ক্যালিফোর্নিয়ার পুজো।
আর মাত্র কয়েক দিন। মা আসছেন। চলছে প্রস্তুতি, জোর কদমে।
চারিদিকে বাজছে আগমনীর সুর। উৎসবের রং লাগছে শহরে, গ্রামে। হাওয়ায় পুজোর গন্ধ। পাড়ার ক্লাবগুলোতে শুরু হয়ে গেছে প্যান্ডেলের কাজ। তরুছায়া ক্লাবে এ বারের থিম কৈলাসে মা, আবার সবুজ সংঘ ক্লাবে এ বারের থিম বর্তমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মায়ের রূপ।
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সাজসজ্জা শেষের দিকে। কুমোর-তুলিতে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আত্মীয় পরিজনদের ঘরে ফেরার পালা। তিলোত্তমা সেজে উঠেছে তার আপন ছন্দে।
আর কলকাতায় বড় হয়ে ওঠা বলেই বাংলা ক্যালেন্ডার হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মিলিয়ে নিই পুজোর পাঁচটা দিনে মায়ের অবস্থানকে। মা আসছেন, তাই জামাকাপড়ের দোকানগুলোতে চলছে জামাকাপড় কেনার ভিড়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেজে উঠেছে ছোট ছোট বাজির দোকানগুলোও। বাঙালির পুজো মানেই এই ক’টা দিন একটু উৎসবে মেতে ওঠা, সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। শুধু বদলে যায় পুজোর ধরন।
তবে, প্রবাসীদের কাছে এই ছবিটা একটু অন্য। যেখানে থাকে না থিম পুজো। থাকে না লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখার মজা। সেই সঙ্গে নেই মায়ের প্রতিমা বিসর্জনের পালা, শিউলি ফুলের সুবাস। পুজো হয় কিন্তু সপ্তাহান্তে কোনও স্কুলের আউডিটোরিয়ামে। এক ছাদের তলায়। এ বারের পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে জোরকদমে প্রবাসেও। সমস্ত কমিটির সদস্যরা ব্যস্ত তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্বে। পুজোমণ্ডপ কেমন ভাবে সাজানো হবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ— তার সময়সূচি ঠিক করা। সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে আসা অতিথি-শিল্পীদের কোথায় রাখা হবে এবং এ বারের খাওয়াদাওয়ার মেনুতে কী কী থাকবে সেই নিয়ে চলছে কমিউনিটিগুলির শেষ পর্যায়ের কার্যক্রম।
আরও পড়ুন: মাত্র দু’শো বাঙালির ক্যানবেরায় পুজো প্রায় দুই দশকের
আরও পড়ুন: ডেট্রয়েটের প্রযুক্তিবিদেরাই মায়ের জন্য গড়ছেন রাজবাড়ির ঠাকুরদালান
প্রবাসী বাঙালি অন্তরা চট্টোপাধ্যায়। জন্মসূত্রেই আমেরিকাতে। টেক্সাসের অ্যালেন শহরে তাঁর বাড়ি। ছোটবেলা থেকে এখানেই বেড়ে ওঠা। বাবা-মা কলকাতায় কোনও একটা সময়ে ছিলেন, তাই বলা যেতে পারে কলকাতাতেই তাঁর পৈতৃকভিটে। খুব ছোটবেলায় কলকাতাতে এক-দু’বার যাওয়া হয়েছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে পুজোর সময়ে। এখন কিছুই মনে নেই তাঁর। তবে তাঁদের কাছে এক সময়ে শুনেছেন কলকাতার পুজোর ব্যাপারে। এখন অন্তরার কাছে পুজো মানে টেক্সাসের বাঙালি কমিউনিটির ডিএফডাব্লিউ-এর দুর্গাপুজো। দশ বছর ধরে তিনি এবং তার পরিবার এই পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া আন্তরিক নামের আরও একটি বাঙালি কমিউনিটির পুজো এখানে বিশেষ গুরুত্ব পায়।
কিন্তু, অন্তরা ডিএফডাব্লিউ-এর পুজোতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। সপ্তাহান্তে দু’-তিন দিন ধরে প্রবাসের দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠী, সপ্তমী এক দিনে, আবার অষ্টমী-নবমী এক দিনে, আর একটা দিন শুধু বিজয়ার পুজো। সেই সঙ্গে সিঁদুর খেলা। শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে রবিবারে শেষ। সারা বছর ধরে এখানকার প্রবাসী বাঙালিরা এই ক’টা দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। যদিও ক্যালেন্ডারে দিন ক্ষণ দেখে প্রবাসের পুজো বিশেষ হয় না। তবুও অন্তরার মতো প্রবাসের বাঙালিরা অষ্টমী পুজোর অঞ্জলি কখনও ছাড়েন না।
