁদুরখেলা আমাদের পুজোকে অন্য মাত্রা দেয়। সবশেষে বসে প্রতিযোগিতার আসর, শঙ্খধ্বনি এবং উলুধ্বনির লড়াই, এক্কেবারে রিয়েলিটি শোয়ের কায়দায়। অবশেষে সন্ধ্যা নামে, সব বাঙালি ঘরে ফিরে যায়। পরের দিন, সারা দিন সোমবার। বাঙালি আবার ‘আমেরিকান ভব’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy