ক্ষমতার রাজনীতিকে সত্যিই কি নতুন কোনও ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে পারল কোভিড-১৯? গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায়-লন্ডভন্ড। একটা বছর বদলে দেয় অনেক কিছু। কিন্তু এমন বদলের বছর আগে আসেনি! সেই বদলের ছাপ রাজনীতিতেও। কিন্তু কতটা? কী বদলাল আর কীসে ছাপ পড়ল না অতিমারির ছোবলের?
করোনা পর্বের বর্ষপূর্তির ঠিক আগে ভোট রাজনীতির দুটো বৈতরণী সফল ভাবে পার হল। একটা আমেরিকায়। আর একটা বিহারে। আমেরিকা অনেক দূর। ঘরের পাশের ‘আরশিনগর’ বিহারেই চোখ রাখা যাক।
দৃশ্য ১: মাঠের একধারে বড় মঞ্চ। স্টার নেতা বক্তৃতা দিচ্ছেন। রয়েছেন দল আর জোটের তাবড় নেতারা। দূরত্ব-মাস্ক-স্যানিটাইজার বিধি পালন ‘পারফেক্ট’ না হলেও মোটামুটি।
দৃশ্য ২: নেতার মঞ্চের সামনে ব্যারিকেড। তার ওপারে বিশাল মাঠ। থিকথিক করছেন মানুষ। মাটিতে কেউ বাবু হয়ে বসে, কেউ হাঁটু মুড়ে। অধিকাংশ গরিব বা নিম্নবিত্ত। বেশিভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। একের সঙ্গে অন্যের দূরত্ব নেই। তবে তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। মাঠ টহল দিচ্ছেন পার্টির কর্মীরা। নেতা বলছেন, ‘‘এই মাঠে যত লোক আছে, বাইরে আছে আরও বেশি।’’
মঞ্চের নীচে জনতার এই ছবি করোনা পর্বের আগে যেমন ছিল, এখনও প্রায় তেমনই। জনসমর্থনের বহর দেখাতে কাতারে কাতারে কর্মী-সমর্থককে এনে যখন ঠেসে বসানো হচ্ছে মাঠে, নেতাদের সংসদে তখন কোভিড আতঙ্কে গোটা অধিবেশনই বাতিল! নেতা-প্রজার সম্পর্কের এই রাজনৈতিক ছবি, দু’পক্ষের ফারাকের জমি আসলে কিছুই বদলায়নি।
মঞ্চ এবং মাঠ। বিহারে নির্বাচনী প্রচার ২০২০।
কিন্তু সত্যি কি কিছুই বদলায়নি? বদলেছে।
• নেতাদের প্রত্যক্ষ জনসংযোগ ভীষণ ভাবে ব্যাহত। বিহার ভোট কভার করে-আসা সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, এলাকায় এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে কয়েকশো মানুষের মিছিলের যে রেওয়াজ ছিল, তা এবার কম। বাইকমিছিলও তাই। বড় মিছিল-মিটিংয়ের সংখ্যাও কমেছে অনেকটা।
• কোভিড-পর্বের গোড়া থেকে দেশের বড়-মাঝারি-ছোট সব নেতা বা জনপ্রতিনিধি জনতার সরাসরি সান্নিধ্য এড়িয়ে চলেছেন। ব্যতিক্রম অবশ্য কিছু আছে।
• ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে বিজেপি (এদেশে) বাকিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। জনমত গড়তে রাজনৈতিক প্রচার এবং রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রান্তর অনেকদিনই হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু করোনা পর্বে প্রত্যক্ষ জনসংযোগ ধাক্কা খাওয়ায় দলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ভার্চুয়াল যুদ্ধে।
• করোনা পর্ব ভার্চুয়াল লাইভ-সভার দরজা খুলিয়ে দিয়েছে। উপায় নেই। রাস্তায় শক্তিপ্রদর্শনের লড়াই কমেছে। সর্বোচ্চ নেতারা অনলাইন বক্তৃতায় জোর দিয়েছেন। ফলে মোবাইল, মনিটর বা টিভি স্ক্রিনের ফ্রেমেই আমরা এখন অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি রাজনীতির খেলা। ২০২০-তে দাঁড়িয়ে রাজনীতি ‘ফ্রেমবন্দি’।
কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিকে সত্যিই কি নতুন কোনও ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে পারল কোভিড-১৯?
কোভিড পর্বের গোড়ায় প্রশ্ন জাগছিল— ভয়ঙ্কর এবং অদৃশ্য এক মারণশত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একবিংশ শতাব্দীর মানবসভ্যতা কি নতুন কোনও মানবিক সম্পর্কের সন্ধান করবে? দুর্নীতির রাজনীতি, বিদ্বেষের রাজনীতি, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকার রাজনীতির মনে কি এই মৃত্যুচেতনা কোনও পরিবর্তিত বিবেকের জন্ম দেবে?
‘তিন বন্ধু’ (মোদী-ট্রাম্প, ট্রাম্প-শি, মোদী-শি)
নাহ্, এমন কিছু হয়নি।
মঞ্চে এবং মাঠে বসা মানুষদের মধ্যে একচুলও ফারাক কমেনি। এমন একটা দুঃসময়েও মন্দির রাজনীতি জাগ্রত থেকেছে, ত্রাণের টাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকরা পথে পথে মরেছেন, রাজনৈতিক খুনোখুনি চলেছে, ফেক ভিডিয়ো ছড়ানো হয়েছে। নিজেকে বা নিজেদের ক্ষমতায় রাখাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেরে গিয়েও ‘হার মানছি না’ নাটকে চমৎকার শোভা পাচ্ছে। রাজনীতি তার অন্তরাত্মায় যেমন ছিল তেমনই আছে।
তবে রাজনীতিতে সবসময়ই উত্থানপতন থাকে। সেই লাভ-ক্ষতির অঙ্কে কোভিড এ বছর নতুন এক ‘ফ্যাক্টর’ হিসাবে দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্পের হারে ফ্যাক্টর হল কোভিড!
অনেকেই বলছেন। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের প্রাক্ ভোটসমীক্ষা বলেছিল জো বাইডেন জিতবেন। কিন্তু নিজের দেশের অধিকাংশ মিডিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের তো সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। তাই মিডিয়ার বাইরের অনেকেরই মনে হয়েছিল, সেই ‘একতরফা’ সমীক্ষায় পক্ষপাতিত্ব আছে। শেষ পর্যন্ত সমীক্ষা শুধু মিললই না, একাধিক রিপাবলিকান ঘাঁটিতেই ট্রাম্প হারলেন। ফলাফল বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড সামলানোয় চিনের ‘সাফল্য’ এবং ট্রাম্পের ব্যর্থতা এই হারের পিছনে অন্যতম বড় কারণ। ট্রাম্প একদিকে আমেরিকার চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞদের নিজের খেয়ালখুশি মতো উপেক্ষা করেছেন। অন্যদিকে, চিনের দিকে আঙুল তুলে নিজের দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে গিয়েছেন। এটাই ভোট ঘুরিয়ে দিয়েছে বলে অধিকাংশের অভিমত।
মোদীর ‘মুক্তি’!
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি-২০২০। ১৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া দিল্লির শাহিনবাগ আন্দোলন দেশের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে মুসলিম সমাজের মেয়েরা দলে দলে রাস্তায় এসে বসছেন সিএএ (সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন)-র বিরুদ্ধে। কোনও দলের নেতৃত্বে নয়, শহুরে নাগরিক সমাজ আন্দোলনের নতুন ছবি দেখাচ্ছে দেশে। বহু শিখ ধর্মস্থান খুলে রাখা হয়েছে আন্দোলনকারীদের সাহায্যে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ সারা দেশ দেখল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। দিল্লি ‘দাঙ্গা’! নিহতের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। সব মিলিয়ে মার্চের প্রথম দু’সপ্তাহ পর্যন্ত অভূতপূর্ব এক অস্বস্তিতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
অমিত শাহ সিএএ-এনআরসি একসঙ্গে জুড়ে বক্তৃতা করেছেন বারবার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাপে থাকা প্রধানমন্ত্রীকে এই দুইয়ের সম্পর্ক নেই বলে সজোরে ঘোষণা করতে হচ্ছে। আশ্বাস দিতে হচ্ছে, এ দেশের প্রকৃত নাগরিকরা ধর্মপরিচয়ের জন্য কোনও সমস্যায় পড়বেন না। সে সময় কে জানত, তাঁর জন্য এবং দেশের জন্য আরও বড় উদ্বেগের কাল আসতে চলেছে! করোনা ভয় দেশকে ঘিরতে শুরু করল মার্চের মাঝামাঝি। ২৪ মার্চ থেকে দেশজোড়া লকডাউন। নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে মোদী। কিন্তু তিন মাসের উপর চলতে থাকা সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রবল চাপ থেকে যেন তাঁকে মুক্তিও দিয়ে গেল কোভিড-১৯।
শি-র মুখে হাসি!
শ্যামবাজারের রকের বক্তা পানুবাবুর একটা থিয়োরি আছে— চিন তার ল্যাবরেটরিতে করোনা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ইউরোপে-আমেরিকায়। আর নিজেরা আগে থেকে প্ল্যান করে তৈরি হয়ে নিয়েছিল, আমেরিকা সমেত গোটা প্রথম বিশ্বের অর্থনীতি ডুবিয়ে বিশ্বের এক নম্বর হতেই নাকি চিনের এই চক্রান্ত।
এ হেন ‘ঠেকের তত্ত্ব’ যতই কষ্টকল্পিত হোক, তথ্য হল— চিন বিশ্বের একমাত্র বড় অর্থনীতি, যে এই কোভিড বছরেও আর্থিক বৃদ্ধির মুখ দেখল। আমেরিকা থেকে ভারত, রাশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সৌদি আরব, ব্রাজিল— সকলের জাতীয় উৎপাদন ২০২০ সালে কমে গিয়েছে। শি জিনপিং-এর হাসি আপাতত চওড়া।
দেশের ভিতরের রাজনীতিতে শি জিনপিং অবশ্য এমনিতেই নরেন্দ্র মোদী আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত। ভারত বা আমেরিকায় জনতার ভোটে জিতে ক্ষমতায় থাকতে হয়। চিনের একদলীয় শাসনে সে বালাই নেই। শুধু দল আর পিএলএ-র (পিপলস লিবারেশন আর্মি নামেই চিনা সেনার পরিচয়) মধ্যে নিজের আধিপত্য কায়েম রাখাই যথেষ্ট। সেই চিন কোভিড-চক্রে আগামী ৮-৯ বছরের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হতে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে ‘জাপান সেন্টার ফর ইকনমিক রিসার্চ’। এই ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হলে বিশ্ব-রাজনীতিতে হয়ত সত্যিই বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে অদৃশ্য ভাইরাস।