আমেরিকার অন্য পুজো কমিটিরগুলির মধ্যে অন্যতম হিউস্টনের দুর্গাবাড়ির পুজো, ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণী বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো ও ভারত সেবাশ্রমের পুজো। এ ছাড়াও রয়েছে জর্জিয়া আটলান্টার পূজারী-র পুজো। এর মধ্যে ভারত সেবাশ্রমের পুজো বিশেষ গুরুত্ব পায় প্রবাসী বাঙালির কাছে। কারণ, এদের পুজো দিনের দিনই হয়। কলকাতার পুজোর মতো এখানে বাজি, লাইটিং, বাঁশের প্যান্ডেল না থাকলেও খুব সুষ্ঠু ভাবে এবং নিয়ম মেনে পুজো সম্পন্ন করে এখানকার পুজো কমিউনিটিগুলি। চাঁদা তোলার রীতি নেই। কিন্তু, পুজোর খরচের জন্য ন্যূনতম একটা টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। ওই টিকিট কেটেই তিন দিনের পুজোতে অংশগ্রহণ করেন সমস্ত বাঙালিরা।
প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের আগমন ঘটে এই দুর্গাপুজোতে। যদিও দুর্গাপুজো তাঁদের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তাও এই ক’টা দিন তাঁরাও মিশে যান দুর্গা উৎসবের আনন্দে। সপ্তাহান্তের আমোদপ্রমোদ কার না ভাল লাগে। তাই তাঁরাও এই সুযোগ হাতছাড়া করেন না। পুষ্পাঞ্জলি, পূজা, প্রসাদ বিতরণ থেকে শুরু করে বাঙালি সম্প্রদায়ের নানান রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এই দু’দিনব্যাপী। এখানেও কলকাতার মতো অতিথি শিল্পীদের নিয়ে আসার একটা রেওয়াজ রয়েছে।
এ বারের পুজোর বিশেষ অতিথি শিল্পী— ক্যালিফোর্নিয়া দক্ষিণীতে প্রথম দিনে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি আর দ্বিতীয় দিনে মেখলা। টেক্সাসের বিএ-ডিএফডাবলুতে প্রথম দিন আসছেন বাংলার রাঘব চট্টোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় দিনে মহালক্ষ্মী আইয়ার। আটলান্টার পূজারীতে আসছেন বাংলার শুভমিতা এবং পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মতো বিশিষ্ট শিল্পীরা। এ ছাড়াও কমিটির উদ্যোক্তারাও নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন। সেই সঙ্গে রয়েছে বাঙালির লোভনীয় খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। অষ্টমীতে মায়ের বিশেষ খিচুড়ি ভোগ। দুর্গাপুজো মানেই পেটপুজো। ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণীর মেনু এ বারও সুপার হিট। শুক্রবারের রাতে জাফরানি পোলাও, আলুর দাম, চিকেন কষা, আনারসের চাটনি, শাহী পনির, ক্ষীর কদম্ব। শনিবারের দুপুরে রয়েছে খিচুড়ি, ড্রাই মিক্সড ভেজ, বেগুনি, আমের চাটনি, গুলাব জামুন। আর রাতে রয়েছে বাঙালির বিশেষ প্রিয় মাটন বিরিয়ানি, ভেজ কাটলেট, রায়তা, রসগোল্লা, ভেজ বিরিয়ানি। দক্ষিণীর মতো অন্যান্য বাঙালি কমিউনিটিগুলিও তাদের খাবারের মেনুতে বিশেষ আয়োজন রেখেছেন এ বারে।
প্রায় দশ-বারো বছরের পুরনো দুর্গাপ্রতিমাতেই প্রত্যেক বারের পুজো সম্পন্ন করা হয় এই কমিউনিটিগুলিতে। পুজো শেষে আবার প্রতিমাটিকে বক্সে বা স্টোরে রুমে সংরক্ষিত করে রাখা হয় পরের বছরের জন্য। নির্ধারিত এক জন পুরোহিত থাকেন, যিনি বহু বছর ধরে পুজো করে আসছেন। পুজো শুরুর প্রথম দিনই স্টোর রুম থেকে মাকে আনা হয় মণ্ডপে। পুজোর শেষ দিনটা খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করা হয়। সকালের পুজো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহিলারা বরণ ডালা নিয়ে উপস্থিত থাকেন মাকে বরণ করতে। তবে বরণের পদ্ধতিটা একটু আলাদা। যে হেতু পরের বছর একই মূর্তিতে পুজো করা হবে, তাই বরণডালা পুরোহিতের হাতে তুলে দেন মহিলারা।
পুরোহিত সেই বরণডালা মায়ের মূর্তিতে ছুঁয়ে যাঁর যাঁর হাতে দিয়ে দেন। এর পর চলে সিঁদুর খেলার পালা। একে অপরকে সিঁদুর মাখানো শেষ হলে শুরু হয় ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ। ঢাকির ভূমিকায় অংশ নেন কমিটির কর্মকর্তারাই। মহিলারাও ধুনুচি নাচের সঙ্গে মেতে ওঠেন বিজয়ার নাচে। এই ভাবে চলে কিছু ক্ষণ। চলে নানান ধরনোর ফোটো তোলার পালা। সিঁদুরের লাল রঙে সকলের মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।
পুজোও শেষ। শেষ ছুটিও। সোম বার থেকে আবার অফিস আর স্কুল। একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ানোর পাশাপাশি বলতে থাকেন, ‘'আসছে বছর আবার হবে’।
ছবি: পুজো উদ্যোক্তাদের সৌজন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy