জোহানেসবার্গের দুর্গাপ্রতিমা। ছবি: প্রতিবেদক।
দক্ষিণ গোলার্ধের সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্গাপুজো আসে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে। এখানে আশ্বিনের নীল আকাশ আছে। তার সঙ্গে রয়েছে বসন্ত সমীরণও। সাদা কাশফুলের ঢেউ নেই। তার বদলে রয়েছে বেগুনি জাকারান্ডার সমাহার। এই আবহেই জোহানেসবার্গে মা দুর্গার আগমন।
যাঁরা প্রবাসে থাকেন, তাঁরা নিজেদের রীতি-রেওয়াজ-সংস্কৃতি-ভাষাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চান। যেমন পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে আসা দুই বাঙালি তাই দেখা হলেই বলেন, ‘‘আপনি বাঙালি? আমিও তাই।” এই পরিচয়টুকু অচিরেই অচেনা, অজানা মানুষকে আপন করে নেয়। এই আবেগ থেকেই এ-পার বাংলা, ও-পার বাংলার জোহানেসবার্গবাসী বঙ্গসন্তানেরা মিলে ২০০৫ সালে তৈরি করেছিলেন ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ আফ্রিকা (বাসা)’। সেই ‘বাসা’র ছত্রচ্ছায়ায় এখানকার বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারা বছর ধরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব লেগেই থাকে ‘বাসা’য়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্যিক রাজধানী হল জো’বার্গ। কর্মসূত্রে প্রচুর বাঙালির বসবাস। ‘বাসা’র সদস্য সংখ্যাও প্রায় আড়াইশো। বছরের এই সময়টায় সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পুজোর প্রস্তুতিতে। আমাদের পুজোর জন্য অর্থ সাহায্য আসে ভারতীয় কনস্যুলেট ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ধর্ম নির্বিশেষে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী, যেমন মাছ বিক্রেতা, তরকারি বিক্রেতা, দর্জি বা সেলুন মালিকেরা যে যাঁর মতো করে সাহায্য করেন। আর সব কিছুর উপরে তো ‘বাসা’র সদস্যরা রয়েছেনই।
আরও পড়ুন: বাঙালিদের ভোগের খিচুড়ি সাহেবদেরও বড় প্রিয়
আরও পড়ুন: কুংফু-র দেশে মহিষাসুরমর্দিনীর বন্দনা
সকলে যাতে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন, তার জন্য আমরা সপ্তাহান্তেই পুজোর আয়োজন করি। এ বছর ১৯ অক্টোবর, শুক্রবার, মহাষষ্ঠী ও মহাসপ্তমীর পুজো হবে। শনিবার হবে মহাষ্টমীর পুজো, পুষ্পাঞ্জলি এবং সন্ধিপুজো। আর রবিবার মহানবমীর পুজো, মহাযজ্ঞ, দশমীর পুজো, সিঁদুর খেলা, দেবীবরণ এবং বিসর্জন। পুজোর মণ্ডপ সেজে উঠবে মার্লবোরো কমিউনিটি সেন্টারে।
আমাদের দুর্গাপ্রতিমা আসে কুমোরটুলি থেকে। পূজারিও আসেন কলকাতা থেকে। সেই ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত তিনিই আমাদের পুজো করছেন। দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো সেরে একেবারে দেশে ফেরেন তিনি। ভোগ তৈরি করা ও নানাবিধ পুজোর কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সারেন গৃহিনীরা।
এ বছর সপ্তমীর সন্ধ্যারতি ও ধুনুচি নাচের পরে বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আগমনী গান দিয়ে শুরু করে সেই অনুষ্ঠান শেষ হবে হাস্যকৌতুক নাটক দিয়ে। সেই সন্ধ্যাতেই আয়োজন করা হবে ‘আনন্দমেলা’র। অনেক সদস্য বাড়ি থেকে আমিষ, নিরামিষ, মিষ্টি নানা রকম খাবারদাবার বানিয়ে নিয়ে এই মেলায় আসবেন। অষ্টমীর সকালে পুজো ও অঞ্জলির পরে প্রতিবারের মতো এ বারও থাকবে মহাভোগ বিতরণ। প্রায় ৭০০ জনকে বসিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। মেনুতে রয়েছে খিচুড়ি, লাবড়া, নানা ধরনের ভাজাভুজি, চাটনি, মিষ্টি ও পায়েস। পরিবেশন করার দায়িত্ব নেন ‘বাসা’র সদস্যরাই। সে দিনই সন্ধেবেলা আমাদের অবাঙালি অতিথিদের জন্য এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এই সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘বাসা’র সদস্যরাই পরিচালনা ও পরিবেশনা করেন। তার জন্য দু’-তিন মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম চলে। প্রতিদিন কাজের পরে বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলা রিহার্সাল দেওয়া হয়।
পুজোর সময়ে প্রকাশিত হবে ‘বাসা’র স্যুভেনির। এতে থাকবে সদস্যদের লেখা গল্প-কবিতা, আঁকা ছবি, ফটোগ্রাফ, এমনকি নানা মুখরোচক রান্নার প্রণালীও। দশমীতে সিঁদুরখেলার ঠিক আগেই থাকছে এক চমকপ্রদ নাচের অনুষ্ঠান। তাতে অংশ নেবেন প্রবীণ আর খুদে সদস্যরা। দেবী-বরণের পরে ঘট বিসর্জনের পালা। এখানকার পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের জন্য প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া যায় না। দু’বছর অন্তর অন্তর আমরা জল দিয়ে মূর্তি গলিয়ে ফেলি।
বিজয়া দশমীর আলিঙ্গন আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের সঙ্গে বাড়তি পাওনা, মুখরোচক আমিষ ভোজ। রবিবার সন্ধেটা এ ভাবেই কেটে যাবে। তারপর আবার যার যার নিজস্ব কর্মব্যস্ত জীবনে ফেরা। আর পরের বছরের পুজোর জন্য অপেক্ষা করা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy