ক্যানবেরায় দুর্গাপুজো: প্রবাসে বাঙালির মিলেমিশে থাকার অঙ্গীকার।
ক্যানবেরার পুজো। ক্যানবেরা কোথায়, কোন দেশে তাই তো অনেকেই জানেন না।
ক্যানবেরা অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের রাজধানী। চার লক্ষ লোকের একখানি বেশ ছিমছাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর শহর। রাজধানী বলেই এখানে বহু সংস্কৃতির মানুষের বাস। আর তারই মধ্যে দু’শো ছুঁই ছুঁই বাঙালিদের এই দুর্গা পুজো। ভাবা যায়! কথায় বলে তিন জন সাহেব এক জায়গায় হলে একটি ক্লাব গড়ে। তো একমুঠো বাঙালি একসঙ্গে হলে দুর্গাপুজো করে। আমরাও সেই একমুঠো বাঙালির সময় থেকে আজ প্রায় কুড়ি বছর ধরে এই পুজো করে আসছি।
উত্তর ক্যানবেরার ‘হিন্দু মন্দির-এ আমাদের এ বারের পুজো। মন্দির খালি পাওয়া সহজ নয়। প্রায় এক বছর আগে থেকে নাম লিখিয়ে মানে ‘বুক’ করে রাখতে হয়। পুজোর কাছাকাছি সময়ে সপ্তাহান্তে এ বারে আমাদের পুজো ১৩ ও ১৪ অক্টোবর।
আরও পড়ুন: মার্বেলের মেঝে? এ ভাবে যত্ন নিলে নতুনের মতো দেখাবে
মাস চারেক আগে থেকে শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা, মিটিং, আলোচনা। পুজো তো শুধু অঞ্জলি দেওয়া নয় — আরও অনেক কিছুই আমরা করি এই দু’দিনে। ছোটোদের বসে আঁকো, মা বাবাদের ফ্যাশন প্যারেড, শঙ্খ বাদন, ধুনুচি নাচ সবই তো আছে। দায়িত্ব ভাগ করা হয়ে গেছে কে কী সঞ্চালনা করবেন।
পুজোর অনেক আগে থেকেই যেটা শুরু হয়ে যায় তা হল লেখালেখি, আঁকাআঁকি। প্রতি বছর পুজোর সময় প্রকাশিত হয় আমাদের পত্রিকা ‘উৎসব’। এতে পাঁচ বছরের আঁকা থেকে আশি বছরের জীবনদর্শন সবই স্থান পায়। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি তিন ভাষাতেই লেখা চলে। দুর্গাপুজো তো বিশ্বজনীন আর বাঙালি অ-ভারতীয় পুত্র কন্যাদের কাছে মাতৃভূমির সাথে যোগাযোগের এ এক চমৎকার সূত্র। ছাপার অক্ষরে নিজেদের নাম দেখার উত্তেজনাও তো কম নয়।
আছে বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন, যা হচ্ছে পরের সপ্তাহান্তে। এর উত্তেজনা বড় ঢেউয়ের মত সবসময় তুঙ্গে। কচিকাঁচারা সলিল চৌধুরীর ‘একানড়ে’ নিয়ে মহা ব্যস্ত। মাঝারিরা আনন্দশঙ্করের সুরের সাথে মহড়া দিচ্ছে জোর কদমে। মায়েরা শুভা মুদগলের ‘মথুরা নগরপতি’র সাথে “গুরু ব্রহ্মা” জুড়ে, কত্থক, ভারতনাট্যম মিলিয়ে মিশিয়ে নাচের প্রস্তুতিতে ডুবে আছে। এ বারে রাবণ রাজাও আছেন তাই বাবাদেরও ডাক পড়েছে। পোষাক জোগাড়,গয়না জোগাড়, ক’টা কাঁটা, ক’টা সেফ্টিপিন, এক্কেবারে দম ফেলবার সময় নেই।
আরও পড়ুন: ডেট্রয়েটের প্রযুক্তিবিদেরাই মায়ের জন্য গড়ছেন রাজবাড়ির ঠাকুরদালান
ইতিমধ্যে দল ভাগ হয়েছে। কারা যাবেন মাকে গুদাম ঘর থেকে নিয়ে আসতে, যেখানে সারা বছর মা থাকেন অতি যত্নে কিন্তু বাক্সবন্দি হয়ে। মাকে আনতে চাই একটি ছোট ট্রাক বা ইয়ুট। ভাড়া করা হয়েছে সেটা। কারা কারা মন্দিরে থাকবেন, সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। মাকে নামাবার সময় তো অনেক লোক দরকার। তারপর মাকে আগে থেকে তৈরি কাঠের ফ্রেমে সাবধানে বসাতেও হবে। । মা দু’দিন ধরে থাকবেন তো সেখানে।
এইখানে বলে রাখি আমরা প্রতি বছর তো আর দেশের মত প্রতিমা বিসর্জন দিতে পারি না। এই দেশে নদীর জলে কিছু ফেলা গুরুতর অপরাধ। তা ছাড়া দেশ থেকে বারবার প্রতিমা আনাও অসম্ভব। তাই পুরনো মাকেই আমরা বারবার নতুন করে তুলি। মা কি সত্যি করে পুরনো হন? মা তো মা-ই!
কারা কারা আসবেন মালা গাঁথতে কথাবার্তা চলছে। খোঁজ করা হচ্ছে কার বাড়িতে পুজোর সময় ফুল পাওয়ার সম্ভাবনা। ব্যবস্থা তো করে রাখতে হবে আগে থেকে। পুজোর আগের দিন মাঝরাত অবধি চলবে মালা গাঁথা আর মণ্ডপ সাজানো।
আরও পড়ুন:‘সুইসপুজো’ মন টেনে নিয়ে যাচ্ছে বেহালা নতুন দলের সেই দিনগুলোয়
বাঙালি বিদেশে থাকলেও পুজোর সময় খিচুড়ি লাবড়ার জন্য মন কেমন করবেই। তাই রান্না করতে হবে অনেক লোকের। তার জন্য বাজারটা দু’দিন আগেই সেরে রাখতে হবে। উৎসাহীরা জোট বাঁধছেন, আলোচনা চলছে কারা কারা এ বার বাজার করতে যাবেন।
এর পর পুজোর রান্না। প্রসাদের পর দুপুরের খাওয়া দাওয়া দু’দিন ধরেই হবে। কারা প্রসাদ বানাবেন, কারা মিষ্টি বানাবেন, কারা ভোর থেকে এসে পুজোর ফল, রান্নার সব্জি কাটবেন, কারা রান্না করবেন সব দল ভাগ হয়েছে। মন্দিরে বেশ ভাল রান্নার ব্যবস্থাও আছে। পরিবেশনটা সাধারণত মহিলারাই করেন। তাঁরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে রাখছেন।
প্রথম দিন পুজোর পর থাকে নাচ গান খাওয়া দাওয়া নিয়ে জমজমাট সান্ধ্য পর্ব। এটার জন্য আলাদা হলের ব্যবস্থা করতে হয়। এই পর্বের খাবার আসবে বাইরে থেকে। সেটা বারবার খোঁজ নিতে হচ্ছে, ক’জন আসবেন, নিরামিষ ক’জন ইত্যাদি ইত্যাদি। আর গানের ব্যবস্থা, মজার মজার খেলার ব্যবস্থা কাউকে তো দেখতেই হবে।
দ্বিতীয় দিনেই হয়ে যাবে বিসজর্ন। মা কে আবার যত্ন করে কাঠের বাক্সে পুরে নিয়ে যেতে হবে।কারা যাবেন এ যাত্রায়, তা ঠিক করা হচ্ছে। মায়ের বরণ সেরে আমরা যখন সিঁদুর খেলব আর কপালে লাগাব টিকা তখন একদল কাজ শুরু করে দেবেন মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।
পুজোর আগেই এসবের তালিকা করে ফেলা হচ্ছে। অনেকেই একাধিক কাজের দায়িত্বে আছেন। ব্যবস্থা করছেন হাসিমুখে। আরেকটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। আগামী বছরের পুজোর জন্য মন্দিরে বলে রাখা। সেটা দিয়েই শুরু হয়ে যাবে পরের পুজোর প্রস্তুতি।
ছবি: পুজো কমিটির সৌজন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy